সোমবার, এপ্রিল ২৯, ২০২৪
প্রচ্ছদজাতীয়আলীমের যাবজ্জীবন কারাদন্ড

আলীমের যাবজ্জীবন কারাদন্ড

আদালত প্রতিনিধিঃ (বিডি সময় ২৪ ডটকম)

একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক বিএনপি নেতা ও মন্ত্রী আব্দুল আলীমেকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। তার বিরুদ্ধে আনা ৯টি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।

আর তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের মধ্যে ৮টি প্রমাণিত হয়নি।

তার বিরুদ্ধ আনা ১৭টি অভিযোগের মধ্যে ১, ২, ৬, ৭, ৮, ৯, ১০, ১২ এবং ১৪নং অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। আর প্রমাণিত হয়নি ৩, ৪, ৫, ১১, ১৩, ১৫, ১৬ এবং ১৭নং অভিযোগ।

প্রমাণিত ৯টি অভিযোগের মধ্যে রয়েছে হত্যা, লুট এবং অগ্নিসংযোগের মতো অপরাধ রয়েছে।

যে অভিযোগগুলো প্রমাণিত হয়নি এর মধ্যে ৪ এবং ৫নং অভিযোগের পক্ষে কোনো সাক্ষী পাওয়া যায়নি। বুধবার বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল-২ এ রায় ঘোষণা করেন। সকালে ১৯১ পৃষ্ঠার সারসংক্ষেপ পড়ার আগে রায় নিয়ে কোনো মন্তব্য না করার পরামর্শ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।

অভিযোগগুলো:
১. মেহের উদ্দিনের বাড়িতে লুটপাট ও আগুন: একাত্তরের ২০ এপ্রিল বিকেল ৫টার দিকে আলীমের নেতৃত্বে পাঁচবিবি থানার দমদমা গ্রামের মেহেরউদ্দিন চৌধুরীর বাড়িতে হামলা চালায় রাজাকার বাহিনী। এরপর বাড়ির সব মালামাল লুট করে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। ওই ঘটনার পর মেহেরউদ্দিন তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দেশ ত্যাগে বাধ্য হন।

২. হিন্দু সম্প্রদায়ের ৩৭০ জনকে গুলি করে হত্যা: ১৯৭১ সালের ২৬ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে আলীমের নেতৃত্বাধীন রাজাকার বাহিনীসহ পাকিস্তানী সেনারা জয়পুরহাটের কড়ইকাদিপুর এলাকার কড়ই, কাদিপুর প্রকাশ কাদিপাড়া, চকপাড়া, সোনার পাড়া, পালপাড়া ও যুগীপাড়া হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামে হামলা চালায়। এরপর সেখানে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের পর অনেককে আটক করে তারা। পরে কাদিপুর আখের চুলি¬র কাছে ৭০ জন, কাদিপুর ডোমপুকুরে ৯০ জন, চকপাড়ার কুড়ালপুরে ২৬ জন ও চকপাড়া কুড়ালপুরের কাছে রাস্তার উত্তর পাশে ৫ জনকেসহ মোট ৩৭০ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

৩. পাহনন্দা গণহত্যা: একাত্তরের আষাঢ় মাসের প্রথম সপ্তাহে আলীমের পরামর্শ ও প্ররোচনায় এবং চিরোলা গ্রামের শান্তি কমিটির সদস্য রিয়াজ মৃধার সহাযোগিতায় ১১ জন পাকিস্তানি সেনা নওপাড়া, চরবরকত ও চিলোরা গ্রামের আনুমানিক ৫০০ জনকে আটক করে। এরপর আলীমের দেওয়া তালিকা দেখে আওয়ামী লীগ, মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের আত্মীয় ২৮ জনকে রেখে বাকিদের ছেড়ে দেওয়া হয়। ওই ২৮ জনকে পিছমোড়া করে বেঁধে আফাজের বাড়ির মাটির ঘরে নিয়ে গুলি করা হয়। তাদের মধ্যে ২২ জনকে নিহত হলেও ৬ জন প্রাণে বেঁচে যান।

৪. পাঁচবিবিতে ১৯ জনকে হত্যা: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে একদিন আব্দুল আলীম একটি ট্রেনে করে পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে পাঁচবিবি বকুলতলা রেললাইনের কাছে নামেন। এরপর বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে কোকতারা, ঘোড়াপা, বাগজানা ও কুটাহারা গ্রামে হানা দিয়ে বাড়িঘরে লুটপাট চালায় এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। সেখান থেকে ১৯ জনকে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যাও করা হয়।

৫. মিশন স্কুলে ৬৭ জন হিন্দুকে হত্যা: একাত্তরের বৈশাখ মাসের শেষ দিকে জয়পুরহাটের দক্ষিণ পাহুনন্দা মিশন স্কুলে আসামি আব্দুল আলীমের নির্দেশে ও প্ররোচনায় ৬৭ জন হিন্দুকে হত্যা করা হয়। এরপর স্থানীয়দের ডেকে এনে স্কুলের পশ্চিম পাশে বাঙ্কার খুঁড়িয়ে ওই ৬৭ জন হিন্দুর লাশ মাটি চাপা দেয়া হয়।

৬. ছালামসহ ৯ জনকে হত্যা: একাত্তরের মে মাসের প্রথম দিকে জয়পুরহাটের আক্কেলপুরে আব্দুস ছালাম, আব্দুল কুদ্দুস, সমিরউদ্দিন ম-ল, আবুল হোসেন মাঝি, আজিম হোসেন মাঝি, আব্দুর রহমান মে¤¦ার, এবারত আলী ম-ল, আব্দুস ছাত্তার ও ফজলুর রহমানসহ ১০ জনকে আটক করা হয়। এরপর তাদের পাকিস্তান সেনাবহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। পরে এদের পাঁচবিবি থানার বাগজানা পুরনো রেলওয়ে স্টেশনের কাছে কোকতারা বকুলতলার পুকুর পাড়ে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। এদের মধ্যে মোফাজ্জল নামে একজন প্রাণে বেঁচে যান।

৭. ইলিয়াসসহ ৪ জনকে অপহরণ করে হত্যা: একাত্তরের ২৬ মে নওদা গ্রামের ইলিয়াসউদ্দিন সরদার, ইউসুফ উদ্দিন সরদার, ইউনুস উদ্দিন সরদার ও আবুল কাদের মোল¬াকে অপহরণ করা হয়। এরপর আব্দুল আলীমের পরামর্শে ও প্ররোচনায় ওই দিন সন্ধ্যায় কালী সাহার পুকুর পাড়ে নিয়ে তাদের গুলি করে হত্যা করে লাশ মাটিচাপা দেয়া হয়।

৮. ক্ষেতলাল গণহত্যা: একাত্তরের মে মাসের শেষের দিকে ক্ষেতলাল হিন্দুপল¬ী, উত্তরহাট শহর, হারুনজাহাটসহ বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে রাজাকার বাহিনী। আলীমের নির্দেশে বাদল, সচীন ওরফে ভানু, প্রবাস চন্দ্র শীল, মনিভূষণ চক্রবর্তী, কার্তিক চন্দ্র বর্মণ, নিমাই চন্দ্র বর্মণ ও প্রিয়নাথ বর্মণসহ অপরিচিত আরও তিন জনকে হত্যা করা হয়। রোজার ঈদের আগে ক্ষেতলাল থানার উত্তরহাট শহরহাটের পশ্চিম পাশে একটি জনসভার আয়োজন করা হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর আফজালসহ বহু সেনাসদস্য ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন। আলীম ওই জনসভায় বলেন, ‘আগামী ঈদে আমরা কলকাতা গড়ের মাঠে নামাজ পড়ব। সাধারণ মানুষের সাহস বৃদ্ধির জন্য হিন্দুদের ক্ষমা করা যাবে না। এদের যা পাও লুট করে নাও।’

৯. পশ্চিম আমট্রা গ্রামে গণহত্যা: একাত্তরের ১৪ জুন বগুড়ার খোকন পাইকারসহ ১৫ জন যুবক জয়পুরহাটের আক্কেলপুর হয়ে ভারতে যাওয়ার পথে শান্তি কমিটির লোকজনের হাতে ধরা পড়েন। এরপর আলীমের নির্দেশে আক্কেলপুরের পশ্চিম আমট্রা গ্রামে এনে তাদেরকে হাত-পা বেঁধে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। এরপর ওই গ্রামের ময়েন তালুকদারের ছেলেকে ধরে এনে গর্ত করে লাশগুলো মাটি চাপা দেয়া হয় বলে প্রসিকিউশনের অভিযোগে উলে¬খ করা হয়েছে।

১০. জয়পুরহাট কলেজে ২৬ যুবককে হত্যা: একাত্তরের জুন মাসের শেষের দিকে আব্দুল আলীম জয়পুরহাট সদর রোডের শওনলাল বাজলার গদিঘরে শান্তি কমিটির অফিসে বসে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ সন্দেহে পাহাড়পুর থেকে ধরে আনা ২৬ যুবককে হত্যার সিদ্ধান্ত নেন। এরপর দুটি ট্রাকে করে ওই যুবকদের জয়পুরহাট রেলস্টেশনের পশ্চিমে ফাঁকা জায়গায় নিয়ে গিয়ে হাতে অস্ত্র ধরিয়ে দিয়ে ছবি তোলা হয়। ছবিসহ নেগেটিভগুলো আলীম নিয়ে গেলেও স্থানীয় ‘আলোখেলা’ স্টুডিওর মালিক এইচ এম মোতাছিম  কয়েকটি ছবি নিজের কাছে রেখে দেন। ছবি তোলার পর ওই ২৬ যুবককে ট্রাকে তুলে জয়পুরহাট সরকারি কলেজে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।

১১. গাড়োয়ালদের হত্যা: মুক্তিযুদ্ধের সময় জুন মাসের শেষের দিকে কয়েকজন গাড়োয়াল এবং তাদের আত্মীয়-স্বজনসহ মোট ২৬ জনকে আটক করা হয়। এরপর আলীমের নির্দেশে খঞ্জনপুর কুঠিবাড়ি ব্রিজের কাছে নিয়ে গুলি হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়া হয়।

১২. ডা. আবুল কাশেম হত্যা: একাত্তরে ২৪ জুলাই ডাক্তার আবুল কাশেমকে অপহরণ করা হয়। এরপর তাকে আটকে রেখে অমানবিক নির্যাতন করা হয়। আলীমের নির্দেশে ২৬ জুলাই তাকে খঞ্জনপুর ব্রিজের কাছে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।

১৩. এগারো  যুবককে হত্যা: একাত্তরের সেপ্টেম্বরে দুটি ট্রাকে করে মুখে কালি মাখানো ১১ জন যুবককে জয়পুরহাট থানা রোডের আজিমউদ্দিন সরদারের বাড়ির সামনে নিয়ে আসা হয়। পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা তাদের সরকারি ডিগ্রি কলেজে নিয়ে যায়। সেখানে আব্দুল আলীমের নির্দেশে ওই ১১ যুবককে ট্রাক থেকে নামিয়ে বারঘাটি পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী।

১৪. ফজলুল করিমসহ ৩ জনকে হত্যা: একাত্তরের ৭ অক্টোবর আক্কেলুপুর সদরের ফজলুল করিম ও অন্য ২ জনকে আটক করে আলীমের নির্দেশে মুখে চুনকালি লাগিয়ে জয়পুরহাট শহর প্রদক্ষিণ করানো হয়। পরে তাদের খঞ্জনপুর কুঠিবাড়ি ঘাটে নিয়ে নির্যাতনের পর গুলি করে হত্যা করা হয়।

১৫. চিনিকলে হত্যা: একাত্তরের ২৫ আগস্ট পাঁচবিবি থানার সোলেমান আলী ফকির এবং তার দুই বন্ধু আব্দুস সামাদ ম-ল ও উমর আলী ম-লকে পাঁচবিবি বাজারে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তুলে দেয়া হয়। এরপর আলীমের নির্দেশে তাদের ওপর নির্যাতন চলে। পাকিস্তানি সেনাদের ওই ক্যাম্পে আরও ২৫ জনকে আগে থেকেই আটকে রাখা হয়েছিল। আসামি আলীম ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একজন কর্নেল চিনি কলের ক্লাবঘরে ‘কোর্ট’ বসিয়ে তাদের ‘মৃত্যুদ-’ দেয়। ওই ২৫ জনের মধ্যে ৮ রাতে পর্যায়ক্রমে ২৩ জনকে হত্যা করা হয়। সোলেমান ফকিরসহ বাকি ৪ জনকে ছেড়ে দিলে তারা নিরাপত্তার জন্য ভারতে চলে যান।

১৬. আক্কেলপুরে উস্কানিমূলক বক্তব্য: আসামি আব্দুল আলীম একাত্তরে আক্কেলপুরের বিভিন্ন স্থানে উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেন। তিনি সোলায়মান আলী ফকিরের মিল প্রাঙ্গণ, আক্কেলপুর রেলওয়ে স্টেশন, বিভিন্ন মাদ্রাসায় স্থাপিত সেনাক্যাম্প, শান্তি কমিটির অফিস ও দুর্গাবাবুর দালানঘরে উস্কানিমূলক বক্তব্য রাখেন। এতে করে রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যরা মানবতাবিরোধী অপরাধে উৎসাহিত হয় বলে উলে¬খ করেছে প্রসিকিউশন।

১৭. জব্বল হত্যা: চট্টগ্রামের কালুরঘাটের ১৭ উইংয়ের ইপিআর সুবেদার মেজর জব্বল হোসেন মুক্তিযুদ্ধে গুরুতর আহত অবস্থায় পাঁচবিবি ধুরইল গ্রামের নাজিমউদ্দিনের বাড়িতে আশ্রয় নেন। খবর পেয়ে রাজাকাররা ওই বাড়ি ঘেরাও করে জব্বলকে অপহরণ করে। পরে আব্দুল আলীমের নির্দেশে তাকে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ করেছে প্রসিকিউশন।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ