শুক্রবার, এপ্রিল ২৬, ২০২৪
প্রচ্ছদঅর্থ ও বানিজ্য সময়অবৈধভাবে গ্রাহকের টাকা খরচ করছে ডায়মন্ড লাইফ

অবৈধভাবে গ্রাহকের টাকা খরচ করছে ডায়মন্ড লাইফ

বছরের পর বছর গ্রাহকদের টাকা অবৈধভাবে ব্যয় করছে জীবন বিমা কোম্পানি ডায়মন্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স। ব্যবসা শুরুর পর একে একে আট বছর পার করলেও বিমা কোম্পানিটি খরচের লাগাম টেনে ধরতে পারেনি। আইন লঙ্ঘন করে মাত্রাতিরিক্ত টাকা খরচ করায় কোম্পানিটির পলিসিহোল্ডার বা গ্রাহকরা ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এছাড়া প্রতি বছর তামাদি (ল্যাপস) হয়ে যাচ্ছে কোম্পানিটির বিক্রি করা বিমা পলিসির বড় একটি অংশ। নতুন পলিসি যে পরিমাণ বিক্রি হচ্ছে বছর ঘুরে নবায়ন প্রিমিয়াম আদায় হচ্ছে তার অর্ধেকেরও কম। ফলে খরচ দেখিয়ে টাকা সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে কি না, তা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।

কোম্পানিটি বিমা ব্যবসার নিবন্ধন সনদের শর্তও লঙ্ঘন করেছে। অন্যতম শর্ত ছিল তিন বছরের মধ্যে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া। তবে ২০১৩ সালে নিবন্ধন পেয়ে ২০১৪ সালে ব্যবসা শুরু করা কোম্পানিটি আট বছর পার করেও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে পারেনি।

একটি জীবন বিমা কোম্পানি ব্যবস্থাপনা খাতে কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করবে তা আইন দ্বারা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। কোম্পানিটি সেই সীমা মানেনি। জাগো নিউজের অনুসন্ধানে জানা যায়, আইন অনুযায়ী সবশেষ সমাপ্ত ২০২১ সালে ডায়মন্ড লাইফের ব্যবস্থাপনা খাতে সর্বোচ্চ ব্যয়ের সীমা নির্ধারিত ছিল ১২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। তবে বছরটিতে কোম্পানিটি ব্যয় করেছে ১৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ আইন লঙ্ঘন করে প্রতিষ্ঠানটি দুই কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করেছে।

শুধু ২০২১ সাল নয়, এর আগের বছরগুলোতেও এই জীবন বিমা কোম্পানিটি ব্যবস্থানা খাতে আইন লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করেছে। ২০২০ সালে কোম্পানিটি আইন লঙ্ঘন করে ব্যবস্থাপনা খাতে অতিরিক্ত ব্যয় করে ১ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। বছরটিতে ব্যবস্থাপনা খাতে কোম্পানিটির সর্বোচ্চ ব্যয় নির্ধারিত ছিল ১০ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। তবে কোম্পানিটি ব্যয় করে ১২ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। এর আগে ব্যবস্থাপনা খাতে আইন লঙ্ঘন করে ২০১৯ সালে ৪ কোটি ১৭ লাখ টাকা, ২০১৮ সালে ৪ কোটি ৭৪ লাখ টাকা এবং ২০১৭ সালে ২ কোটি ৮৫ লাখ টাকা অবৈধভাবে খরচ করে কোম্পানিটি।

ব্যবস্থাপনা খাতে অবৈধভাবে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করায় কোম্পানিটির পলিসিহোল্ডার ও শেয়ারহোল্ডাররা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আইনি সীমার অতিরিক্ত যে টাকা ব্যয় করা হচ্ছে তার ৯০ শতাংশই প্রতিষ্ঠানের পলিসিহোল্ডাররা প্রাপ্য। বাকি ১০ শতাংশের ভাগিদার শেয়ারহোল্ডাররা।

আইন লঙ্ঘন করে ব্যবস্থাপনা খাতে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ডায়মন্ড লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) পিপলু বিশ্বাস বলেন, আমরা ব্যবস্থাপনা ব্যয় আইনি সীমার মধ্যে নিয়ে আসার পরিকল্পনা নিয়েছি। আশা করি ২০২২ সালে আমাদের ব্যয় আইনি সীমার মধ্যে থাকবে।

ব্যবসা শুরুর পর ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রতিটি বছরেই আইনি সীমার অতিরিক্ত অর্থ ব্যবস্থাপনা খাতে ব্যয় হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন গ্রাহকরা, এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, অতীতে যাই হোক, এবার আমরা ব্যয় আইনি সীমার মধ্যেই রাখবো।

ব্যবস্থাপনা খাতে অস্বাভাবিক অর্থ ব্যয় করা হলেও প্রতি বছর কোম্পানিটি নতুন যে প্রিমিয়াম আয় করছে পরবর্তী বছরে নবায়ন প্রিমিয়াম বাবদ আদায় হচ্ছে তার খুবই নগন্য পরিমাণ। ২০২১ সালে কোম্পানিটি নবায়ন প্রিমিয়াম আয় করেছে ৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। অথচ আগের বছর কোম্পানিটি প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয় করে ১১ কোটি ৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ, নবায়নে কোম্পানিটির অর্ধেকের বেশি প্রিমিয়াম আদায় হয়নি।

এ চিত্র শুধু ২০২১ সালের নয়। কোম্পানিটি ব্যবসা শুরুর পর থেকেই নবায়ন প্রিমিয়াম আদায়ে এমন দশা বিরাজ করছে। ২০২০ সালে কোম্পানিটি নবায়ন প্রিমিয়াম আদায় করে ৩ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। তার আগে ২০১৯ সালে ৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা, ২০১৮ সালে ২ কোটি ৮২ লাখ টাকা এবং ২০১৭ সালে ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা নবায়ন প্রিমিয়াম বাবদ আদায় হয়।

অথচ ২০১৯ সালে ডায়মন্ড লাইফ প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয় দেখায় ৯ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। তার আগে ২০১৮ সালে ৮ কোটি ২৫ লাখ টাকা এবং ২০১৭ সালে ১০ কোটি ৯৮ লাখ টাকা প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম বাবদ আয় দেখায় জীবন বিমা কোম্পানিটি। অর্থাৎ প্রতি বছর কোম্পানিটির প্রিমিয়াম আয়ের অর্ধেকেরও বেশি অর্থ নবায়নে আদায় হচ্ছে না।

ডায়মন্ড লাইফের প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম ও নবায়ন প্রিমিয়ারের চিত্র সন্দেহজনক বলছেন বিমা খাত সংশ্লিষ্টরা। একাধিক বিমা কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ডায়মন্ড লাইফ প্রতি বছর প্রথমবর্ষ প্রিমিয়াম আয় যা দেখাচ্ছে, পরের বছর নবায়ন প্রিমিয়াম আয় হচ্ছে তার অর্ধেকের কম। এতে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, কোম্পানি প্রথমবর্ষ প্রিমিয়াম আয় যা দেখাচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে আয় তা হচ্ছে কি না। নাকি অতিরিক্ত প্রিমিয়াম দেখিয়ে কোম্পানি থেকে কমিশনসহ বিভিন্ন খাতের খরচ বাবদ টাকা সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে- নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) বিষয়টি খতিয়ে দেখা উচিত।

নবায়ন প্রিমিয়াম অর্ধেকেরও বেশি আদায় না হওয়ার কারণ হিসেবে ডায়মন্ড লাইফের সিইও পিপলু বিশ্বাস বলেন, নতুন কোম্পানিতে কর্মী ধরে রাখা কষ্টকর। আবার এ খাতে কিছু লোক আছে, যারা কোম্পানি ছেড়ে যাওয়ার পর নানারকম বদনাম ছড়ায়। তবে আমরা নবায়ন প্রিমিয়াম আয় বাড়ানোর চেষ্টা করছি। কেন গ্রাহকরা নবায়ন প্রিমিয়াম দিচ্ছেন না তা জানার জন্য নিয়মিত আমাদের কল সেন্টার থেকে গ্রাহকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে।

নিবন্ধন সনদের অন্যতম শর্ত ছিল তিন বছরে মধ্যে পুঁজিবাজারে আসতে হবে। কিন্তু আট বছরেও পুঁজিবাজারে আসতে না পারার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে পিপলু বিশ্বাস বলেন, আমাদের কোম্পানির লাইফ ফান্ড পজিটিভ হয়েছে। আমরা পুঁজিবাজারে আসতে কার্যক্রম শুরু করেছি। এরই মধ্যে ইস্যু ম্যানেজার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ