শনিবার, এপ্রিল ২০, ২০২৪
প্রচ্ছদফিচারবঙ্গবন্ধু বাঙালির ধ্রুবতারা : রাশেদ রউফ

বঙ্গবন্ধু বাঙালির ধ্রুবতারা : রাশেদ রউফ

আগস্ট মাস বড় বেদনার মাস। আমাদের কাছে শোকের মাস। এ মাসেই আমরা হারিয়েছি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তাঁর সঙ্গে আমরা হারিয়েছি বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিবকে, হারিয়েছি বঙ্গবন্ধুর তিন পুত্র, দুই পুত্রবধূ এবং তার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ জনদেরও। সবচেয়ে বড় মর্মান্তিক বিষয় হলো- শিশু রাসেলকেও গুলি করে মাথার খুলি উড়িয়ে দিয়েছিল ঘাতকরা। বিদেশে অবস্থান করছিলেন বলে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন।

পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট কালরাতে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড হলো ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংসতম ঘটনা। এ ঘটনায় স্তব্ধ হয়ে যায় পুরো পৃথিবী। নেমে আসে শোকের ছায়া এবং ছড়িয়ে পড়ে ঘৃণার বিষবাষ্প। যাঁকে পাকিস্তানিরা শতরকম ষড়যন্ত্রের পরও মারতে পারে নি, তাঁকে নিঃশেষ করে দিলো দেশের মানুষ! ষড়যন্ত্র আর চক্রান্তের জাল বিছিয়ে পাকিস্তানিরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই দাবিয়ে রাখতে চায়নি, তারা সকল বাঙালিকেও দাবিয়ে রাখতে চেয়েছিল। শাসকদের চক্রান্তের পর চক্রান্ত আর বছরের পর বছর জেল-জীবন দেশের মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা একটুও কমাতে পারেনি। সেই জায়গায় বিশ্বাসঘাতকের চরম নমূনা স্থাপন করলো বাঙালি পুরো বিশ্বে। ঘাতকরা জানে না যে বঙ্গবন্ধুকে সশরীরে হত্যা করলেও তাঁর অন্তরাত্মাকে হত্যা করতে পারে নি। ফলে দেশের আপামর মানুষের কাছে বেঁচে আছেন তিনি। বঙ্গবন্ধু মিশে আছেন আমাদের অনুভূতিতে ও আমাদের অন্তরাত্মায়।

 দ্য টাইমস অব লন্ডনের ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট সংখ্যায় উল্লেখ করা হয় ‘সবকিছু সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে সব সময় স্মরণ করা হবে। কারণ তাকে ছাড়া বাংলাদেশের বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই। একই দিন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের লাখ লাখ লোক শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকাণ্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে’।

বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করার পর স্বাধীনতাবিরোধীরা এ দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পুনর্বাসিত হতে থাকে। তারা শুরু করে নানা ষড়যন্ত্র, নানা চক্রান্ত। এ দেশের ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলতে শুরু করে নানা অপতৎপরতা। তাদের রক্তচক্ষুর কারণে বঙ্গবন্ধুর নামও উচ্চারণ করা যায়নি। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ঠেকাতে তারা জারি করেছিল কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’। দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসীন হলে ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ উন্মুক্ত করা হয়। বিচার শুরু হয় ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির ললাটে যে কলঙ্কতিলক পরিয়ে দেয়া হয়েছিল, ৩৫ বছরেরও বেশি সময় পর ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি সেই কলঙ্ক থেকে জাতির মুক্তি ঘটে।

বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু মানেই বাঙালির ঠিকানা। ড. এম এ মাননানের ভাষায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু একটি নাম নয়। তিনি নিজেই একটি দেশ, যার নাম বাংলাদেশ। বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধু, দুটিই অবিচ্ছেদ্য। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ নেতা হিসেবে সুপরিচিত বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনটা ছিল বহু ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে আবদ্ধ এক বিভীষিকাময় জীবন। বার বার তিনি মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন, কিন্তু পেছনে হটে যাননি কখনো। ষড়যন্ত্র তার পিছু ছাড়েনি, তিনিও ষড়যন্ত্রের শেকল দলিত-মথিত করে পথ চলেছেন অটল চিত্তে। হরেক রকমের ষড়যন্ত্রের ঘেরাটোপে থেকেও তিনি নিজ যোগ্যতাতেই হয়ে উঠেছেন জাতির জনক, পরিণত হয়েছেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতায়। তাঁর অনুভবে ছিল বাংলার স্বাধীনতা, ছিল শোষকদের কবল থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তি। তিনি তো চেয়েছিলেন সবার বাকস্বাধীনতা, অর্থনৈতিক শোষণমুক্তি, রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে বাঙালির ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা, সার্বিকভাবে সকল নাগরিকের কল্যাণময় জীবন। তাঁর এ চাওয়াটুকুই সহ্য হয়নি শাসকদের, তাদের এদেশীয় দোসরদের আর আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের চক্রান্তকারীদের। তারা পরিকল্পিতভাবে তার বিরূদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে। কিন্তু এতো ষড়যন্ত্র করেও পারেনি হিমালয়সম শির উঁচু করা মানুষটিকে নিঃশেষ করে দিতে।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ তাঁর এক লেখায় বলেছেন, বঙ্গবন্ধু কোনো দলের নয়, সবার- এটা আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে। যারা তাকে মানতে চায়নি, তারা বাংলাদেশকেও মানতে পারেনি। তাদের সংখ্যা কিন্তু একেবারে কম নয়। একাত্তরের পরাজিত শক্তিই পঁচাত্তরে জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করে দেশকে পেছনের দিকে ঘুরিয়ে দিতে চেয়েছে। সেই জায়গা থেকে আমরা আবার ফিরেছি প্রগতির পথে। আমরা এখন মধ্যম আয়ের দেশ। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, আরও এগিয়ে যাব। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই আমাদের অগ্রযাত্রায় মূল শক্তি। এটাকে আমরা যত ছড়িয়ে দিতে পারব, ততই আমাদের বিভাজন কমবে। রাজনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে সারাজীবন সংগ্রাম করে গেছেন বঙ্গবন্ধু। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত ‘সোনার বাংলা’ প্রতিষ্ঠাই ছিল তার স্বপ্ন। আমাদের দায়িত্ব হবে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করে একটি সুখী ও সমৃদ্ধ দেশ গড়ে তোলা। তাহলেই আমরা চিরঞ্জীব এই মহান নেতার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে পারব। (বাঙালির মুক্তির দূত/ আবদুল হামিদ, সমকাল, ১৫ আগস্ট ১৭)।

বঙ্গবন্ধুর জীবন মানে একটা অখণ্ড বই। সেই বই পাঠ করলে বোঝা যায়, তিনি কত বড় মাপের নেতা ছিলেন। তাঁর ‘বিশাল হৃদয়, মহানুভবতা, মানবতাবোধ, সততা, উদারতা, দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্ব, দেশপ্রেম, মানুষের প্রতি ভালোবাসা, কঠিন নৈতিকতা, বলিষ্ঠ নেতৃত্বের গুণাবলি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীনতা, অন্যের মতামতকে সম্মান দেওয়ার মানসিকতা, কথা ও কাজের মধ্যে স্বচ্ছতা’ ইত্যাদি আমাদের সবার অনুপ্রেরণার বিষয়। এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের পথ চলাকে মসৃণ ও গতিময় করা জরুরি। যত বেশি পড়ি, তত বেশি আমাদের বোধের মধ্যে নতুনভাবে তৈরি হয় বঙ্গবন্ধুর অস্তিত্ব। বুঝতে পারি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মানেই বাঙালির মৃত্যুঞ্জয়ী চেতনা। বঙ্গবন্ধু মানেই সাম্য-অধিকার-গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। দেশের জনগণের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিলো অকৃত্রিম ও অপরিসীম। তাঁর চিন্তা-চেতনায় সব সময় ছিলো তাঁর দেশের জনগণের কল্যাণ ও উন্নতি। সাধারণ মানুষের প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা ছিলো বঙ্গবন্ধুর অন্যতম মহৎ গুণ। মানুষের প্রতি তাঁর বিশ্বাসও ছিলো অবিচল। পাশাপাশি নিজের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসা তাঁকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলো। তিনি জাতিকে নানা সংকটে পথ নির্দেশনা দিয়েছেন, দিয়েছেন মুক্তি। তিনি বাঙালির ধ্রুবতারা, আলোর দিশারী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মানেই তো বাংলাদেশ, স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী

আরও পড়ুন

সর্বশেষ