মঙ্গলবার, এপ্রিল ১৬, ২০২৪
প্রচ্ছদফিচারবাইশ ক্যারেট সোনা : সেলিনা হক

বাইশ ক্যারেট সোনা : সেলিনা হক

‘সোনা’ কেউ নাম দিয়েছে কাঞ্চন, কেউবা গিনি। এই মূল্যবান ধাতুটি সর্বকালেই থেকেছে মানুষের আকর্ষনের কেন্দ্রবিন্দুতে। বিয়ে নামক আচার-অনুষ্ঠানের মূল উপাদানে, আর নারীর অঙ্গ শোভার অলংকারে। এই স্বর্ণই আবার যুগে যুগে সভ্যতার গঠনে এক দেশ হতে অন্য দেশে, বিভিন্ন মাধ্যমে, বৈধ-অবৈধ সকল পন্থায় মানুষের হাত দিয়ে সকল আইনের ফাঁক গলিয়ে পাচার হয়। সমাজের বিত্তের পাহাড় গড়ার কারিগর হিসেবে কাজ করে। চুনো-পুটিরা ধরা পড়ে, আবার জামিনে বেড়িয়ে এসে দিব্যি ঘুরে বেড়ায়। রাঘব-বোয়ালরা ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়। সোনার প্রতি আগ্রহ নেই এমন মানুষের সন্ধান পাওয়া ভার। কেউ সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মায়, কেউ কষ্ট করে অর্জন করে। কেউবা প্রয়োজনে অপ্রয়োজনেই রাশিকৃত সোনা ভান্ডারে পরিনত করে। সেটায় কার অধিকার একমাত্র রক্ষাকর্তাই জানেন। সকল ধর্মে স্বর্ণের এক বিশাল ভূমিকা। সে পনের হিসাবে হউক, মেয়ের সম্পদ জমার হিসাব বাড়ানোর জন্য হউক, দেবতাকে তুষ্ট করতেই হউক অথবা বিলিয়ে সান্তনা পেতেই হউক সোনা সেতো সোনাই। তাহার মূল্য কি দিয়েই বা যাচাই করা যায়। টাকার অংকে যা দিনে দিনে হাজার, লাখ ছাড়িয়ে মিলিয়ন ডলারে। ইসলাম ধর্মে প্রতি ভরির সোনার যাকাত আদায় করতে হয়।gold
“সোনার পাহাড়” “কাঞ্চনজঙ্ঘা” দেখার জন্য যুগে যুগে কত পর্যটক নেপাল, দার্জিলিং এর হাজার হাজার মাইল পাহাড়ী পথ পাড়ি দিচ্ছে। আমিও প্রান্তিক বয়সে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার জন্য মেয়ের সাথে দার্জিলিং গিয়েছিলাম। কিন্তু আমার এই বাইশ ক্যারেট সোনার গল্প একটু ভিন্ন। ছাব্বিশ বছর ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকায় বসবাস করেছি ডাক্তার স্বামীর চাকুরি সূত্রে। ছেলে মেয়েরা ইউনিভার্সিটি ল্যবরেটরী স্কুল ও উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে পড়ালেখা শেষ কেউ মেডিকেলে কেউ আবার ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় পড়ালেখা করেছে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় এলাকা, শিশু একাডেমীতে ছেলেমেয়েরা গান, আবৃত্তি শিখেছে। দোয়েল চত্বরে মৃৎশিল্পের জমজমাট ব্যবসা, লাল, নীল, সবুজ নানা রঙের নার্সারি, বাংলা একাডেমীতে প্রতি বছর “অমর একুশে বইমেলা” রমনার রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত প্রসারিত হয়। পলাশীবাজার, কাঁটাবন, শাহবাগে চিরচেনা ফুলের সমারোহ। নিউমার্কেট, নীলক্ষেতে বইখাতা, ফটোকপি – কিনা আছে সেখানে। এসব এলাকায় ছিল সবার অবাধ বিচরন। স্বামীর কর্মজীবনে অবসরে যাওয়ার পর নতুন ঠিকানা মিরপুর ডি,ও,এইচ,এস তবুও মাঝে মাঝে নিউমার্কেট, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের রেজিষ্টার বিল্ডিং বা ব্যাংকের কাজে যেতে হয়।
সেদিন কাঁটাবন এর সোনালী ব্যাংক থেকে বের হয়ে রিক্সায় উঠেছি হাতির পুলে এক আত্মীয়র বাসায় যাব। ব্যক্তিগত গাড়িটি সঙ্গে ছিলনা। রিক্সাওয়ালা কয়েক গজ দূরে যেতেই হঠাৎ রিক্সা থামিয়ে দেয়। আমি বললাম কি হয়েছে? চেন পরে গেছে? রিক্সাওয়ালা বললো, না, না, দেখেন না দশটাকার একটা নোট পরে আছে। এই বলে রিক্সা থেকে নেমে চারকোনা একটি বস্তু দশটাকার নোট দিয়ে বাঁধা। নিজেই বাঁধন খুলে আমাকে বললো দেখেন এটা কি? আমি হাতে নিয়ে দেখলাম ঠিক যেন একটি সোনার বার। সাথে একটি ছোট কাগজে লেখা “নিপেন বাবু স্বর্ণকার, আমি নিজে না যাইতে পারিয়া আমার ছোট ছেলের নিকট চার ভড়ি থান সোনা পাঠাইয়া দিলাম। আপনি সুন্দর করে দুটি চন্দন হার ও এক জুড়া কানপাশা বানিয়ে দিবেন, স্বর্ণের মূল্য ২,০০,০০০/- টাকা”। (বানান সঠিক ছিলনা)

আমার হাতে একটি বড় ব্যাগ ছিল। আমি কাগজটি পড়ে দ্রুত ব্যাগে ফেলে দিলাম। রিক্সাওয়ালা বললো, খালাম্মা এতো “বাইশ ক্যারেট সোনা”। এটা আপনি রাখেন। রিক্সাওয়ালা ইতিমধ্যে রাস্তার পাশে থামিয়ে দিয়েছে এবং ছোট কাগজটি কোথায় জানতে চাইল? আমি বললাম কি জানি কাগজটি কোথায় পরেছে। দেখেন নিচে পরেছে নাকি আপনার হাতেই তো সবকিছু। রিক্সাওয়ালা বললো, খালাম্মা দশ হাজার টাকা দিয়ে এই সোনার বার নিয়ে যান, অনেক গয়না বানাতে পারবেন। এর দাম দুই লক্ষ টাকা। আমি বললাম, আমার কাছে এত টাকা নাই আপনি কি করে জানলেন এটা বাইশ ক্যারেট সোনা? এর দাম দুই লক্ষ টাকা? রিক্সাওয়ালা কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বলল “কাগজটা কই হারাইলেন? কাগজে সব লেখা আছে।” আমি নিজেও একটু ভয় পেয়ে গেলাম। প্রায় চল্লিশ বছর ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় বসবাস করেছি। বিয়ের আগে ইডেন কলেঝে পড়া লেখা করেছি। আমি একটু সচেতন হলাম। রিক্সাওয়ালা বললো, আমার রিক্সায় পাম্প নাই। অন্য একটা রিক্সা ডেকে আমাকে উঠিয়ে দিয়ে চোখের পলকে হাওয়া হয়ে গেল। পরের রিক্সাওয়ালা অদ্ভুতভাবে একই সুরে আমাকে বললো, “খালাম্মা আপনি পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে সোনাটা নিয়ে যান। বাইশ ক্যারেট সোনা। আপনার অনেক কাজে লাগবে। গরীব মানুষ, যা দেবেন তাই ওর লাভ। পুলিশকে দেখালে ধইরা নিয়া যাব। গ্যারেজ মালিককে দেখালে নিয়া নিব। খালাম্মা দুই হাজার টাকা দিয়ে নিয়ে যান।” আমি রীতিমত ঘামছি। আমার আর বুঝতে বাকি নাই যে, আমি প্রতারনার ফাঁদে পড়তে যাচ্ছি। দ্বিতীয় রিক্সাওয়ালা যখন বলছে, বাইশ ক্যারেট সোনা, এবং আস্তে আস্তে টাকার অংক কমিয়ে আনছে। আমাকে বাধ্য করছে কিছু টাকা দিয়ে হলেও সোনার বারটি নিতে। আমি তখন বুদ্ধি করে বললাম তুমি কি শাহবাগ যাবে? নাকি আশে পাশের লোকজন কে ডাকব? নাকি অন্য রিক্সায় চলে যাব? তখন সে তাড়াতাড়ি আমাকে নামিয়ে দিয়ে দ্রুত চলে গেল। আমি ততক্ষনে বুঝে গেছি আমি সংঘবদ্ধ প্রতারকের খপ্পরে পরেছ্ িনিজের বুদ্ধিমত্তার কারনে এবং লোভের বশীভূত না হয়ে অন্ততঃ কিছু টাকা খোয়ানোর হাত থেকে রেহাই পেলাম। অন্য অঘটন ও ঘটতে পারত। জীবনের ঝুঁকি ছিল। যেহেতু আমি ব্যাংক থেকে বের হয়েছি, আমার কাছে অবশ্যই টাকা আছে, আমাকে চাকু দেখিয়েও টাকা আদায় করতে পারত, এটা ওদের দলীয় টার্গেট। আমি অন্য একটি রিক্সা নিয়ে শাহবাগে রওনা দিলাম। এতকিছু ঘটে গেল আশে পাশের কেউ বুঝতে পারলনা। অভিনব এই প্রতারনার কথা আমি কোনদিন ভুলবনা। ঢাকা শহরে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন প্রতারনার ঘটনা ঘটছে। কোনটির সাথে কোনটির মিল নাই। সত্যিই বিচিত্র পৃথিবী, তার চেয়ে বিচিত্র মানুষ। আশাকরি চলার পথে সবাই সর্তকতার সাথে চলবেন। (একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে)

আরও পড়ুন

সর্বশেষ