বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৮, ২০২৪
প্রচ্ছদলাইফস্টাইলজীবনে সঠিক পার্টনার নির্বাচণ খুব গুরুত্বপূর্ণ : তানভির শাহরিয়ার রিমন

জীবনে সঠিক পার্টনার নির্বাচণ খুব গুরুত্বপূর্ণ : তানভির শাহরিয়ার রিমন

রাত তখন প্রায় এগারোটা বাজে । আমি ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম । এমন সময় মোবাইলে ওসি সাহেবের ফোন আসল (সঙ্গত কারনেই তার নামটা গোপন রাখছি) ।

আমি এত রাতে অপ্রত্যাশিত ফোন পেয়ে কিছুটা চিন্তিত মনে ফোন ধরে বললাম, ভাই, হ্যালো…

ওসি সাহেব কুশলাদি বিনিময় শেষে বললেন, রিমন ভাই, আপনার এক ছাত্রকে আমার লোকজন ধইরা নিয়া আসছে ?

-আমার ছাত্র ? আমি একটু বিস্ময় নিয়ে জানতে চাইলাম ।
-না মানে, আপনি যখন ভার্সিটিতে পড়তেন তখন তাকে নাকী পড়াতেন ।

আমি কিছুটা আঁচ করতে পেরে জিজ্ঞেস করলাম, কী নাম ?
তিনি নাম বললেন, আমার ধারণার সাথে মিলে গেল ।

-তা ভাই কী করেছে সে ? সে তো ভালো চাকরি করে । বউ বাচ্চা নিয়ে সুন্দর জীবন তার । প্রায়ই তো ফেসবুকে দেখি এখানে ওখানে যাচ্ছে । বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট এ খাচ্ছে ।

ওসি সাহেব হাসেন । ভাই ফেসবুকে যা দেখেন সব সত্য মনে করেন ?
-মানে কী, আমি জিজ্ঞেস করি । আর তাকে ধরে নিয়ে আসার সাথে আমাকে ফোন করার কী সম্পর্ক ?

-মানে আছে রিমন ভাই । আর ফোন করার সম্পর্কও আছে । আগে মানেটা বলি । আপনার সেই ছাত্র ফুটানি মারাতে গিয়ে বিভিন্ন ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেন । সেই কার্ডের কোনো পেমেন্ট উনি নিয়মিত করেননা । বিভিন্ন ব্যাংক থেকে পার্সোনাল লোন নিয়েছেন, এরে ওরে জিম্মাদার বানিয়ে । সেগুলোর কিস্তিও দেননা । উল্টা জিম্মাদাররা এখন বিপদে । উনার কাছ থেকে টাকা না পেয়ে জিম্মাদারদের এখন ব্যাংক খুঁজছে । আমরা অভিযোগ পেয়ে উনাকে তুলে আনি থানায় । কথা প্রসঙ্গে সে তার এই কান্ডের পেছনে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নেই দাবী করছিল । এবং সে যে খুব ভালো মানুষ সেটা নাকী আপনি জানেন । আপনার সাথে যে আমার সুসম্পর্ক আছে সেটাও সে জানে । তাই আপনার কথা বলল ।

-আমি খুবই লজ্জা অনুভব করলাম । আমি ওসি সাহেব কে বলি, ভাই, ওকে আমি পড়িয়েছি তিনবছর । ক্লাস এইট থেকে ইন্টার ফাস্ট ইয়ার পর্যন্ত । তার পারিবারিক অবস্থা তো ভালো ছিল । হঠাৎ করে সে এরকম আচরণ করছে কেন ?

-হঠাৎ না, তার রেকর্ড ঘেটে যেটা দেখলাম, এটা তার শখে পরিণত হয়েছে । বউকে নিয়ে দামী রেস্টুরেন্ট এ খেতে যাওয়া, ফেসবুকে আপলোড দিয়ে নিজের আভিজাত্য প্রকাশ করা এটা তাদের এক ধরনের নেশা । এবং এটা যদি নিজের টাকায় করত তাহলে দোষের কিছু ছিলনা । ধার করে ঘি ভাত খাওয়ার দশা ওর । আমি তার সাথে কথা বলেছি । সে বলছে, এটা তার স্ত্রীর উচ্চবিলাসের কারণে হয়েছে । তার স্ত্রীই তাকে পরের ধনে পোদ্দারি করতে বাধ্য করেছে ।

আমি কথা আর বাড়ালাম না । শুধু বললাম, ভাই, একটু দেখেন যদি একটু মিমাংসা করে দিতে পারেন । ওর বাবা-মা কে আমি চিনি । উনারা খুব ভালো মানুষ ।

এবার আমি একটু আমার নিজের কথা বলি । আমি কর্পোরেট পেশায় আছি ১৯ বছর চলছে । এই পেশাগত জীবনে কখনো কখনো ব্যাংক থেকে লোন করতে হয়েছে আমাকে । আল্লাহর রহমতে কোনদিন একটি কিস্তিও ডিফল্টার হইনি আমি । দশবছর আগে যখন নিজের অ্যাপার্টমেন্টটি কিনি তখন একটি ব্যাংক থেকে ২০ বছর মেয়াদে হোম লোন নিয়েছিলাম । এই হোম লোনের বিপরীতে বিশ্বাস করুন বিগত ১০ বছরে ব্যাংকে দেড়গুণ টাকা সুদে আসলে পরিশোধ করার পরও এখনো দেখছি পরিশোধ যোগ্য বেশ বড় প্রিন্সিপাল এমাউন্ট বাকী আছে । এই ১০ বছরে একটি কিস্তিও আমি বিলম্বে জমা দিইনাই ।

আমার কাছে ক্রেডিট কার্ড আছে ৪ টি । সবগুলোর সম্মিলিত লিমিটও বেশ বড় অংকের । এবং এই কার্ডের সুদ রেট হলো ২৪-৩০ শতাংশ । আমি এয়ারপোর্ট লাউঞ্জ ব্যবহার করার জন্য এই কার্ড গুলো ব্যবহার করি । এর বাইরে যা খরচ হয় তা নির্দিষ্ট ডেটে আমার ব্যাংক একাউন্ট থেকে অটো ডেবিট হয়ে যায় । এক টাকাও বকেয়া নেই কোথাও ।

কথা গুলো এজন্য বলছি, যে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার একটা ফাঁদ । আপনি ভাবছেন আরে যা খরচ করছি তার মিনিমাম ৫ শতাংশ পেমেন্ট করলেই তো হয়ে যাবে । কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে আপনি যদি ফুল পেমেন্ট না করেন তাহলে চক্রবৃদ্ধির মতো ক্রেডিট কার্ডের সুদ বাড়তে থাকে ।

ক্রেডিট কার্ডের সুদের হার এত বেশি কেন ? কারণ এটা একটি আনসিকিউরড ঋণ ।আপনি একটা প্লাস্টিক কার্ড ব্যবহার করছেন এবং ৩০ শতাংশ সুদ দিচ্ছেন ! আহা, মানুষ !

গেল জানুয়ারিতে আমার মেন্টর চট্টগ্রামে আসলেন । এসে আমাকে বললেন, রিমন, ইউ হ্যাভ টু (Two) সিডান (কার) । ইউ নিড টু টেক এ্যা SUV ! আমার মেন্টর আমাকে আমাদের গ্রুপের একটা অসাধারণ এসইউভি MG HS নিতে সাজেস্ট করলেন-রিমন, ইউ মাস্ট টেইক ইট ব্রো !

আমি টেস্ট ড্রাইভে গেলাম স্ত্রীকে নিয়ে । ফ্লাই ওভারে উঠে তো মনে হলো পঙ্খিরাজে উঠে বসছি । কি স্পোর্টি রে বাবা ! প্যানারকিম সানরুফ দিয়ে মনে হয় পুরা আকাশ ঢুকে পড়ছে গাড়ীতে ।

আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, এই গাড়ীটা আমার চাই । স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম, কী, কেমন লাগল ?

সে স্মিত হেসে বলল, ভালো । কিনে ফেলবা ?
-হ্যা, প্রিমিওটা বেচে দেই । প্রায় ১ বছর তো গাড়ীটা বসেই আছে ।
-হ্যাঁ, বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ থাকায় তো আর এটা ব্যবহারই হয়নি । সে বলল ।
-তাহলে এটা বিক্রী করে আর কিছু টাকা যোগ করে এমজি নিয়েই ফেলি । শোনো, রেড় কালারটা বেশি জোশ !
-হ্যা জোশ ! মাথা নাড়ল আমার স্ত্রী । তবে আগে প্রিমিওটা বেচ ।

আমি প্রিমিওটা বেচে দিলাম । নগদ টাকা যখন হাতে আসল আমার স্ত্রীকে বললাম, লাল হর্সটা তাহলে অর্ডার দিয়ে দিই ?

আমার স্ত্রী বলল, শোনো, তোমার সাথে আমার কথা আছে । তারপর দু মগ কফি বানিয়ে আমাকে নিয়ে সে ডিভাইনে বসল ।

আমি যে কথা গুলো বলব তাতে তোমার মন খারাপ হতে পারে । কিন্তু তোমাকে মন দিয়ে শুনতে হবে,আমার স্ত্রী বলল ।
আমি কফিতে চুমুক দিয়ে বললাম, কোল্ড কফি তোমার চেয়ে ভালো আর কেউ বানাতে পারেনা । তা বলো তোমার কথা, আমি পা ছড়িয়ে দিয়ে একটু আয়েশ করে বসলাম ।

-দেখো, জীবনে প্রয়োজন আর বিলাসীতা দুটো ভালো করে বুঝতে হবে আমাদের । কভিড আমাদের কত কিছু শিখিয়েছে তাইনা !
-আমি মাথা নাড়লাম ।
-আমরা মাঝখানে চারমাস রেস্টুরেন্ট যাইনি । আমাদের কি সমস্যা হয়েছে ? আমরা যে দেশের বাইরে বেড়াতে যাইনি, কোনো ক্ষতি হয়েছে ? তোমার দুটো গাড়ী তুমি কতদিন চালিয়েছ গেল এক বছরে ? তুমি যে দামী ঘড়ি কিনতে সেই ঘড়ি ভয়ে তো ৪ মাস হাতে দাওনি । প্যান্ট পরেছ অথচ ব্র্যান্ডের বেল্ট গুলো পড়ে ছিল কাপবার্ডের ভেতরে ।
-হ্যা, সেটা তো মহামারির সময়ের কথা ।
-সেটাই তো বলছি । আমাদেরকে শিখিয়েছে যে বিলাসিতা ছাড়াও বেঁচে থাকা যায় সুন্দর ভাবে ।
-তুমি কি বলতে চাচ্ছ সরাসরি বলো ।
-আমি বলতে চাচ্ছি, এই মুহূর্তে তোমার আরেকটা গাড়ী কেনার দরকার নাই । তুমি আগে হোম লোনটা পরিশোধ করো । তারপর নতুন গাড়ী কেনা যাবে । আর আমাদের সিভিক তো এখনো চকচক করছে ।
-তো ?
-তুমি গাড়ী বিক্রী করে যে টাকা পেয়েছ তা ব্যাংকে এডভান্স পেমন্ট করে দিয়ে লোন কমিয়ে ফেল ।

আমি পরদিন ব্যাংকে গিয়ে হোম লোন এডভান্স পেমেন্ট এর জন্য ২ শতাংশ চার্জ দিয়ে গাড়ী বিক্রী থেকে পাওনা টাকার প্রায় ৭০ শতাংশ জমা দিয়ে দিলাম ।

ওই দিন কিছুটা হলেও মন খারাপ হয়েছিল লাল এমজিটা কিনতে পারছিনা বলে । ওসি সাহেবের ফোন পেয়ে আমার সেই দু:খটা কর্পুরের মতো মিলিয়ে গেল ।

আমি আমার স্ত্রীকে খুজঁতে থাকলাম । সে ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছছিল । ডিম লাইটের আলোয় তাকে ভীষণ পবিত্র দেখাচ্ছিল । আমি কোনো কিছু না ভেবেই ওকে জড়িয়ে ধরলাম ।

জীবনে সঠিক পার্টনার নির্বাচণ খুব গুরুত্বপূর্ণ । সঠিক পার্টনার আপনার জীবনে আলোক রশ্মির মতো । অন্ধকারে যে আলো আপনাকে পথ দেখায় । কখনোবা সে তুষার শুভ্র বন্ধুর মতো ভেজা আঙ্গুল দিয়ে আপনাকে টেনে তুলে পতন থেকে ।

 

আরও পড়ুন

সর্বশেষ