মঙ্গলবার, এপ্রিল ৩০, ২০২৪
প্রচ্ছদটপঅদম্য অগ্রযাত্রার ব্রাসেলস সেমিনার

অদম্য অগ্রযাত্রার ব্রাসেলস সেমিনার

অতি সম্প্রতি বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে স্টাডি সার্কেল লন্ডন ও ইউরোপীয় ইনস্টিটিউট অব এশিয়ান স্টাডিস আয়োজিত ‘বাংলাদেশ : অদম্য উন্নয়ন যাত্রা’ শীর্ষক সেমিনার আয়োজন বাংলাদেশকে আবিষ্কারে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। দীর্ঘ সময়ের সুখ-দুঃখের হালখাতা বিশ্লেষণ ছাড়া এই উন্নয়ন অগ্রযাত্রার তাৎপর্য অনুধাবন সম্ভব নয়। মেঘের আড়ালে যেমন সূর্য লুকিয়ে থাকে, তেমনি আজকের আধুনিক বাংলাদেশকে জানার জন্য হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত অনেক করুণ আর্তনাদ স্মরণবোধকে বিদ্ধ করছে। দেশসহ বিশ্ববাসী সম্যক অবগত আছে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ইস্পাত কঠিন স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ত্রিশ লাখ শহীদানের আত্মবিসর্জনে অর্জিত লাল-সবুজ পতাকার প্রিয় মুক্ত মাতৃভূমি বাংলাদেশ।
তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত সরকার-জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন-মহান মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক সংগঠন-পরিচালনা-এক কোটি শরণার্থীর আশ্রয় ইত্যাদির জন্য দেশবাসীকে নিরন্তর কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ করেছে। ওই সময় পাকিস্তানি হায়েনাদের পক্ষে অস্ত্র ও সামগ্রিক সহযোগিতা দিয়ে বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলো চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন-গণহত্যায় শামিল হয়েছিল। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর থেকেই সদ্য স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রকে পুনর্গঠনের জন্য অসামান্য দেশপ্রেম-বুদ্ধিমত্তা-দূরদর্শিতায় দেশকে এগিয়ে নেওয়ার অদম্য যাত্রাপথে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রকারীদের কদর্য অপতৎপরতায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু প্রায় সপরিবারে শাহাদতবরণ করেন। বঙ্গবন্ধুর সরকারকে নাজেহাল ও বিশ্বব্যাপী অকার্যকর করার কূট প্ররোচনায় কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ, সংকট ও তলাবিহীন ঝুড়ি বিশেষণে আখ্যায়িত করতে ন্যূনতম কুণ্ঠাবোধ করেনি। সামগ্রিক অর্থে দেশকে প্রায় গুছিয়ে আনার পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়ে দেশ সেনা-স্বৈরশাসনে নিপতিত হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের নির্ভীক সেøাগান ‘জয় বাংলা’, ‘বাংলাদেশ বেতার’ ইত্যকার বিষয়ে পাকিস্তানি কায়দায় নামকরণসহ কুৎসিত অপশাসনের কালো অধ্যায় সূচিত হয়।  ১৯৭৩ সালে জাতীয় বিজয় দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু বেতার ও টেলিভিশন ভাষণে বলেন ‘ষোলোই ডিসেম্বরের সঙ্গে আমাদের অনেক ব্যথা, বেদনা, আনন্দ, গৌরব এবং আশা-আকাক্সক্ষা জড়িত। এই দিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রায় এক লাখ পাকিস্তানি শত্রু আত্মসমর্পণ করেছে। কিন্তু আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে আরও শক্তিশালী শত্রু। এই শত্রু হলো অভাব, দারিদ্র্য, ক্ষুধা, রোগ, অশিক্ষা, বেকারী ও দুর্নীতি। এই যুদ্ধের জয় সহজ নয়। অবিরাম এই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে এবং একটি সুখী-সুন্দর-অভাবমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে। তবেই হবে আপনাদের সংগ্রাম সফল, আপনাদের শেখ মুজিবের স্বপ্ন ও সাধনার সমাপ্তি।’ ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক মুক্তি ও স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পর বহুবার তিনি জাতিকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, রাজনৈতিক মুক্তি অর্জন করলেও অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনে জাতিকে ঐক্যবদ্ধভাবে কঠিন নতুন সংগ্রামে জয়ী হতে হবে।
দৃঢ়কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর দাবি ছিল সুখী ও শোষণমুক্ত বাংলাদেশ নির্মাণে ব্যর্থ হলে স্বাধীনতার অর্থবহতা নিদারুণ অসারে পরিণত হবে। স্বাধীনতা তখনই প্রকৃতপক্ষে উপলব্ধি করা যাবে যখন দেশের কৃষক-মজুর ও দুঃখী মানুষের সব দুঃখের অবসান হবে। বঙ্গবন্ধুর আজীবন লালিত সোনার বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়নে বস্তুত মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল। এই অঞ্চলের শোষিত-বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য শুধু ভৌগোলিক স্বাধীনতা নয়; দারিদ্র্যমুক্ত-ক্ষুধামুক্ত, কর্মচঞ্চল আত্মপ্রত্যয়ী, গণতান্ত্রিক-অসাম্প্রদায়িক-মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা। বঙ্গবন্ধু নিরন্তর অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ে দীর্ঘ জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে যে বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছেন, তা ছিল পাকিস্তানি কায়েমি স্বার্থবাদীদের নির্দয় শোষণ-শাসনের নানা অনুষঙ্গ।  স্বাধীন মাতৃভূমি প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ সময় অতিক্রান্তে পুরো বিশ্ব যখন চলমান রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ-ক্ষমতাধর পরাক্রমশীল রাষ্ট্রগুলোর সমরাস্ত্র বিক্রির প্রতিযোগিতায় জ্বালানি-খাদ্য সংকট-দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি-বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থার চরম অসঙ্গতিতে লণ্ডভণ্ড পরিক্রমা অতিক্রম করছে, একই সময়ে সামগ্রিক বিবেচনায় আর্থসামাজিক স্থিতিশীলতায় বাংলাদেশ অনুপম দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিভাত। বঙ্গবন্ধুকন্যা ও প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে অদম্য অগ্রগতিতে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের বিগত বছরগুলোয় বিশ্ব স্বীকৃত উন্নয়ন-অর্জনের হালখাতা বিশ্ব পরিমণ্ডলে সরকার এবং জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় এত বেশি অত্যুজ্জ্বল যে, অবাক বিস্ময়ে পুরো ধরিত্রী উন্নয়ন বন্দনায় বাংলাদেশকে উপমা হিসেবে গ্রহণ করছে। স্বপ্নের পদ্মা সেতু-মেট্রোরেল-বঙ্গবন্ধু টানেল-১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল-এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে-ওড়ালসড়ক-বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-মাতারবাড়ী প্রকল্প-রূপপুর পারমাণবিক ও রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র-গভীর সমুদ্র বন্দর-বিপুল সংখ্যক দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আশ্রায়ণ ব্যবস্থা-হাইটেক পার্ক এবং আইটি ভিলেজ নির্মাণ-যোগাযোগ ও অবকাঠামো উন্নয়ন-শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কৃষিসহ সব ক্ষেত্রে সরকারের অভূতপূর্ব সাফল্য মাঙ্গলিক-নান্দনিক গৌরবগাথায় সুপ্রতিষ্ঠিত।
ব্রাসেলস সেমিনার শুধু বাংলাদেশকে বিশ্ব পরিমণ্ডলে অত্যুজ্জ্বল করেনি, অনন্য উচ্চতায় মর্যাদাসীনও করেছে বটে। সেমিনারে মূল প্রবন্ধের ওপর আলোচনা করেন বেলজিয়াম সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডিরেক্টর জন করনেট ইলজিয়াস, ইউরোপিয়ান এক্সটারনাল অ্যাকশন সার্ভিসের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক প্রধান রেনজে তেরিঙ্কে, বেলজিয়াম পার্লামেন্ট সদস্য মিলান জভেরসহ প্রমুখ।
সেমিনারে বক্তরা বলেন- ‘শত বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে বাংলাদেশের যে অগ্রযাত্রা, সেটি বিশ্বের উন্নত দেশের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদেশ আর্থসামাজিক, গণতন্ত্রের সূচক, দেশের উন্নয়নের সঙ্গে অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছেন। কোভিড-১৯, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব- সবকিছুকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা অদম্য। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এক দশক ধরে পুরো বিশ্ব বাংলাদেশের অর্থনীতির অভূতপূর্ব অগ্রগতি প্রত্যক্ষ করেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি সহস্রাব্ধ লক্ষ্যমাত্রার বেশিরভাগ লক্ষ্য অর্জনে দেশটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে।’ তারা বলেন, ‘মাথাপিছু আয়, অনেক মূল অর্থনৈতিক সূচকসহ এমডিজির আওতায় বেশিরভাগ সামাজিক সূচকের লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশ প্রতিবেশী ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছে। এই উত্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ করোনা অতিমারীর কারণে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ অর্থনীতির গতি বজায় রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য জাতিসংঘের উন্নয়ন নীতি কমিটির (ইউএন-সিডিপি) অনুমোদন পেয়েছে, এমনকি অতিমারীর আগে দেশে দারিদ্র্যের হার হ্রাস পেয়েছিল ব্যাপক হারে। বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন- যার ৬০ শতাংশই নারী। শিল্পটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তর বিশ্বের কাছে একটি উন্নয়ন মডেল।
অব্যাহত বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট-বিপর্যস্ততায় বিভিন্ন বৈশ্বিক আর্থিক-উন্নয়ন-দাতা সংস্থা কর্তৃক বিশ্বের অনুন্নত-উন্নয়নশীল-উন্নত দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি অত্যধিক কমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হয়েছিল। কিন্তু আইএমএফ ওই শঙ্কা নাকচ করে গত এক বছরের মধ্যে অতি সম্প্রতি বৈশ্বিক অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে। সংস্থাটির জানুয়ারি মাসের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পূর্বাভাসের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুসারে চলতি ২০২৩ সালে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি হতে পারে ২ দশমিক ৯ শতাংশ। গত ৩০ জানুয়ারি আইএমএফের প্রকাশিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ২০২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ২০২৪ ও ২০২৫ অর্থবছরে আরও বেড়ে হবে যথাক্রমে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ ও ৭ দশমিক ১ শতাংশ। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের ‘গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টাস জানুয়ারি ২০২৩’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ জিডিপি অর্জনে সৌদি আরব, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলতে সক্ষম হওয়ার চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।
ওই প্রতিবেদন মতে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৫ দশমিক ২ শতাংশ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে হবে ৬ দশমিক ২ শতাংশ। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে জাপান ১, ইউরোপ শূন্য দশমিক ১, চীন ৪ দশমিক ৪, ইন্দোনেশিয়া ৪ দশমিক ৮, থাইল্যান্ড ৩ দশমিক ৬, সৌদি আরব ৩ দশমিক ৭, ইরান ২ দশমিক ২, মিসর ১ দশমিক ৯ ও পাকিস্তান ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে। অর্থনীতিবিদদের মতেÑ বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ সব দাতা সংস্থা বাংলাদেশ সম্পর্কে যে পূর্বাভাস দিচ্ছে; এতে দেশের অর্থনীতির ইতিবাচক ধারার বার্তা অত্যন্ত সুস্পষ্ট। এটিও আশাব্যঞ্জক বক্তব্য যে, সফল ও সার্থক বর্তমান সরকারের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া সঠিক পথেই আছে। সংক্ষেপে বলা যায়, ব্রাসেলস সেমিনার ও আন্তর্জাতিক সংস্থার নানা প্রতিবেদন বিবেচনায় দেশের অবস্থান পুরো বিশ্বের জন্য অসাধারণ বিস্ময় নির্মাণ করেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক অবিনাশী চেতনায় এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশকে রুদ্ধ করার সব অপকৌশল পরাভূত হবেই। আগামী দিনগুলো দেশকে অধিকতর সমৃদ্ধি-সম্ভাবনার পথে অনন্য হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এ বিষয়ে কারও সন্দেহ-সংশয় পোষণ করার ন্যূনতম অবকাশ নেই। সর্বকালে, সর্বসময়ে, সর্বক্ষেত্রে বাংলাদেশ-জনগণ অপরাজিত থাকুক- এ প্রত্যাশাই ব্যক্ত করছি।
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ ও সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
আরও পড়ুন

সর্বশেষ