প্রিয় কেডিট কার্ড গ্রাহক, অর্থ আইন-২০২২ অনুযায়ী আপনার আয়কর রিটার্নের প্রাপ্তি স্বীকারপত্র নিকটস্থ ব্র্যাক ব্যাংক শাখায় জমা দিন। বিস্তারিত ১৬২২১’ বেসরকারি ব্র্যাক ব্যাংক তাদের গ্রাহকদের এ বার্তা দিচ্ছে। ব্র্যাক ব্যাংকের মতো সকল ব্যাংকই তাদের ক্রেডিট কার্ড গ্রাহকদের এ বার্তা দিচ্ছে। এটাকে এক ধরণের হয়রাণি বলছেন গ্রাহকরা। অবশ্য ব্যাংকগুলোও এ ধরণের সিদ্ধান্তে বিরক্তি প্রকাশ করেছে। তবে চলতি বাজেটে রিটার্ন ছাড়া পাঁচ লাখ টাকা বা অধিক লোন ও ক্রেডিট কার্ড নেয়ার ক্ষেত্রে ইনকাম ট্যাক্স রিটার্ন জমাদান বাধ্যতামূলক করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। অন্যথায় ঋণ দিলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারবে এনবিআর। আর তাই জরিমানার ভয়ে গ্রাহকদের প্রতিনিয়ত এই বার্তা দিতে বাধ্য হচ্ছে ব্যাংকগুলো।
অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, মানুষের দৈনন্দিন আর্থিক লেনদেন সহজ, নিরাপদ, তাৎক্ষণিক করা এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তি আরো সম্প্রসারিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিনিয়তই নানামুখী কার্যক্রম হাতে নিচ্ছে। আর ক্রেডিট কার্ড নেয়ার ক্ষেত্রে ইনকাম ট্যাক্স রিটার্ন জমাদান বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক এ ধরণের কোনো নিয়ম করেনি। তাই বিষয়টি আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
সূত্র মতে, নগদ টাকা বহনে বাড়তি ঝামেলা। আছে জাল নোটের ঝুকি। আবার ছিনতাইয়ের ভয় তো আছেই। এ ছাড়া অপরাধমূলক নানা লেনদেনও হয়ে থাকে নগদে। এসব বিবেচনায় বেশ আগে থেকে সব লেনদেন ও সেবা ডিজিটাল করার চেষ্টা করছে সরকার। বিশ্বের অনেক দেশ এখন ‘ক্যাশলেস সোসাইটি’তে পরিণত হয়েছে। কোনো কোনো দেশ নগদ লেনদেন ন্যূনতম পর্যায়ে এনেছে যা ‘লেস ক্যাশ’ হিসেবে বিবেচিত। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতও এক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে। তবে বাংলাদেশও চাচ্ছে ক্যাশ লেসের দিকে যেতে। তাই ব্যাংকিং লেনদেনে কাগজের নোটের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর জন্য ক্রেডিট কার্ডে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এর ফলে দেশের প্রায় সব ব্যাংকেই ক্রেডিট কার্ড প্রচলন শুরু হয়েছে। তাই প্রতিদিনই বাড়ছে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীর সংখ্যা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, দেশে এটিএম কার্ডের গ্রাহক প্রায় সাড়ে ৪ কোটি ও ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহক ১৯ লাখ ৪১ হাজারের বেশি। এসব গ্রাহকরা প্রতিমাসে গড়ে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা লেনদেন করে থাকেন। এটিএম, সিআরএম, পয়েন্ট অব সেলস ও ই-কমার্স কেনাকাটায় এসব লেনদেন হয়। পাশাপাশি এসব গ্রাহকের বেশির ভাগের আয়ই ৩০ হাজার টাকার নিচে। সাধারণত ব্যাংক কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীর আয় ২০ হাজার টাকার ওপরে হলেই সংশ্লিষ্টদের ক্রেডিট কার্ড দিয়ে থাকে। আগে ক্রেডিট কার্ড নিতে টিআইএন লাগত। কিন্তু রিটার্ন জমা দেয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল না। ক্রেডিট কার্ড নেয়ার ক্ষেত্রে ইনকাম ট্যাক্স রিটার্ন জমাদান বাধ্যতামূলক করায় ব্যাংকগুলোও বিপাকে আছে। ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, এ নিয়মে এসএমই উদ্যোক্তারা ব্যাংকিং খাত থেকে লোন নিতে নিরুৎসাহিত হবে। আর এসএমই খাতের ৬০ শতাংশ লোনই গ্রামীণ এলাকায় বিতরণ করা হয়। এর ফলে প্রান্তিক জনগণের জন্য সরকারের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি কার্যক্রম ও এসডিজি অর্জন বাধাগ্রস্ত হবে। ট্যাক্স রিটার্ন জমা দেয়া সময়সাপেক্ষ হওয়ায় গ্রাহকরা সময়মত লোন পাবেন না, জটিলতা সৃষ্টি হবে ও লোন প্রসেসিং বিলম্বিত হবে। গ্রাহককে ব্যাংকের সহায়তার হাতও বন্ধ হয়ে গেছে। পাশাপাশি ব্যাংকের কাছে ইনকাম ট্যাক্স রিটার্ন ডকুমেন্টের যাচাই করার ব্যবস্থা না থাকায় ব্যাংকগুলোকে বিপাকে পড়তে হবে। নতুন নিয়মে সরকার ট্যাক্স/ভ্যাট/আবগারি আয় থেকে বঞ্চিত হবে। কারণ ডকুমেন্টের ঘাটতিতে গ্রাহকরা লোন নিতে নিরুৎসাহিত হবে। যে কারণে সরকার এ খাত থেকে ট্যাক্স/ভ্যাট/আবগারি আয় বঞ্চিত হবে। এদিকে নতুন চাকরিতে যোগদানকারীরা ব্যাংকগুলোর একটি বড় গ্রাহক। এই গ্রুপটি ই-টিন নেয়ার পরও দ্বিতীয় বছরের আগে ট্যাক্স রিটার্ন ডকুমেন্ট পাবে না। এর ফলে ব্যাংকগুলো এই সম্ভাবনাময় গ্রাহকদের হারাবে। একই সঙ্গে ট্যাক্স রিটার্ন ডকুমেন্টের বাধ্যবাধকতা ক্রেডিট কার্ড প্রসারে যেমন বাধাগ্রস্ত করবে তেমনি ডিজিটাল বাংলাদেশ ভিশন বাস্তবায়নের অন্তরায় হবে।
এদিকে এ সিদ্ধান্তে সরকারের ভ্যাট আয় কমবে। কারণ বেশিরভাগ ক্রেডিট কার্ড ভিত্তিক লেনদেনে ভ্যাট প্রয়োজ্য। নিম্ন আয়ের সেগমেন্টের ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহকরা, যারা ট্যাক্সের আওতার বাইরে আছেন, তারা ক্রেডিট কার্ড লেনদেনের মাধ্যমে ভ্যাট প্রদানে অবদান রাখছেন। কিন্তু ট্যাক্স রিটার্ন বাধ্যতামূক করলে, এই কর ছাড়প্রাপ্ত গ্রাহকরা ক্রেডিট কার্ডের সুবিধা পাবেন না। এর ফলে সরকার এই ভ্যাট আয়ের সুযোগটি বঞ্চিত হবে। একই সঙ্গে সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ অর্জনে ক্যাশলেস সোসাইটি বাধাগ্রস্ত হবে। প্রযুক্তির সহায়তায় দেশ বর্তমানে ক্যাশলেস সোসাইটির দিকে যাচ্ছিল। যা এখন আটকে গেল।
ব্যাংকাররা বলেছেন, ব্যাংক খাত বাড়তি করের বোঝা বহন করতে গিয়ে সাধারণ মানুষকে মাশুল দিতে হচ্ছে ঘাটে ঘাটে। ব্যাংকের ডিভিডেন্ড দেয়ার মতো প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। এতে প্রাপ্য মুনাফা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, নানাভাবে ব্যাংকগুলোর ওপর করের খড়গ চাপানো হয়েছে। যেমনÑ ইসলামী ব্যাংকগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে আয়ের ওপর জাকাত দিতে হয়। এ জাকাতকে ট্যাক্স আইনে ব্যয় হিসেবে ধরা হয় না। ফলে জাকাত দিতে গিয়ে ব্যাংকগুলোকে জাকাতের পাশাপাশি সমহারে ট্যাক্স দিতে হচ্ছে। এ দিকে সব শ্রেণির আমানতকারীর মুনাফার ওপর অগ্রিম আয়কর কেটে রাখা হচ্ছে ১০ শতাংশ। আর কর শনাক্তকারী নম্বর (টিআইএন) না থাকলে আমানতকারীদের মুনাফার ওপর কর পরিশোধ করতে হচ্ছে ১৫ শতাংশ। এ বিষয়ে ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, সব ব্যাংকই গ্রাহককে আয়কর রিটার্ন জমাদানের জন্য বাধ্যতামূলক বার্তা দিচ্ছে। এতে গ্রাহক-ব্যাংক সম্পর্কেও দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। ইতোমধ্যে বিষয়টি নিয়ে অর্থমন্ত্রী ও এনবিআর’র সঙ্গে বৈঠকও হয়েছে। আশাকরছি, গ্রাহকদের স্বার্থে দ্রুতই এর সমাধান হবে। অন্যথায় ক্রেডিট কার্ড গ্রাহকরা ব্যাংক বিমূখ হয়ে পড়বে। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ ভিশন বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হবে। – ইনকিলাব