শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪
প্রচ্ছদইসলাম ও জীবনবর্তমান পরিস্থিতিতে কোরবানী : প্রফেসর ড. মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন তালুকদার

বর্তমান পরিস্থিতিতে কোরবানী : প্রফেসর ড. মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন তালুকদার

কোরবানী ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত এবং দীনের একটি নিদর্শন। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীর এ কঠিন সময়ে কিভাবে কোরবানী আদায় করা যেতে পারে সে সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা পেশ করা হলো:

কোরবানীর বিধান
ইসলামে কোরবানীর বিধান তথা শরয়ী মর্যাদা নিয়ে আলিমগণ দুটি মত ব্যক্ত করেছেন:
১. ইমাম আবূ হানীফা, ইমাম মুহাম্মদ, ইমাম যুফার, রবীআহ, লাঈস ইবন সাআদ, ইমাম আওযায়ী, সুফিয়ান ছাওরীর মতে কোরবানী ওয়াজিব। এ ব্যাপারে ইমাম মালিক ও ইমাম আবূ ইউসুফের দুটি করে মত পাওয়া যায়, তার মধ্যে একটি মত অনুযায়ী কোরবানী ওয়াজিব। এটাকে হানাফী মাযহাবের সিদ্ধান্ত হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। তারা কোরবানী ওয়াজিব হওয়ার পক্ষে যেসব দলীল পেশ করেন তার মধ্যে রয়েছে:
ক. মহান আল্লাহর বাণী, فَصَل لِرَبِّكَ وَانْحَرْ (তুমি তোমার রবের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করো ও কোরবানী দাও) [সূরা আল-কাওছার: ২] এ আয়াতের তাফসীরে এসেছে তুমি ঈদের নামায আদায় করো ও কোরবানী প্রদান করো। এখানে আল্লাহ আদেশসূচক শব্দ ব্যবহার করেছেন; যা সাধারণভাবে আবশ্যকতার হুকুম রাখে। আর রাসূল সা এর জন্য আবশ্যক হলে তা উম্মতের জন্যও আবশ্যক।
খ. মহানবী সা. এর বাণী, مَنْ كَانَ لَهُ سَعَةٌ وَلَمْ يُضَحِّ فَلاَ يَقْرَبَنَّ مُصَلاَّنَا “সামর্থ্য থাকা সত্তেও যে ব্যক্তি কোরবানী করে না সে যেনো আমাদের সাথে ঈদগাহে না আসে।” [ইবনু মাজাহ] হাদীসটিতে কোরবানী পরিত্যাগকারীদের বিরুদ্ধে কঠিন সতর্কবার্তা দেয়া হয়েছে, এধরনের সতর্কবার্তা সাধারণত ওয়াজিব পরিত্যাগকারীদের ব্যাপারেই দেয়া হয়।
গ. রাসূলুল্লাহ সা. এর বাণী, مَنْ ذَبَحَ قَبْل الصَّلاَةِ فَلْيَذْبَحْ شَاةً مَكَانَهَا، وَمَنْ لَمْ يَكُنْ ذَبَحَ فَلْيَذْبَحْ عَلَى اسْمِ اللَّهِ “যে ব্যক্তি (ঈদের) নামাযের আগে কোরবানী করেছে সে যেনো (নামাযের পরে) তার পরিবর্তে পুনরায় একটি ছাগী যবেহ করে, পক্ষান্তরে যারা এখনও যারা যবেহ করেনি তারা যেনো আল্লাহর নামে যবেহ করে।” [সহীহ মুসলিম] এ হাদীস থেকেও কোরবানী ওয়াজিব হওয়া প্রমাণিত হয়।
২. জমহুর তথা সংখ্যাগরিষ্ট ফকীহগণের মতে কোরবানী সুন্নাতে মুআক্কাদাহ। এটি ইমাম মালিকের অধিকতর নির্ভরযোগ্য মত, ইমাম আবু ইউসুফের দুটি অভিমতের একটি এবং শাফিয়ী ও হাম্বলী মাযহাবের সিদ্ধান্ত। হযরত আবু বকর, উমর, বিলাল, আবু মাসউদ রা. এবং তাবেয়ীগণের মধ্যে সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব, আতা, আলকামা প্রমুখ এ মত পোষণ করতেন। তাদের দলীল:
ক. রাসূলুল্লাহ সা. এর বাণী, إِذَا دَخَل الْعَشْرُ، وَأَرَادَ أَحَدُكُمْ أَنْ يُضَحِّيَ فَلاَ يَمَسَّ مِنْ شَعْرِهِ وَلاَ مِنْ بَشَرِهِ شَيْئًا “যখন জিলহাজ্জ মাসের প্রথম দশক শুরু হবে এবং তোমাদের কেউ যদি কোরবানী করাতে চায় সে যেনো তার চুল ও নখ না কাটে।” [মুসলিম] এ হাদীসে “কোরবানী করাতে চায়” দ্বারা প্রতীয়মান হয় কোরবানী করা বা না করার ইখতেয়ার আছে, যদি এটা ওয়াজিব হতো তবে এ ধরনের এখতিয়ার থাকতো না।
খ. ইমাম বায়হাকী বর্ণনা করেছেন, আবু বকর ও উমর রা. এক দুই বছর পরে পরে কোরবানী করতেন এই আশঙ্কায় যে অন্যরা এটাকে ওয়াজিব মনে না করে।

কোরবানীর ধরন
হানাফী মাযহাব অনুযায়ী প্রত্যেক সামর্থবান ব্যক্তির ওপর কোরবানী ওয়াজিব। অতএব একই পরিবারে একাধিক ব্যক্তি যদি সামর্থবান হয় তবে প্রত্যেককে আলাদা আলাদা কোরবানী করতে হবে। একটি ছাগল/ভেড়া/ দুম্বা বা গরুর ৭ ভাগের ১ ভাগ দ্বারা শুধুমাত্র ১ জনের কোরবানী আদায় হবে। পক্ষান্তরে অন্যান্য ফকীহ কোরবানীকে সামষ্টিক কর্তব্য বিবেচনা করেছেন, এ জন্য তাদের মতে, একটি পরিবারের পক্ষ থেকে একটি কোরবানীই যথেষ্ট। তারা তাদের মতের পক্ষে হাদীস থেকে প্রমাণ পেশ করেন। আবু আইয়ুব আল-আনসারী রা বলেন, আমরা একটি ছাগল দ্বারা কোরবানী করতাম যা ব্যক্তি তার নিজের ও নিজ পরিবারের পক্ষ থেকে যবেহ করত। [মুয়াত্তা মালেক]; এ সম্পর্কে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সা. ঈদুল আযহার দিন পরপর দুটি বকরী যবেহ করেন। ১মটির ব্যাপারে বলেন, এটি আমার ও আমার পরিবারের পক্ষ থেকে এবং ২য়টির ব্যাপারে বলেন, এটি আমার উম্মতের পক্ষ থেকে। [মুসনাদে আহমদ] তবে এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে যে, পরিবারের পক্ষ থেকে কোরবানী দিলে কোরবানীদাতাকে অবশ্যই সকলের পক্ষ থেকে দেয়ার নিয়্যাত করতে হবে অন্যথায় সকলে সওয়াবের ভাগী হবেন না।

বর্তমান পরিস্থিতিতে কিভাবে কোরবানী আদায় করা যাবে?
বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যহত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতে কোরবানীর পশু ক্রয়ের জন্য বাজারে গমন, যবেহ, প্রক্রিয়াকরণ ইত্যাদি জনসমাগম এড়িয়ে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে পালন করা কষ্টকর হলে সেক্ষেত্রে আমরা নিম্নোক্ত পন্থা অবলম্বন করতে পারি:
১. মধ্যপ্রাচ্য, পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের বিভিন্ন উন্নত রাষ্ট্রের মতো সরকারী ব্যবস্থাপনায় অথবা সরকার অনুমোদিত সংস্থার অধীনে নাম রেজিষ্ট্রেশন করে কোরবানী করা যেতে পারে । দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে এ কাজ সম্পন্ন করবে, ফলে কোনো ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।
অথবা
২. ইসলাম মানুষের কল্যাণ বিবেচনা করে ও কোরবানীর বিধান পালনের সুবিধার্থে যেহেতু জিলহাজ্জ মাসের ১০, ১১, ১২ এ ৩দিন (কোনো কোনো মত অনুযায়ী ৪দিন অর্থাৎ ১৩ তারিখ পর্যন্ত) কোরবানী আদায় করার সুযোগ দিয়েছে সেহেতু সকলেই ১০ তারিখে একত্রে ভীড় না করে বরং প্রত্যেক এলাকাকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চলে বিভক্ত করে পর্যায়ক্রমে ১০-১২ তারিখের মধ্যে কোরবানী সম্পন্ন করা যেতে পারে;
অথবা
৩. মাযহাবী মতপার্থক্যের ঊর্ধ্বে উঠে প্রত্যেক পরিবারের পক্ষ থেকে ১টি ছাগল/ ভেড়া কোরবানীর মাধ্যমে ইসলামের এ গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত পালন করা। এক্ষেত্রে যেসব পরিবারে একাধিক কোরবানী দেওয়ার প্রয়োজন ছিল তারা তাদের কোরবানীর জন্য বাজেটের বাকি টাকা গরীব-অসহায় ও কর্মহীন মানুষকে দিয়ে তাদের আহার ও মানবিক প্রয়োজন পূরণে সাদকাহ করতে পারেন। উদাহরণ স্বরূপ, গত বৎসর যে পরিবারে ১ লক্ষ টাকার গরু কোরবানী করেছিলেন তারা এ বছর সীমিত পরিসরে একটি ছাগল কোরবানী করলেন। ছাগলের মূল্য হয়তো ১০ হাজার টাকা। বাকি ৯০ হাজার টাকা তখন সাদকাহ হিসেবে দান করতে পারবেন।
অথবা
৪. কোরবানী আদায় না করে উক্ত অর্থ দান করে দেয়া যাবে কি না? আলিমগণের ঐক্যমতের ভিত্তিতে সাধারণ অবস্থায় কোরবানী না করে সে অর্থ দান করা যাবে না, বরং কোরবানীই করতে হবে। কেননা কোরবানী ওয়াজিব, কারো কারো মতে সুন্নাতে মুআক্কাদাহ। পক্ষান্তরে দান-সাদকাহ নফল। কোনো নফল ওয়াজিব বা সুন্নাতের স্থলাভিষিক্ত হতে পারে না। তাছাড়া কোরবানীর ব্যাপারে সরাসরি কুরআন ও সুন্নাহের নির্দেশ রয়েছে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাহাবী, তাবিঈ, তাবে তাবিঈগণের কেউ কোরবানী না করে সে অর্থ দান-সাদকাহ করেছেন মর্মে কোনো প্রমাণ নেই। উপরন্তু, শরীয়াতের প্রতিটি বিধানের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য থাকে যাকে মাকাসিদুশ শরীয়াহ বলা হয়। কোরবানীর বিধানের ক্ষেত্রে সে উদ্দেশ্য হলো, অসহায়-দরিদ্র ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য উন্নততর খাদ্যের (হালাল ও পবিত্র গোশত) সংস্থান করা। আল্লাহ বলেন, فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْبَائِسَ الْفَقِيرَ “তোমরা কোরবানীর পশুর গোশত খাও ও নিঃস্ব ফকীরদের খাওয়াও।” [সূরা আল-হাজ্জ: ২৮] এ কারণে ফকীহগণ তাদের গ্রন্থে কোরবানীদাতা কর্তৃক কোরবানীর গোশত সংরক্ষণ করে রাখার বিপেক্ষে আলোচনা উপস্থাপন করেছেন। অথচ কোরবানীর পরিবর্তে সমপরিমাণ অর্থ দান করলে সে উদ্দেশ্য অর্জিত হয় না। তথাপি হানাফী মাযহাবে জটিল পরিস্থিতির কারণে যদি কোরবানী আদায় করা সম্ভব না হয় এবং কোরবানীর নির্দিষ্ট ৩দিন অতিবাহিত হয়ে যায় তবে কোরবানীর পশুর সমপরিমাণ অর্থ সাদকাহ করার অভিমত বর্ণিত হয়েছে। যদিও অন্যান্য মাযহাবের ইমামগণ তা গ্রহণ করেননি। হানাফী মাযহাবের প্রামাণ্যগ্রন্থ আল-হিদায়াহ এর প্রণেতা ইমাম মারগীনানী বলেন, ولو لم يضح حتى مضت أيام النحر إن كان أوجب على نفسه أو كان فقيرا وقد اشترى الأضحية تصدق بها حية وإن كان غنيا تصدق بقيمة شاة اشترى أو لم يشتر” “যদি সে কোরবানী না করে থাকে এমনাবস্থায় কোরবানীর দিনগুলো অতিবাহিত হয়ে যায় তবে কেউ যদি কোরবানী নিজের জন্য আবশ্যক করে নেয় (যেমন মানতের কোরবানী) অথবা গরীব হয় সে যদি কোরবানীর পশু ক্রয় করে থাকে তবে ঐ পশুটিই জীবিত দান করে দেবে; পক্ষান্তরে যদি সে ধনী হয় তবে পশু ক্রয় করুক বা না করুক সে ছাগলের মূল্য পরিমাণ অর্থ সাদকাহ করবে।” [আল-হিদায়াহ, কোরবানী অধ্যায়, ৪/৩৫৮] অতএব একেবারে নিরুপায় হলে এ সুযোগটি গ্রহণ করা যেতে পারে; সেক্ষেত্রে কোরবানীর জন্য বাজেটের পুরো অর্থই সাদকাহ করা উত্তম হবে। আশা করা যায় আল্লাহ তার পক্ষ থেকে এটি কবুল করবেন। মহান আল্লাহই সমাধিক জ্ঞাত।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ