শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪
প্রচ্ছদফিচার১/১১ র দুঃসহ স্মৃতি

১/১১ র দুঃসহ স্মৃতি

মেয়ে বলল ‘আমি আব্বুকে ভূলতে পারছি না।’ আমি বললাম, ‘আব্বু কি ভোলার জিনিস; কেন তাঁকে ভূলতে হবে?
ও’ বলল, ‘আমি তোমাকে বুঝাতে পারছি না।বললাম, আব্বুর জন্য তোমার কষ্ট হচ্ছে খুব ? ও বলল হু।

২০০৭ এর ২৩শে জানুয়ারি টিংকুকে যখন ধরে নিয়ে গেল,আমার মেয়ের বয়স তখন ৫ বছর।ও বলত, ‘আমি ছবির আব্বু চাই না,আমি আব্বুকে কাছে পেতে চাই।আব্বুর বুকে ঘুমাতে চাই, আব্বুর কোলে উঠে বেড়াতে যেতে চাই।ওরা কি জানে না আব্বুর ছোট্ট একটা মেয়ে আছে,ওর অনেক কষ্ট হচ্ছে’।সত্যিই তো ছোট্ট মেয়েটার কী দোষ?আমাদের ছেলেটার কী দোষ? টিংকুর ৮৫ বছর বয়সের যে মা তার কী দোষ ? আমার কী দোষ ? অকারণে কেন আমাদের শাস্তি পেতে হলো ?

১/১১ র মুল লক্ষ এবং অর্জনটা কি ছিল ???

২০০৭ এর ২৩শে জানুয়ারি রাত তখন ১টা হঠাৎ বিরতিহীনভাবে কলিং বেলের শব্দ।টিংকু তাড়াতাড়ি উঠে দরজা খুলে দিল।আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই দেখি কালোড্রেস পড়া আট দশ জন সশস্ত্র লোক আমার বেড রুমে ঢুকে পড়েছে।আমি তাড়াতাড়ি আমার নাইটির উপর একটা চাদর জড়িয়ে নিলাম।টিংকু ওদেরকে বলল,আপনারা বাইরে দাঁড়ান, আমার ওয়াইফকে কাপড় বদলাতে দিন।ওরা বিন্দুমাত্র নড়ল না।টিংকুকে না নিয়ে ওরা নড়বে না। টিংকু রেগে গেল।আমি ওকে থামিয়ে দিলাম।টিংকু ওদের সাথে নীচে নেমে গেল।

আমাকে একজন বলল,আপনাদের মোবাইলগুলো দিন।আমি সম্মোহিতের মতো সমস্ত মোবাইল ফোন তাকে দিয়ে দিলাম।হঠাৎ দেখি একজন আর্মি (সম্ভবত অফিসার) আমার ডুপ্লেক্স বাসার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে মোবাইল ফোনে চিৎকার করে বলছে, স্যার ধরে ফেলেছি। ভাব দেখে মনে হচ্ছে না জানি কত কষ্টসাধ্য কাজ করে ফেলেছে। আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না, ঠান্ডা গলায় বললাম, ধরে ফেলেছেন বলছেন ও তো পালানোর চেষ্টা করেনি, বীরদর্পে হেঁটে গাড়িতে উঠেছে। অফিসারটি অসন্তুষ্ট চোখে আমার দিকে তাকালো আমি পাত্তা দিলাম না।ওরা আমার শাড়ীর আলমারী দেখল, গহনা দেখল, ড্রেসিং টেবিল, বইয়ের আলমারী সবকিছু। একজন ড্রইং রুম থেকে একটি শোপিস তলোয়ার এনে বলল, পেয়েছি স্যার।অফিসারটি ধমক দিয়ে বলল, এটা শোপিস, রেখে আস।ওরা চারতলা শেষ করে তিন তলায় নামল।আমি দুই বাচ্চা নিয়ে বেড রুমে বসে আছি।সুযোগ বুঝে একজন উপরে উঠে এল। আমাকে এসে বলল, আপনার গহনা আর টাকাগুলো দিন, আবার দেখতে হবে।ঠিক এমন সময় একজন অফিসার তাকে বলল, ‘আমার অনুমতি ছাড়া আপনি এখানে এসেছেন কেন।নীচে নামুন।’ভেতরে ভেতরে আমি ভয় পাচ্ছি।আমি একা মেয়ে মানুষ।গভীর রাত।পুরো বাড়ীতে শ’খানেক কালোড্রেস পড়া লোক।আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে।একজন খুশীতে চিৎকার করে বলল পেয়েছি স্যার। মনে হলো নিউটনের মধ্যাকর্ষণ শক্তির মতোন কিছু আবিষ্কার করে ফেলেছে তারা।ওদের স্যার নামক লোকটি বলল, কি পেয়েছেন ? উত্তর এলো পিস্তল আর শর্টগান। আমি বললাম, লাইসেন্স আছে।

ওরা বলল, একতলা-দুতলার চাবি দিন আমি বললাম, ওটা জি-হাঞ্জের অফিস, চাবি আমার কাছে নেই। ওরা সমস্ত ফার্নিচার ভেঙে ফেলল। টিংকুর সাথে সাথে আমাদের ড্রাইভার,কাজের লোক,আমার বাসা ম্যানেজার, কয়েকজন মেহমান(রাউজান থেকে এসেছিল চিকিৎসা ও চাকুরীর জন্য)তাদেরকেও ধরে নিয়ে গেল।
আচ্ছা এতগুলো গরীব অসহায় লোকদের ওরা ধরে নিয়ে গেল কেন?ওদের কী দোষ?

আমি ভোর ৫টায় ফজরের নামাজ আদায় করে র‌্যাব-৩ এর অফিসে গেলাম, বাইরে বসে আছি।এমন সময় র‌্যাবের অফিসার সুলতান-ই-নুর এলো। প্রথমে কথা বলতে চাইলেন না, আমি নাছোড়বান্দা।আমি তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তিনি বললেন, আমার অনেক কাজ আছে। আমি বললাম, আমার বাসা আপনার এলাকার ভেতর। আমার স্বামীকে কে বা কারা ধরে নিয়ে গেছে আমি জানি না। আমি আপনার কাছে এসেছি সাহায্য চাইতে। এবার আমাকে ভেতরে ঢুকতে দিলেন।

আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। সকলের নিষেধ সত্ত্বেও আমি আপার সাথে দেখা করতে গেলাম। আমি আপাকে বললাম, ওরা টিংকুকে বলির পাঁঠা বানাচ্ছে। সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করতে চাচ্ছে। হলুদ সাংবাদিকদের দিয়ে যা খুশী তা লিখিয়ে ওর বিরুদ্ধে জনমত তৈরী করতে চাচ্ছে। আমি এখন কী করব? আপা আমাকে বললেন, “তোমাদের বঙ্গবন্ধু বছরের পর বছর জেল খেটেছেন, আর তুমি এত অল্পে ভেঙে পড়লে কী করে হবে?” আপা এরপর একটি সভায় বলেছিলেন, “কোন নির্দোষ ব্যাক্তি যেন শাস্তি না পায়”।

আমি বুদ্ধি নেয়ার জন্য মতিয়া আপার বাসায় গেলাম। বজলু ভাইও বাসায় ছিলেন। দু’জনে মিলে আমাকে বললেন, ‘মনে সাহস রাখো, আর কখনও কোন অবস্থাতেই নিজেকে দূর্বল মনে করবে না। এই মুহুর্তে তুমি দূর্বল হলে অন্যরা তোমাকে পেয়ে বসবে।’ পরে তাঁদের এই্ উপদেশ আমার চলার পথের পাথেয় হয়ে রইল।

একেকটি দিন যেন একেকটি মাসের সমান। বিকেল হলেই বুকটা কেমন ধর-ফর করতে থাকে। রাজ্জাক ভাই ফোন করলেন।বললেনে একজন মৌলভী সাহেব দিয়ে ৪০ দিন পর্যন্ত ইয়াছিন সূরা পড়ানোর ব্যবস্থা কর। ইনু ভাই টেলিফোন করলেন। বললেন, “মুন্নি প্রয়োজনে আমি তোমাকে নিয়ে সর্বোচ্চ জায়গায় যাব, চিন্তা করো না।আমি বললাম ‘আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে,আমি আর পারছি না’।

নীচের তলায় ড্র্ইং রুমে বিভিন্ন খতম চলছে। আমার হতে তসবিহ্। সবসময় আমি অজু রাখি, কখন কোন অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়, কে জানে।আমার ঘুম হয় না, প্রচন্ড মাথা ব্যথা। অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়ে ফেললাম্। তিন দিনের দিন আমার এক আত্মীয়ের মোবাইল ফোনে একটা কল এলো, বলল, এ রাতটা বড় কঠিন টিংকুর জন্য। কাল সকালে ওরা টিংকুর হার্ট ফেইলোর, স্ট্রোক অথবা ক্রস ফায়ার দেখাতে পারে। তোমরা সদকার ব্যবস্থা করো। তোমাদের নেত্রীকে জানা্ও, এদের টার্গেটের শীর্ষে তিনি। এরা ধীরে ধীরে ওনার দিকে অগ্রসর হবেন। হঠাৎ একটা চিরকুট।দুই কোট টাকা দিলে আমার স্বামীকে ছেড়ে দেবে।এত টাকা কোথায় পাব? টাকার জন্য সবাইকে ফোন করতে লাগলাম। ছাত্র লীগের নেতা সালাউদ্দিন শেলুকে সঙ্গে নিয়ে ব্যারিস্টার তাঞ্জিব এর সাথে দেখা করতে গেলাম। এরপর আবার চিরকুট,টাকার ব্যাপারটা সবাই জেনে গেছে,আমার টেলিফোন টাকা চাওয়া উচিত হয়নি।

এখন ১কোটি টাকা দিলে ওরা ওকে এমনভাবে টরচার করবে যাতে ওর কিডনি বিকল না হয়, অন্ধ না হয়। অর্থাৎ ১কোটি টাকার বিনিময়ে ওর সমগ্র অঙ্গ ঠিক থাকবে। আমি দিশা হারিয়ে ফেলালম। আমার স্বামীকে জিম্মি করে গোপনে টাকা চাইছে।

৭ দিন পর মাঝরাতে আমার ড্রাইভার মিশির আলী, ম্যানেজার বেলাল এবং রাউজানের লোকদের ওরা ছেড়ে দিল। আমি ওদের মুখোমুখি বসলাম। ওরা কাঁদতে লাগল। বলল, মধ্যযুগীয় কায়দায় চোখে কালো কাপড় বেঁধে টর্চার করেছে। ইলেকট্রিক শক দিয়েছে। ঘুমের ওষুধ খাইয়ে মুখের উপর হাজার ভোল্টের বাতি জ্বালিয়ে রেখেছে। মাথা নীচে পা উপরে দিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছে। আমি ভাবি,চোখে কালো কাঁপড় বাঁধে কেন? তবে কি ওরা ভয় পায়? ওরা কি জেনেশুনে অন্যায় করছে? ওরা ওদের উপর অকথ্য র্নিযাতন করেছে।ওদের সারা শরীরে কালো কালো দাগ।তবে জানলাম টিংকু বেঁচে আছে।

বাকী রাতটুকুন আমার চোখে আর ঘুম এলো না। পরদিন সবাইকে নিয়ে আমার বড় কালো গাড়িতে করে রওলা হলাম ড. কামাল হোসেনের চেম্বারের উদ্দেশ্যে। বুঝলাম আমার গাড়িকে ফলো করা হচ্ছে। ব্যারিষ্টার সারা হোসেনের সাথে দেখা করলাম।তাঁকে বললাম, এদের কী দোষ? এদেরকে নির্দয়ভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। এদের মামলা আপনাকে লড়তে হবে। সারা হোসেন রাজী হলেন। সন্ধ্যার একটু পরে ফোন এলো, কারা যে আমার ল-ইয়ারকে অনুরোধ করেছে মামলা না নিতে। ওরা নাকি দেশের ভালোর জন্য কাজ করছে। অল্পদিনের মধ্যে ওরা আমার স্বামীকে ছেড়ে দিবে। সত্যিই কি দেশের ভালোর জন্য করছে। আমি মনে মনে খানিকটা আশ্বস্ত হলাম।

দু-দিন পর আখেরি মোনাজাত, আমার সাথে লাকি আপা, দুলাভাই ।আমরা উত্তরায় একটি ছয়তলা ভবনের ছাদে উঠে মোনাজাত করলাম। কে যেন কুড়িয়ে পাওয়া একটি খবরের কাগজ পড়ে শোনাচ্ছে। নাজমুল হুদা, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, তৈমুর আলম খন্দকার, গিরিলাল মোদি, সালমান এফ রহমান, মোহাম্মদ নাসিম, পঙ্কজ দেবনাথ, আওলাদ হোসেন, নুরুল ইসলাম বাবুলসহ আরও অনেক কে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাঁরমানে আমাদের সাথে আরও অনেকে আছে । আমাদের শেষ এদের শুরু।

আমাদেরকে এতদিন অনেকে অনেক কথা বলেছে, এখন? সেই রাতেই টিংকুকে আমাদের মগবাজার বাসায় নিয়ে এলো। তারপর ক্যান্টনমেন্ট থানায়। সেখান থেকে সুপ্রিম কোর্ট। এই প্রথম আমার সুপ্রিম কোর্টে আসা। প্রচন্ড ভিড় ঠেলে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। এর মধ্যে বিভিন্ন দিক থেকে তির্যক মন্তব্য কানে আসে “চোরের বউ।” বুঝলাম সবই সাজানো।টিংকু বলল, মূলত তত্ত্বাবধায়কের মুখোশের আড়ালে দেশ চলছে অঘোষিত সামরিক শাসন। সরাসরি সামরিক শাসন এলে সেনাবাহিনীরা জাতিসংঘ সুযোগ পেত না। এ জন্যই ১১ই জানুয়ারিতে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ঘোষিত হয়েছে। কেউ হয়তো আমাকে ৯০এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় থেকেই টার্গেট করে রেখেছিল। টিংকু আমাকে বলল, চিন্তা করো না, হাবিয়া দোযখ থেকে এলাম, এটা বেহশত। এখান থেকে ওদের কে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে নেয়া হলো। জেলে ওকে ৭নং সেল বকুলে থাকতে দেয়া হয়েছে। টিংকুর সাথে দেখা হবে না। আগে এসবি ক্লিয়ারেন্স লাগবে। মালিবাগে এসবি অফিস। ওখান থেকে ক্লিয়ারেন্স বের করতে লাগবে তিন দিন।
জেল খানা থেকে টিংকু প্রেশার মাপার মেশিন আর জাম্বাকের কৌটা চেয়ে পাঠালো।লোক মুখে জানালাম রাজ্জাকের প্রেশার ফ্লাকচুয়েট করছে, ওর সমস্ত গায়ে প্রচণ্ড ব্যথা। প্রতিদিন চকির উপর ওকে রোঁদে শুইয়ে গভীর মমতা মাখা হাতে টিংকু নাকি ওর সমস্ত শরীরে জাম্বাক মেখে দেয়।

এর মধ্যে ছাত্রলীগের অর্পণা আমাকে বলল, চিন্তা করবেন না। আমি সব ব্যবস্থা করে দিব। শুরু হলো আমাদের চিঠি চালাচালি। টিংকু আমাকে লিখল, বড় ১টা ফ্রিজ, ৪২ ইঞ্চি টেলিভিশন, ১টা মাইক্রোওভেন, ১ টা বড় টেবিল ফ্যান, ১টা রেডিও ও কফি মেকার সহ হাড়ি, পাতিল, প্লেট, গ্লাস, চামচ পাঠাতে। আমি লিখলাম, ‘সময় স্রোত দুটোই উল্টো দিকে বইতে শুরু করেছে। বর্তমান ক্ষমতাশীনদের মানুষ ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নিচ্ছে, দেশের ‘সুশীলরা’ও ওদের সঙ্গে আছে। চারদিকে সৎ-যোগ্য ও ত্যাগী মানুষদের জয়-জয়কার! এখন একটু সংযত হও। দুদিন পর আমার টিংকু’র সাথে দেখা হলো। খানিকটা শুকনো মনে হলো। আমাদের তিনজন কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল, বলল, অনেক অত্যাচার করেছে আমাকে বিনা কারণে। আমি নির্দোষ। এরা কি করতে চাইছে কেন চাইছে ওরা নিজেরাও জানেনা। ওদের মাথায় কোন বুদ্ধি নেই, হোমওয়ার্ক নেই।ওরা ডেবিট কার্ড ও ক্রেডিট কার্ডের পার্থক্য বুঝেনা। খুব অল্প সময়ে দেশের মানুষের স্বপ্ন ভঙ্গ হবে। দেশের মানুষ ওদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে উঠবে। আধাঘন্টা শেষ। আমাদের চারদিকে লোক দাড়িয়ে পাহাড়া দিচ্ছে। কি করছি দেখছে কি বলছি শুনছে।

দ্বিতীয় বার দেখা করার জন্য আর একমাস অপেক্ষা করতে হবে। আমি অফিসে যাওয়া শুরু করি। পঙ্কজ দেবনাথের স্ত্রী মনিকা মনোয়ারা ক্লিনিকে ভর্তি। অতিরিক্ত মানসিক চাপে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাই সময়ের আগে সিজারিয়ান অপারেশন করতে হচ্ছে। আমি ক্লিনিকে গেলাম। মনিকা কাঁদছে ওর সাথে দিদি, আমি আমরা সবাই কাদঁছি আমাদের কষ্ট এক, কান্না এক। আমরা একে অপরের কষ্টের আত্মীয়। এই মুহুর্তে যে শিশুটির জন্ম হবে তার চারদিকে প্রতিকূল পরিবেশ। দ্রোহের আগুন কি শিশুটিকে স্পর্শ করছে, আমি মনে মনে ভাবি। ফুটফুটে একটা মেয়ে হলো, মেয়েটির বাবা এখন জেলে। কবে দেখা হবে ওর বাবার সাথে?

পারিশা ট্রেড সিস্টেমে ওদের সাথে আরও দুজন পার্টনার হচ্ছেন আজিজুল হক আরজু আর শাহাবুদ্দিন মোল্লা। তাঁরা ঠিক করলেন অফিসের চেয়ারম্যান আমি থাকবো, টিংকুর কাছ থেকে পাওয়ার অফ এটর্নি সিগনেচার করে আনা হল। আমি অফিসের কিছু জানি না বুঝিও না আমি নিজে ওদের ব্যবসার সাথে কোনভাবেই সম্পৃক্ত নই। কিন্তু এই খারাপ সময়ে ফেস করার জন্য আমাকেই বেছে নিলেন সবাই ।

চারিদিকে থমথমে পরিবেশ আমার ভীষণ মন খারাপ। একদিন এস এম কামাল হোসেন ভাই অফিসে এলেন, হাতে কিছু কাগজপত্র। বিষাদগ্রস্থ চেহারায় দুঃখ করে বললেন, ” ভাবী কখন কি হয় জানা নেই, চেনা জানা পরিচিত সকলেই জেলের ভেতর। ধানমণ্ডির ফ্ল্যাটটি ছাড়া আমার কোন সম্পদ নেই কিন্তু আমার টিন সার্টিফিকেট নেই। টিন সার্টিফিকেটের গুরুত্ব আগে এভাবে বুঝিনি।”
কামাল ভাই আমাদের আত্মার আত্মীয়, অতীব কাছের মানুষ। কোম্পানির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব এখন আমার। টিন সার্টিফিকেটের জন্য আমার সিগনেচারই এখন যথেষ্ট।

দ্বিতীয়বার টিংকুর সাথে দেখা করতে গেছি, ওর খুব মন খারপ। বলল আমাকে ভীষণ চাপ দিচ্ছে জলিল ভাই আর কাদের ভাই এর নামে মামলা দিতে। আমি জিজ্ঞেস করলাম তুমি কি ঠিক করেছো? ও বলল, আমি ওদের কে বলে দিয়েছি ওনারা আমার নেতা। প্রয়োজনে জীবন দেব, কিন্তু মামলা করার প্রশ্নই আসেনা। তৃতীয়বারের মতো আমি টিংকুর সাথে দেখা করতে গেলাম, এবার অনেক বই নিয়ে এসেছি, বেশির ভাগই উপন্যাস। ও আমাকে বলল একটা ডিভিডি সেট আছে আমাদের কাছে। নতুন হিন্দি সিনেমা, আর বাংলা সিরিজ নাটক এর সিডি পাঠাও। ৭ নম্বর সেলে নতুন সদস্য যুগান্তরের বাবুল ভাই, জনকন্ঠ এর আতিকুল্লাহ খান মাসুদ ভাই। বাবুল ভাইকে থাকতে দিয়েছে টিংকুর রুমে আমি বললাম তুমি বাবুল ভাই এর সাথে কথা বলবেনা। ওনার পত্রিকায় সবচেয়ে বেশি আজে বাজে কথা লিখেছে তোমার সম্বন্ধে। টিংকু বলল ওনার উপর চাপ ছিল।না লিখে উপায় ছিলনা।

আমি বললাম, দুই নেত্রীকে নাকি ভেতরে ঢোকাবে; ঢাকা শহরে জোর গুজব ছড়াচ্ছে। দুই নেত্রীর মুখোশ পরে গানের সাথে এনিমেশন করে মোবাইল ফোনে ফোনে তাদেরকে বিদ্রূপ করা হচ্ছে। টিংকু বলল,‘বড় দুই দলের লোক ছাড়া অর্ধশিক্ষিত লোক দিয়ে দেশ চালানোর চিন্তা কোন উর্বর মস্তিষ্ক থেকে আসেনি, এরা দেশটার সর্বনাশ করে ছাড়বে’।

চতুর্থবার টিংকুর সাথে দেখা করতে গেলাম, সাথে নিয়ে গেছি হাজীর বিরিয়ানী। এসবির লোক বলল, আপনি খেতে পারবেন না। টিংকু রেগে গেল। স্বভাবসুলভ চিৎকার করে বলল, অন্যরা যখন খায় তোরা কি তখন চোখ বন্ধ করে রাখিস? ওর আর বিরিয়ানী খাওয়া হলো না।

৭নং সেলটি একটা পুরনো বাড়ির মতন। পাশাপাশি কতগুলো রুম। ঘরের ছাদটা টিন দিয়ে করা। একটা মস্ত উঠোন। উঠোনের একদিকে পানি ধরে রাখার জন্যে আয়তাকার একটা চৌবাচ্চা। চারিদিকে ছোটবড় গাছ। ৭ নম্বর সেলের পাশে রাস্তা।রাস্তার অপর পাশে ৫ তলা গারমেন্টস।আমরা ৪ তলায় উঠলে ওদেরকে দেখতে পেতাম। জেলখানায় ওদেরকে দেখতে খাঁচার পাখির মত মনে হতো। যতবার ৪ তলায় উঠেছি ততবারই মন খারাপ হয়েছে। তারপরও যেতাম। না যেয়ে থাকতে পারতাম না।

পঞ্চমবার যখন দেখতে গিয়েছি তখন টিংকুকে খুব হাসিখুশি দেখাচ্ছিল। ওদের সেলে নতুন যোগ হয়েছে আব্দুল আওয়াল মিন্টু, আবুল খায়ের লিটু, মীর নাসিরের ছেলে মীর হেলাল, টুকু ভাইয়ের ছেলে আবিদ। পুরনোদের মধ্যে আছে গিরিলাল মোদী, তার ভাই গিরিশলাল মোদী, পঙ্কজ দেবনাথ, আওলাদ হোসেন, মাহমুদ হাসান বাবুল, তৈমুর আলম খন্দকার, কাইয়ুম, কায়েস সামী, মুন্সী আনোয়ার, মোঃ রাজ্জাক, হাসেম চেয়ারম্যান আর হাসান। টিংকু বলল, একটি টেবিল ও ছয়টি চেয়ার পাঠাতে হবে। চিন্তা করো না দেশের সমস্ত বড়লোকরাই এখন জেলের ভেতর। ওরা নিজেরাই কনফিউজড। ত্রাস সৃষ্টি করার জন্যেই সবাইকে জেলে পুরছে। ওরা দেশে ভয়ের শাসন কায়েম করতে চাচ্ছে। যে মামলাগুলো দিচ্ছে এগুলোর একটিও ধোপে টিকবে না। সব সাজানো মামলা। ওরা সন্ধ্যা হলেই মদের বোতল খুলে বসে আর মওদুদ সাহেবকে দিয়েছে মদের মামলা!ও হা হা করে হাসতে লাগল। প্রান খোলা হাসি। হঠাৎ ব্যতিব্যস্তভাবে আমাকে বলল, আমরা জেলখানার মসজিদটা সংস্কার করছি। অফিস থেকে টাকা পাঠিয়েছে। আমার রুমে হাই কমোড লাগিয়েছি। জেলখানাটা অনেক পুরানো।সংস্কার করা প্রয়োজন। আমি বুঝলাম টিংকু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে।

জেলখানার কিছু লোককে বলা হয় ‘ফালতু’। ফালতুরা প্রচন্ড গরিব। অনেকের যাবজ্জীবন কারাদন্ড। ওরা জেলখানায় বড়লোকদের কাজ করে পয়সা আয় করে বাড়িতে পাঠায়। ৭ নং সেলে ফালতু’র কোন অভাব ছিল না। আর কারারক্ষীদের বলা হয় ‘মিয়া সাহেব’। জেলখানায় সময় কাটে না। এ জন্য সমান তালে চলে ধর্ম-চর্চা আর রূপ-চর্চা। ছেলেরাও মাথায় মেহেদী লাগায় আর মুখে মাস্ক। সেই সাথে চলে ধর্ম-কর্ম। গিরিদা, গনেশদা আর পঙ্কজদা একসাথে পূজো করে কাক কে খাবার ছিটাতো।

মিন্টু ভাই, লিটু ভাইসহ অনেকে সকালে হাঁটতে বের হতেন। এটা শুনে আমি টিংকুকে দশটি হাফ প্যান্ট আর তিন জোড়া কেডস কিনে দিয়েছিলাম হাঁটার জন্য, কিন্তু ও হাঁটেনি। আবিদ নিয়মিত ব্যায়াম করত। শুক্র ও শনিবার ছাড়া যে কোন সরকারি ছুটির দিনে আমরা জেলখানায় খাবার পাঠাতে পারতাম। একজনের জন্যে খাবার পাঠানোর নিয়ম। কিন্তু আমার প্রত্যেকেই এতো খাবার পাঠাতাম যাতে বিশজন লোক অন্তত সাতদিন কেতে পারে। আমি পরের দিকে বুঝেছিলাম পাঠানো কাবার ওদের হাতে পৌছার আগে হাত বদল হয়ে যেত। একবার আমার পাঠানো খাবার আটকে দিল।

আমি শামসুল হায়দার চৌধুরীকে ফোন করে বললাম, জুয়েল ভাই আমার খাবার ভিতরে পাাঠাচ্ছে না। উনি বললেন, দুই মনের উপর খাবার পাঠিয়েছ, ১টা লোক কী করে এত খাবার খাবে আমি বললাম এবারই শেষ। জেলখানায় খাবারগুলোকে প্রথমে ওরা ফ্রিজ করে ফেলত। তারপর একেকদিন একেক খাবার ওভেনে গরম করে খেত। অন্যদেরকেও খাওয়াত।

ষষ্ঠবার গিয়ে দেখি ওকে কেমন যেন অস্থির মনে হচ্ছে। টিংকু বলল, ক্ষমতাসীনরা দেশের পূঁজিপতিদের ধরে এনে এলোপাথাড়ি মামলা দিচ্ছে যে গুলোর কোন ভিত্তি নেই। কিন্তু এর ফলে পুঁজিপতিরা দেশে বিনিয়োগের পরিবর্তে বিদেশকেই নিরাপদ মনে করছে। এ টাকা দিয়ে দেশের লাখ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হতে পারতো, দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন তথা সার্বিক পূঁজির বিকাশে তা বিরাট ভূমিকা রাখতে পারত। কিন্তু এখন সব টাকা অন্ধকার পথে বিদেশে পাচার হয়ে যাবে ওরা কি বুঝতে পারছে না যে দেশের কত বড় ক্ষতি ওরা করছে? অর্থনৈতিকভাবে দেশটাকে পঙ্গু বানিয়ে ফেলছে। পঙ্গু দেশকে অন্যদের উপর নির্ভর করা ছাড়া আর কোন গত্যন্তর থাকবে না।

সপ্তমবার যখন দেখা করতে যাই তখন ওর ডিভিশন হয়েছে কিন্তু ও অন্য কোথাও যাবে না। ৭নংসেলে থাকতে থাকতে কেমন একটা মায়া জন্মে গেছে। এই সেলের বেশীরভাগ বন্দীই ভিভিশন পেয়েছে। কিন্তু ওরা কেউ যাবেনা। এখানে ওরা একে অপরের কষ্টের আত্মীয়। সমস্ত অপমান অবমাননা, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের সাক্ষী। সেলে নতুন যোগ হয়েছে ইকবালুর রহিম। ও টিংকুকে খবর পাঠিয়েছিল টিংকু যেন ওকে ৭নং সেলে নিয়ে আসে।

ডিআইজি শামসুল হায়দার চৌধুরীর ডাক নাম জুয়েল। জামালপুরে একই পাড়ায় আমাদের বাসা। এ ছাড়া আমার ভাইয়ের জিগরী দোস্ত। জামালপুরে আমরা একসাথে বড় হয়েছি। এই সুযোগে আমি ওনার কাছে প্রায়ই অনেক আবদার করতাম। তার একটি ছিল ইকবাল ভাইকে ৭নং সেলে নিয়ে আসা। টিংকু বলল, ‘ইকবাল সারাদিনই কান্নাকাটি করছে ওর মনটা বড় নরম। ইকবালকে ওরা চাপ দিচ্ছে বাহাউদ্দিন নাসিমের বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য। ইকবাল ওর বউ আর তিনটি ছোট ছোট বাচ্চার কথা ভেবে রাজি হয়ে যাচ্ছে। আমি ইকবালকে ভয় দেখিয়েছি, তুই মামলা করলে রাতের বেলা তোকে বালিশ চাপা দিয়ে মেরে ফেলব। এখন ইকবাল আরও বেশী কান্না কাটি করছে’।
এবার আমার পঙ্কজদার সাথে দেখা হলো। উসকো-খুশকো চুল। চোখ দুটো জবা ফুলের মতো টকটকে লাল, পরনে পুরনো ময়লা পাঞ্জাবী। বলল ভাবী দুর্নীতিবাজ হয়ে গেলাম, তাও আবার প্রথম ৫০ জনের মধ্যে। ওর চোখ গড়িয়ে পানি পড়তে লাগল। আমি বললাম ধৈর্য ধরেন ওরা বেছে বেছে তাদেরকেই ধরছে যারা প্রতিবাদ করতে জানে আপনি ভাল সংগঠক। এইজন্য আপনাকে বেশী বেশী পচনোর চেষ্টা করছে। পঙ্কজদা বলল, জানেন আমার বাচ্চাদের দুধ কেনার পয়সা নাই অথচ ওরা মনিকার বিরুদ্ধেও মামলা করেছে। মনিকা কে দুটি বাচ্চা নিয়ে ১৩ মাইল হেটে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে হয়েছে।

পঙ্কজ দেবনাথকে মালির কাজ দেয়া হয়েছে। কিন্তু ৭নং সেলের সবাই ওর সাথে এই কাজটি করত। এতে ওরা প্রচুর আনন্দ পেত।

অষ্টমবার যখন আসি তখন আমাদেরকে বসতে বলে টিংকুকে খবর পাঠিয়েছে। আমাদের পাশের চেয়ারে আমানুল্লাহ আমান ও তিনটি ছেলে-মেয়ে ওরা ওদের বাবার সাথে দেখা করতে এসেছে। আমি আমার বাচ্চাদের বললাম, দেখ, ওদের বয়সও তোমাদের মতন কিন্তু ওদের বাবা-মা দুজনই জেলে। টিংকু এলো। সাথে আবিদ।আবিদদের আজ পূর্নমিলনী। ওর মা আর সারাও আসবে। ওদের তিনজনের আজ দেখা হবে। সারা ২০-২২ বছরের একটি মেয়ে। যে বয়সে মানুষ পুরো পৃথিবী দাপিয়ে বেড়ানোর স্বপ্ন দেখে সে বয়সে ও জেলখানার চার দেয়ালে বন্দি। মেয়েটির চোখে মুখে অজানা এক আতঙ্ক। কী অপরাধ মেয়েটির? বাবা যদি কোন অন্যায় করে থাকে তার সাজা তার স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে কেন পেতে হবে? ওরা কি আলাদা সত্তা নয়? টিংকু বলল, আবিদ খুব মন খারাপ করে থাকে। বিশেষ করে ওর বোনটার কথা ভাবে বলে, চাচা আমার বোনটার বিয়ে হবে না। ওদের আরেক সঙ্গী ব্যারিষ্টার হেলাল সান্ত্বনা দিয়ে বলে চিন্তা করিস না, তোর বোনের যার সাথে বিয়ে হবে ওরাও নিশ্চয়ই এখন জেলাখানায় আছে ওরা জেলখানায় বসে বসে দুষ্টুমি করে নিজেদের ছেলে মেয়ের বিয়ে ঠিক করে নিজেদের মধ্যে।

নবমবার যখন যাই টিংকু নীচের দিকে তাকিয়ে আছে কথা বলছে না।খানিকটা চিন্তিত দেখাচ্ছে।আমি বললাম শরীর খারপ?ও উত্তর দিল না। বলল, এতদিন হয়ে গেল কোন মামলা দিতে পারল না, তুবও আটকে রেখেছে। দুই নেত্রীকে ওরা সাবজেলে রেখেছে। কিন্তু এরপর কী করবে সে ব্যাপারে ওদের কোন নির্দেশনা নেই। দেশের সমস্ত মেধাকে জেলে বন্দি করে ওরা কী করতে চাইছে সেটা তারাই ভালো জানে। আমি বুঝলাম জেলের চার ধেয়ালে ও হাপিয়ে উঠেছে। তবে নতুন একটা ঘটনা হলো, ও আমাদের তিনজনের জন্য তিনটি শেফালি ফুলের মালা এনেছে। নিজ হাতে গেঁথে। আমার মেয়ে মালা পেয়ে খুব খুশী হলো।

ওয়ান-ইলেভেনের কুশীলবরা নতুন একটা ইস্যু বের করেছে ইয়াবা সুন্দরী। রাত বিরাতে ওরা সুন্দরী মেয়েদের বাড়িতে হানা দেয়। সুন্দরী মেয়েরা কি শুধু গভীর রাতেই ইয়াবার ব্যবসা করে! নাকি ক্ষমতার উম্মক্ততায় ওরা যা খুশী তাই করছে। এই সুযোগে ওরা না জানি কত মেয়ের ঘর ভাঙছে, কত মেয়ের সর্বনাশ করছে। আমরা সবাই নিশ্চুপ, প্রতিবাদের ভাষা আমরা হারিয়ে ফেলেছি। কারণ ওরা বিধাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।তারা সকল প্রশ্নের উর্ধ্বে, সকল জবাবদিহিতার উর্ধ্বে। ওরা নিজেদেরকে একেকজন বিধাতা মনে করছে। এদের চোখ আছে, কিন্তু দূরদৃষ্টি নেই। কান আছে কিন্তু মানুষের বুকফাটা আর্তনাদ সেখানে পৌছায় না। মুখ আছে কিন্তু চিন্তার গভীরতা না থাকায় সঠিক বাক্যটি বেরিয়ে আসতে পারে না। মন আছে কিন্তু মস্তিস্কের সাথে সমন্বয়হীনতার কারণে সঠিক সিদ্ধান্তটি সে গ্রহন করতে পারে না। তাদের আবেগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে ইগোর কাছে। ওদের সাধ আছে সাধ্য নেই। সবচেয় বেশী যেটা নেই তা হচ্ছে নিজেদের ক্ষমতা এবং দৌড় সম্বন্ধে সু স্পষ্ট ধারণা। নিজেদের সীমাবদ্ধতা নিয়ে ওরা একবারেই অজ্ঞ।

ওরা সবকিছু লেজেগোবরে করে ফেলেছে। গ্রাম এবং মফঃস্বল শহরগুলোতে বিভিন্ন অজুহাতে বাড়ি– ঘর ভাঙছে, দোকান-পাট ভাঙছে, হাট-বাজার নষ্ট করছে। দেশের কোথাও দুর্নীতি কমেনি কিন্তু রেইট বেড়ে গেছে। দেশে চলছে নীরব দুর্ভিক্ষ। অর্থনৈতিক মন্দার চাপে মানুষের নাভিশ্বাস উঠে গেছে তার উপর আবার র‌্যাংগস ভবেন চাপা পড়ে এতগুলো হতভাগ্য দিনমজুরের মৃত্যু। মৃতদেহগুলো সরানোর ব্যবস্থা পর্যন্ত হচ্ছে না। আত্মীয়-স্বজনের সামনে দিনের পর দিন বীভৎসভাবে চাড়া পড়ে আছে। কেন? ওরা গরিব বলে এই কি সু-শাসনের নমুনা?
কোথায় আছে দেশের তথাকথিত সুশীল সমাজ? মাত্র কিছুদিন আগে যে ক্ষমতাসীনদের তারা ফুলের মালা দিয়ে বরণ করেছিল আজ সেখানে শুধুই ধিক্কার। আড়ে-ঠাড়ে শোনা যাচ্ছে সেনাবাহিনীতে ও নাকি প্রচন্ত অসন্তোষ। এক দল দুই হাতে টাকা কামাচ্ছে, ওদের বউরা শপার্স ওয়ার্ল্ড, ভাছাভিতে গিয়ে শাড়ি কিনছে, জড়োয়া হাউস, ডায়াগোল্ড, ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড এ গিয়ে গহনা কিনছে। অন্যরা ঘরে বউদের তোপের মুখে আছে বাইরে সর্বগ্রাসী হতাশা তাদের গ্রাস করে রেখেছে।

আগষ্ট মাস। অফিসে মনিটরের দিকে থাকিয়ে বাজার পর্যবেক্ষণ করছি হঠা দেখি নিম্নমুখি প্রবণতা। কোন কারণ নেই। পুঁজিবাজার নীতি-নির্ধারনে কোন পরিবর্তন আছে বা আসছে বলেও আমার জানা নেই। তাহলে কি দেশের অবস্থা খারাপ? অজানা আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে উঠল। রকিব ভাইকে ফোন করলাম। রকিব ভাই বলল, বাসায় চলে যান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গোলমাল হয়েছে। খেলার মাঠে ছাত্রদের সাথে আর্মিদের। ১৪৪ ধারা জারী হতে পারে। পথ-ঘাট সব ফাঁকা। যে যেদিক পারছে ছুটে পালাচ্ছে। আজ আমার গাড়িতে উঠতে ইচ্ছে হল না। রিক্সায় বাড়ি ফিরবো। ‘আহ!’ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। নিজের ভিতর কেমন একটা প্রশান্তি অনুভব করলাম। ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয় দফা, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১’র স্বাধীনতা যুদ্ধ, ৯০ এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সবকিছুর সূতিকাগার এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সময়ের সাহসী সন্তানেরা দেশের প্রয়োজনে ঠিকই গর্জে উঠেছে। প্রতিবাদ করছে। প্রতিরোধের চেষ্টা করছে। ওদের এই আন্দোলনকে স্বাগত জানিয়ে দেশের সর্বস্তরের মানুষ এতে শামিল হলো। চলল তিন দিন ব্যাপী কারফিউ। ওদেরও মনে হয় টনক নড়ল। দেশের মানুষ অত্যাচারে অতিষ্ঠ। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছাড়া অন্য কোন শাসন তারা চায় না। এই অকাট্য সত্য কথাটি হয়তো ওরা অনুধাবন করতে পারছে। এই এক বছরে একাধারে ভয়াবহ ভূমিধ্বস, প্রচন্ড খরা, বন্যা, তীব্র গরম ও তীব্র শীত।তার উপর সিডরের মহাদুর্যোগ। ভুক্তভোগীরা সবাই বলছে প্রকৃতির প্রতিশোধ।

‘আমাদের সময়’ পত্রিকায় একটা খবর বের হলো। ‘শেরাটন’ এর সামনে বাস পোড়ানোর মামলায় নেত্রীসহ আরো অনেকের সাথে টিংকুকেও আসামী করা হবে। রাতেই আমার মোবাইলে প্রাইভেট নাম্বার থেকে ফোন এলো। ঐ প্রান্ত থেকে বলল, ‘আপনার স্বামীর অপকর্মের সমস্ত ভিডিও আছে আমাদের কাছে। আর বাস পোড়ানোর মামলায় তার ফাঁসি হওয়ার সম্ভাবনা’। আমি উত্তর দিলাম, ‘কোন সমস্যা নেই, আপনাদের ভিডিও দিয়ে যা খুশি করতে পারেন। আর বাস পোড়ানোর কথা বলছেন, টিংকু তখন দুই মাস দেশের বাইরে ছিল, পাসপোর্টে সীল আছে, আমি প্রমান করতে পারবো’। চারদিক থেকে টাকার চাপ। কোথায় পাব আমি এত টাকা? জাতীয় চার নেতার মত জেলের ভেতরে সবাইকে ওরা ব্রাশ ফায়ার করে মারবে। নয়তো গ্রেনেড হামলা করবে। আমি ভীষণ ভয় পাচ্ছি। জুয়েল ভাইয়ের কাছে গেলাম। জুয়েল ভাই বলল, আমার জীবন থাকতে জেলের ভিতর কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটার প্রশ্নই ওঠে না। আমি নিশ্চিন্ত হলাম।

এর মধ্যেই রাজ্জাক কিভাবে যেন ছাড়া পেয়ে গেলো। বদিউজ্জামান বদি আমাকে বলল, ”আপনি তো পারলেন না, রাজ্জাক ভাইয়ের স্ত্রী তাঁকে আগে আগে ছাড়িয়ে আনতে পারলো ঠিকই । ওর কথার আগা মাথা কিছুই আমি বুঝলাম না। দুজনকে একই সাথে ধরেছে, একসাথেই তো ছাড়ার কথা ছিল ।

কয়েকদিন পর ঈদুল ফিতর। জেলখানায় লুকোনো মোবাইল ফোন থেকে ফোন দিয়ে প্রথমে জানালো রাজ্জাক নাকি জেল থেকে বের হয়েই তিন বাচ্চা আর স্ত্রী সহ আব্দুল আওয়াল মিন্টু সাহেবের বাসায় দেখা করতে গিয়েছিল। জানতো না উনার শরীর খারাপ বিধায় ঘুম থেকে দেরী করে উঠেন।বাইরের কারো সাথে দেখা করতে অস্বস্তি বোধ করেন। ড্রইংরুমে ৫ ঘণ্টা অপেক্ষার পর অবশেষে দেখা মিলল।
মিন্টু ভাই তাঁকে জানালেন নতুন কোন ব্যবসা শুরু করতে তিনি আগ্রহী নন এই মুহূর্তে ।

এরপর টিংকু খুশী মনে জানতে চাইল রাজ্জাকরা কবে এসেছিল আমাদের বাসায়, শ্রেয়া-ধ্রুবকে ঈদে কি কি উপহার কিনে দিয়েছে ? আমি উত্তর দিলাম আসেনি তো, শুনেছি আমাদের বাসার আসে পাশে গোয়েন্দা থাকতে পারে ভয়ে আসেনি। টিংকু বলল তবে মিন্টু ভাইয়ের বাসায় যে গেলো ? আজ ঈদের দিন, টিংকুর সন্তানদের জন্য কোন নতুন কাপড় নেই, নেই কোন উপহার ।

১০ই জানুয়ারী, ২০০৮ এ টিংকুকে ছাড়ার পর পুনরায় নাটকীয়ভাবে এরেস্ট করে জেলে রাখা হলো। এবার টাকার চাপ আরও দিগুণ। কিন্তু আমার পক্ষে সম্ভব না। শেষ পর্যন্ত ১০ই ফেব্রুয়ারী, ২০০৮ ও ছাড়া পেল।

একদিন পারিসা অফিসের কয়েকজন সাব কনট্রাক্টর বাসায় টিংকুর সাথে দেখা করতে এসে রাজ্জাকের দুই মাস আগে বের হওয়ার পেছনের বিশাল লেনদেনের কাহিনী শুনাল। টিংকু ভীষণ কষ্ট পেলো, একসাথে এক সেলে থাকার পরেও এই তথ্যটি তাঁর অজানা। ডিভিশন পাওয়ার পরেও অন্য কোথাও যায়নি রাজ্জাক একা একা ভয়ে থাকবে বলে। টর্চার সেলে টিংকু চিৎকার করে আবেদন করেছিল, ”রাজ্জাক অসুস্থ ওর পরিবর্তে আমাকে যত পারুন অত্যাচার করুন। কারণ এই অত্যাচার ও’ নিতে পারবে না।” অথচ টিংকুকে গোপন করে একাই বেরিয়ে এলো ।

মাঝে মাঝে চিন্তা করি মানুষ এতো বেঈমান, স্বার্থপর কি করে হয় ? একবারও কি বিবেকের দংশন হয় না ?

সেদিন রাতে টিংকু কান্নায় ভেঙ্গে পরে বলল রাজ্জাক কে আমি সবসময় বুক দিয়ে আগলে রেখেছি, আমার সাথে এমনটি কি করে করতে পারলো ?

নতুন করে শুরু হলো মেজর জাকিরের অত্যাচার। দিন নেই রাত নেই আমার মোবাইলে ফোন করে টিংকুকে দেখা করতে বলে। টিংকু দেখা করে এলো।

ওর প্রচণ্ড মাথা ব্যাথা। বলল, ‘আমি আর পারছি না’।ভিসা করা ছিল। আমি পরদিন ওকে আমেরিকা পাঠিয়ে দিলাম। দীর্ঘদিন বিদেশ থাকার পর একসময় ও ফিরে এলো। পুরো শরীর চেকআপ করিয়েছে শুধু মাথা ছাড়া। ২০০৮ এর ডিসেম্বরে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হলো। দেশে দিন বদলের হাওয়া লেগেছে। দেশের সামনে ‘ভিশন ২০২১’। ডিজিটাল বাংলাদেশ হবে। সবকিছুর পরিবর্তন হবে। উন্নত থেকে উন্নততর হবে।ভালো থেকে ভালোতর হবে। কিন্তু ভালো যাছে না টিংকুর শরীরটা। ওর মন মেজাজ চিন্তা-চেতনা ব্যক্তিত্ব কোন কিছুই আর আগের মত নেই। কেমন একটু এলোমেলো।

মাঝে মাঝে ভয় হয়, আবার ভাবি অত বড় একটা ধকল গেছে পরিবর্তন হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু পরিবর্তনটা যে এতো বেশি হয়ে গেছে ঘুনাক্ষরেও টের পাইনি। টর্চার সেলে ওকে যে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছে, ইলেকট্রিক শক দেওয়া হয়েছে তার ফলস্রুতিতে ওর ব্রেইনের কোষ মিউটেশন হয়ে টিউমার, টিউমার থেকে ক্যান্সারে রূপ নিয়েছে। পরিনাম ২০১২র ৮ই ফেব্রুয়ারীতে ওর অকাল মৃত্যু। আমি এখন কার শাস্তি চাইব? কার কাছে চাইব? কি অপরাধ ছিল টিংকুর? কেন ওকে এভাবে মেরে ফেলা হল ??

লেখকঃ খুজিস্তা নূর-ই–নাহারিন (মুন্নি), কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ডা. জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু এর স্ত্রী

আরও পড়ুন

সর্বশেষ