শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪
প্রচ্ছদটপভালো থেকো তুমি, শান্তিতে থেকো : ডা. জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু

ভালো থেকো তুমি, শান্তিতে থেকো : ডা. জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু

যান জটের শহর ঢাকা, পথে পথেই সময় শেষ। সেকেন্ডের কাটা ধরে চলতে অভ্যস্ত আমি, সময়টাকে কাজে লাগাতে চাই। ইদানীং গাড়ীতে থাকা সময়টুকুতে বিভিন্ন জনের ওয়াজ শুনি। এক একজনের বলার স্টাইল একেক রকম, সবাই যে আলেম কিংবা খুব ভালো বক্তা তা নয় কিন্তু উচ্ছ্বাস আছে, শুনতে ভালো লাগে। অনেকে বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলে, নিজের অজ্ঞতাটুকু ভয় দেখিয়ে ঢাকতে চায়, তবুও শুনি, বুঝার চেষ্টা করি ওয়াজ মাহফিলে এতো মানুষ কেন হয়।

আমি যে কেবল ভিন্ন ভাষার ভিন্ন জনের ইসলামী ওয়াজ শুনি তা নয়, হিন্দি, এবং ইংরেজিতে বলা বৌদ্ধ, খ্রিস্ট, শিখ এবং হিন্দু ধর্মের গুরু, যাজক, পুরোহিতদের কথাও শুনি।

ভিন্ন ভিন্ন পন্থায় মেডিটেশনের গুরুদের কথা শুনি। প্রথা ভাঙ্গা ব্যতিক্রমী, নানা প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রমকারী, প্রতিবাদী, জয়ী বিশ্বের বিভিন্ন মানুষের কথাও মুগ্ধ হয়ে শুনি, তাঁদের জীবনের যুদ্ধটা বুঝতে চাই, জানতে চেষ্টা করি জীবন কেন, আসলে কি ?

গতকাল অফিস থেকে ফেরার পথে ইসলামী একজন স্কলারের বক্তৃতা শুনছিলাম। তিনি বলছিলেন, ‘‘যদি মৃত ব্যক্তির ধন-সম্পদ অন্য কেউ আত্মসাৎ করে তবে তাঁদের কৃত যাবতীয় ভালো কর্মের ফলাফল ধর্ম-কর্মের সমস্ত সওয়াব ওই মৃত ব্যক্তির রূহে যাবে তাঁর কর্মের খাতায় যোগ হবে।’’’ আলহামদুলিল্লাহ্‌ ! আনমনেই ভিতর থেকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।

টিংকুর ব্যবসায়ী পার্টনার যারা টিংকুর নাবালক সন্তানদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে, আত্মীয়স্বজন এবং যারা মৃত্যু নিশ্চিত জেনে টাকা ধার নিয়ে পরিশোধ করার প্রয়োজন মনে করেননি তাঁরা সবাই আপাত দৃষ্টিতে ভালো মানুষ এবং ধর্ম-কর্মে প্রচণ্ড বিশ্বাসী। কয়েকজন আবার স্ত্রী সহ একাধিকবার হজ্জব্রত পালন করেছেন। এদের সাথে কথা বললে মনে হবে ইহজগতে ইনারা যতটা ক্ষমতাবান এবং ধন-সম্পদের অধিকারী, পরকালে ওপারেতে তাঁদের জন্য ইতিমধ্যেই জান্নাতে সীট বুকিং দেওয়া হয়ে গেছে।

সদগায়ে জারিয়া। যতদিন এরা বেঁচে থাকবে ততদিন এদের সমস্ত নেক কাজের আমল টিংকুর খাতায় যোগ হবে, ওর সন্তানরা দোয়া পাবে। আল্লাহ্‌ এদেরকে আরও নেক কাজ করার তৌফিক দিন, হায়াত দিন, দীর্ঘ জীবন দিন,বাঁচিয়ে রাখুন।

আজ ডাঃ জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকুর অষ্টম মৃত্যুবার্ষিকী। ওর ইচ্ছায় রাওজানে ওদের পারিবারিক কবরস্থানে বাবা-মা, দাদা-দাদী আর চাচাদের পাশে ওকে সমাহিত করা হলেও কবর বাঁধানো নিয়ে খানিকটা সংশয় ছিল। গুরু জনেরা বলেছিলেন কবর বাঁধানোর কোন নিয়ম ইসলাম ধর্মে নেই। ধারণাটা হচ্ছে, ‘’তুমি প্রকৃতির সন্তান, প্রকৃতিতেই মিশে যাবে।’’ কর্ম ছাড়া আর কিছুতো পৃথিবীতে থাকে না, কর্মটাই মহৎ হোক।

টিংকুর সমস্ত জীবন এমন কি চিন্তা চেতনার পুরোটা জুড়ে ছিল অপরের জন্য ভালো কাজ, অন্যের মঙ্গল কামনা এবং উন্নতি। অবাক করার মত বিষয় হলেও এটাই সত্যি, সে কখনো নিজের জন্য, সন্তানদের জন্য ভাবতো না। নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে অন্যের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ত, তাঁদের সন্তানদের বুক দিয়ে আগলে রাখতে চাইত নিজের সন্তানদের মত করেই ।

রাজনীতি ছিল ওর নেশা, শরীরের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তবে অন্য অনেক রাজনীতিবিদের মত কখনো মিথ্যা বলত না, কাউকে কখনো মিথ্যা আশ্বাস দিত না। যা বলতো, যা করতো পুরোটাই নিজের বিশ্বাস থেকেই করতো । ও’ মনে প্রাণে বিশ্বাস করত মানুষের মঙ্গলের জন্য, অসহায় মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য তাঁর জন্ম হয়েছে।

যারাই টিংকুর কাছ থেকে অর্থ এবং ব্যবসায়িক সহযোগিতা পেয়েছে সময়ে সব অকৃতজ্ঞ, স্বার্থান্বেষী, সুযোগসন্ধানী, বেঈমান, চশমখোর, পাল্টিবাজ মানুষেরা সবকিছু ভুলে গেছে। গিরগিটির মত রঙ পাল্টে আজ তাঁদের ভিন্ন রূপ, কদাকার, কুৎসিত, ‘সব খাবো’ হায়েনার দল । তাঁরা সর্বভুক, আরও চাই, তাঁদের তৃষ্ণা মিটে না।

কিন্তু কেবল ভালোবাসা এবং সান্নিধ্য পাওয়া ভালো মানুষদের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। যারা আজও নীরবে অশ্রু ফেলে ওর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করে দোয়া করে যাচ্ছে , কবর জিয়ারত করতে যায়। তাঁদের অনুরোধ,আবেগ আর ভালবাসাকে সম্মান দিয়ে আমার ছেলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাঁর বাবার কবর বাঁধানোর। ছেলের চাকরীর টাকা দিয়ে কবর বাঁধানো হয়েছে। মেয়ে বলেছে অনেক ফুলের গাছও থাকতে হবে কবরের চারিপাশে। বাবার প্রিয় বোগেনভেলিয়া যেন এসে আছড়ে পরে কবরের উপর।

ইন্টারনেটে কানাডায় ভিন্ন ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ইন্টার্ভিউ চলছে মেয়ের। মেয়ে বলেছে,”বিদেশ যাওয়ার আগে আব্বুর কবরে দেখা করতে যাবো।’’ বাবা নেই কবরই ওদের দেখা সাক্ষাতের একমাত্র মাধ্যম। আমি নিজে কোনোদিন কবরের কাছে যাইনি, যেতে পারবোও না কোনোদিন।

মহান আল্লাহ্‌ এক এবং সদা সর্বদা সর্বত্র বিরাজমান, তিনি অন্তর্যামী। তিনি বলেছেন, ”এক হাতের দান-সদগা যেন অন্য হাত না জানে, মৃত মানুষের জন্য অবশ্যই কর কিন্তু নীরবে,’’ নাম ফুটানো কিংবা লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে নয়। তাঁর কাছে প্রার্থনা গরীব, অসহায়, দুস্থ, এতিম মানুষদের একজনের হাতও যদি আল্লাহ্‌রাব্বুল আলামিন কবুল করেন।

বেঁচে থাকতে ভক্ত আশেকানদের ভিড়ে সন্তানদের সাথে কথা বলারও সময় ছিল না তোমার, আমাদের চারতালা বাড়ির নীচ তালা থেকে চার তালার বেডরুম পর্যন্ত কেবলই মানুষ আর মানুষ, তিল ধারণের ঠায় নেই। মানুষ বিদায় করে ঘুমোতে ঘুমোতে রাত ১টা-২টা, আবার ঘুম থেকে উঠেই মানুষ, বেডরুমের সামনে বসে আছে। শুক্রবার সহ যে কোন ছুটির দিনেও এর বিন্দুমাত্র ব্যাত্তয় নেই।

বলেছিলাম অন্তত বিদেশে একা ঘুরতে চল আমরা পরিবার একসাথে নিভৃতে নিজেদের মত করে খানিকটা সময় কাটাই। শুনে কি রাগই না করেছিলে তুমি।

বলেছিলে তোমার চার পার্টনার সঙ্গে চুনি-পান্না সহ আরও অনেকেও তোমার জীবনের অংশ। আমার ভীষণ জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয় আজ তাঁরা কোথায় ? তাঁদের আজকের ভূমিকা কি ?

যারা লুট-পাটের সাথে জড়িত নয় কিন্তু বিন্দুমাত্র প্রতিবাদও তাঁরা করেনি, আমাদের পাশে এসে দাঁড়ায়নি একটিবারের জন্যও। তাঁদেরকেও জীবনের অংশ মনে করতে। তুমি বুঝলে না এরা তোমার ভালোবাসার যোগ্য ছিল না কোন কালেও। যে যা কিছুই বলত যা কিছু চাইতো অন্ধ বিশ্বাসে অকুতোভয় পরিশ্রমী তুমি জান প্রাণ দিয়ে তাঁকে খুশী এবং সুখী করার চেষ্টা করতে। তাঁরা তোমার আবেগ আর অনুভূতি নিয়ে আসলে নিজেদের স্বার্থ-উদ্ধার করতো। শিশুকালে পিতৃ হারানো তুমি একটু ভালোবাসা, স্নেহ আর মায়ার কাঙাল ছিলে। তোমার পার্টনার যাদের তুমি বড় ভাই মনে করতে, প্রায় সমবয়সী যাকে তুমি তোমার বড় সন্তান বলতে তাঁরা কেবল সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছে, তোমায় ঠকিয়েছে।

তুমি নিজেও জানলে না আসলে তুমি কতোটা বিশুদ্ধ, মহৎ আর বড় মাপের মানুষ ছিলে, কতোটা সৎ আর সরল ছিলে।

অথচ এখন দূর এক গাঁয়ে নিথর নিস্তব্ধ নির্জনতায় কেবলই একা শুয়ে থাকা, নিশ্চিতর ঘুম। মাত্র ৪৮ বছরের এই পৃথিবীতে এতোটা দ্রোহ এতোটা সংগ্রাম,মানুষের জন্য এতোটা চিন্তা, ব্যস্ততা, দৌড়া-দৌড়ী, ছুটো-ছুটি ঘুমনোর সময়টুকু ছাড়া কখনো একা হতে না তুমি। তুমিহীন পৃথিবীতে সবাই, সবকিছু আজও আগের মতোই আছে, কেবল তুমিই নেই।

ভালো থেকো তুমি, শান্তিতে থেকো।

লেখক: প্রয়াত ডা. জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু-এর সহধর্মিণী।
পরিচালক, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ

আরও পড়ুন

সর্বশেষ