শুক্রবার, এপ্রিল ২৬, ২০২৪
প্রচ্ছদটপবইমেলার সূচনাপর্বের ইতিহাস

বইমেলার সূচনাপর্বের ইতিহাস

আধুনিক বিশ্বে এখন মেলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে সবাই। মেলা প্রয়োজনীয়—এই বিবেচনা থেকে বিভিন্ন রাষ্ট্র আজকাল মেলার আয়োজন করে। আর সেসব মেলায় ভিড় করে লাখ লাখ মানুষ। কেউ শুধু দেখতে যায়, কেউ ব্যবসার উদ্দেশ্যে, আবার কেউ হয়তো যায় মেলা থেকে নিজের ইচ্ছেমতো জিনিসপত্র কিনতে। আসলে মেলা সারা পৃথিবীতেই খুব জনপ্রিয়। দুনিয়ার ছোট ছোট গ্রাম থেকে শুরু করে বড় বড় শহরে মেলা বসে। তবে এই মেলা সংস্কৃতির শুরুটা কেমন ছিল? খানিকটা পেছন ফিরে তাকিয়ে চলুন জেনে নেওয়া যাক মেলার শুরুর দিককার গল্প। আর এর লেজে লেজ জোড়া দিয়ে একই সঙ্গে জানা যাক বইমেলার সূচনাপর্বের ইতিহাসও। প্রাচীন গ্রন্থ দ্য বুক অব এজেকিয়েল–এ লেখা হয়েছে, ‘তারশিশে একদল বণিক বসবাস করে। রুপা, লোহা, টিন এবং সিসার ব্যবসা করে তারা। এগুলোর জন্য তারা মেলা বসায়। মেলায় প্রচুর লোকের সমাগম হয়।’ ৫৮৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে চাকার ব্যবসা ছিল রমরমা। ওই বইয়ে আরও বলা হয়েছে, ‘চাকা কেনাবেচার জন্য একটা নির্দিষ্ট স্থানে প্রচুর লোক আসত।

শুরু থেকেই মেলার উদ্দেশ্য ছিল ব্যবসা। প্রাচীন মেলায় দূর-দূরান্ত থেকে নিজেদের স্থানীয় জিনিসপত্র নিয়ে আসত বণিকেরা। যদিও এই সব ব্যাপার ব্যাবিলনে বা এজেকিয়েল বইতে পরিষ্কার না। তবে ধারণা করা হয়, তখন মেলা বসার প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র কেনাবেচা। মেলাতে এখনো তা–ই করা হয়। ধর্মীয় দিক থেকে চিন্তা করলে মেলাকে পবিত্রও বলা যায়। কারণ ল্যাটিন শব্দ ‘feria’ যার অর্থ ‘Holy’ বা পবিত্র। বোঝাই যাচ্ছে  ‘ফেরিয়া’ (feria) থেকেই ‘Fair’ শব্দটি এসেছে। ফেরিয়া এমন একটি দিন, এই দিনে হাজার হাজার মানুষ একসঙ্গে প্রার্থনা করে। প্রভুর কাছে ক্ষমা চায়। এই দিনে মূলত মন্দির বা পবিত্র ঘরের চারপাশেই মানুষের সমাগম হয়। এথেন্স, রোম ও মক্কাতে এ রকম ঘটনা প্রচুর দেখা যেত। এবং সেখানে প্রতি ফেরিয়াতেই মেলা বসত।

খ্রিষ্টের জন্মের পরে কিং জনই বোধ হয় প্রথম মেলার আয়োজন করেন। তিনি মূলত কুষ্ঠরোগীদের হাসপাতাল রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এই মেলা বসিয়েছিলেন। কিন্তু ২০৭ খ্রিষ্টাব্দে মেলার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব দেওয়া হয়েছে ব্রিটেনের বিদ্রোহী সম্রাট ক্যারাউসিয়াসকে।

রোমানরা মধ্যযুগে বাজার আইনকে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছে বলে জানা যায়। ইউরোপে যা কিছুকে মেলা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল তা ছিল মূলত সাপ্তাহিক বাজার। আবার এটাও মনে করা হয়েছিল যে লিওনের প্রাচীন মেলাগুলো রোমানরাই শুরু করেছিল। ৪২৭ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হয় এই মেলা।

ব্রেমেন ফ্রি ফেয়ার জার্মানির প্রাচীনতম মেলাগুলোর একটি। এর এক সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে৷ সম্রাট দ্বিতীয় কনরাড ১০৩৫ সালে ব্রেমেন শহরকে এই মেলা আয়োজনের অনুমতি দিয়েছিলেন৷ মেলায় কৃষক, কারিগর ও ব্যবসায়ীরা স্বাধীনভাবে তাঁদের পণ্য বিক্রি করেন৷ হাজার বছর ধরে বাৎসরিক এই মেলা চলছে৷ অক্টোবরে ১৭ দিনের জন্য এই মেলাতে ৪০ লাখের মতো লোক জড়ো হয়।

একসময় মেলাকে ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র হিসেবেও দেখা হতো। স্পেন বা মেক্সিকোতে এর ব্যাপক প্রসার হয়েছিল। তখন তারা মেলাকে বলত গ্রেট ফেয়ার (great fair)। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র থেকে পোশাক, বাচ্চাদের খেলনা, তরবারি ইত্যাদি পাওয়া যেত এখানে; মানুষের সমাগম হতো প্রায় ৪০ থেকে ৫০ হাজার। ৬৪২ খ্রিষ্টাব্দে ফ্র্যাংকের রাজা সেন্ট ডেনিস সন্ন্যাসীদের এই জায়গাটি উপহার দিয়েছিলেন। মূলত ঈশ্বরকে ভালোবাসা ও সেন্ট ডেনিসকে সম্মানের খাতিরেই এই কাজটি তিনি করেছিলেন। সেখানে সন্ন্যাসীরা বিশাল আকারে মেলা বসাত, তাদের উদ্দেশ্য ছিল ব্যবসা। নিজেদের উপাসনালয়কে ঘিরেই মেলা বসাত তারা। হাজার হাজার মানুষ সেখানে অংশগ্রহণ করত। সবাই সেখানে ঈশ্বরের আরাধনা করতেই যেত এবং একই সঙ্গে মেলাও ঘুরে আসত।

নর্মান জাতি যখন ইংল্যান্ড দখল করে, তারপর থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে মেলা সংস্কৃতির সূচনা হয়। তখন পুঁজি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। কারণ পুঁজি ছাড়া তারা কোনো রাজ্যও ঠিকভাবে চালাতে পারবে না—তখন থেকেই এটা স্পষ্ট হয়েছিল। ১১৯৯ থেকে ১৪৮৩ সাল পর্যন্ত এই সব মার্কেট গড়ে ওঠে। ২৮০০-এরও বেশি অনুদান পায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি এসেছিল রাজা জন ও তৃতীয় হেনরির কাছ থেকে। ইংল্যান্ডে এই সময় চার্চের বিরাট প্রভাব ছিল। এমনও শোনা যায়, তখন চার্চের পাশে মাঝে মধ্যেই মেলা বসত।

গুজ ফেয়ার নামটি কীভাবে এসেছিল, সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু জানা যায় না। মেলাটি শুরু হয় ১২৮৪ সালের পরে। তখন ক্ষমতায় ছিলেন কিং এডয়ার্ড। সেন্ট ম্যাথিউ’র দিনে নটিংহামে মেলাটি বসত ঢাকঢোল পিটিয়েই। অনেকের মতে, দিনটি ছিল ২১ সেপ্টেম্বর। পরে অবশ্য এই মেলাটি বেশ কয়েকবার বন্ধ ছিল—প্লেগের প্রাদুর্ভাবের কারণে বন্ধ ছিল ১৬৪৬ সালে এবং দুটি বিশ্বযুদ্ধের সময়ও বন্ধ ছিল মেলাটি। ১৪৯২ সালে আমেরিকা আবিষ্কারের ৩০০ বছর পর এখানে প্রথম মেলা বসে। প্রথম মেলাটি বসে উইন্ডসোর, নোভা স্কোটিয়াতে। এখনো প্রত্যেক বছর ওই মেলা হয়। ভারত উপমহাদেশেও প্রচুর মেলা বসে। সেগুলোর প্রাচীন ইতিহাস আছে। আবার কিছু মেলা বসেছে এই সেদিন, কিন্তু এর জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। যেমন বইমেলা।

 বইমেলার ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। সারা বিশ্বে এখন বইমেলা হয়। সেসব মেলায়ও লাখ লাখ মানুষের ভিড়। যদিও বই আবিষ্কার হওয়ার আগ পর্যন্ত এই মেলার কথা কেউ চিন্তাও করেনি। কিন্তু যখন বইয়ের প্রচার–প্রসার এবং এর সংগ্রহ শুরু হলো, সেই সময় থেকেই বইয়ের একটা বাজার সৃষ্টি হয়। বইমেলার ধারণাটা অবশ্য আরও পরে এসেছে। প্রাচীন চীনারা বই সংগ্রহ শুরু করে ৯৬০ সালের পরে। তারা এর নাম দেয় ‘শানবিন’।  বইকে তারা খুবই গুরুত্ব দিত। তাদের সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে ধরে রাখার জন্যই বই সংগ্রহ শুরু করে চীনারা। পৃথিবীতে এই বই সংগ্রহের রীতিটি বেশ আগের—সক্রেটিসের আমলেও বই সংগ্রহের রীতিটি ছিল।

বইমেলা শুরুর পর এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাওয়া—এই ইতিহাস কিন্তু খুব বেশি দিনের নয়। ৫০০ বছর আগের কথা। খ্রিষ্টীয় পনেরো শতকে জোহানস গুটেনবার্গ মুদ্রণযন্ত্র বা ছাপাখানা আবিষ্কার করেছেন। বলা হয় সে সময়ই বইমেলার সূচনা হয় জার্মানিতে। অনেকের মতে, জার্মানির লিপজিগ শহরে প্রথম বইমেলা হয়েছিল। কিন্তু কারও কারও ধারণা আলাদা। তারা মনে করে, প্রথমে বইমেলা শুরু হয় ফ্রাঙ্কফুর্টে, লিপজিগ খুব বড় করে মেলার আয়োজন করায় ওটার নামই লোকজন জানত বেশি। তখন বইমেলাগুলো তেমন জনপ্রিয় না হলেও পরে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ১৭ শতকের পর ইউরোপসহ বিশ্বের আরও কিছু দেশে বইমেলা শুরু হয়।

সারা বিশ্বে এখন অনেকগুলো আন্তর্জাতিক বইমেলা হয়। সেখানে লোকজনের ভিড়ও দেখার মতো। তার মধ্যে অন্যতম বইমেলাগুলো হলো, লন্ডন বইমেলা, আন্তর্জাতিক কলকাতা পুস্তক মেলা, নয়াদিল্লি আন্তর্জাতিক বইমেলা, কায়রো আন্তর্জাতিক বইমেলা, হংকং বইমেলা, বুকএক্সপো আমেরিকা (বিইএ), আবুধাবি বইমেলা ইত্যাদি। আমাদের দেশেও অমর একুশে গ্রন্থমেলা নামে ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে বইমেলা হয়।

প্রথাগত বইমেলার বাইরে কিছু অন্য রকম বইমেলাও হয়। আমরা তো জানিই, শিশুরা কমিকসের খুব ভক্ত। কিন্তু অনেকেই হয়তো জানেন না, শুধু কমিকস নিয়ে প্রতি বছর জাপান ও হংকংয়ে মেলা হয়। হংকংবাসী একে বলে এনি-কম হংকং। প্রতি বছর আগস্টে  অনুষ্ঠিত হয় এই মেলা। জাপানে কমিকসের বইমেলাকে বলে কমিকেট বা কমিক মার্কেট। টোকিও শহরে প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসে এই মেলার আয়োজন করা হয়।

বর্তমানে সারা পৃথিবীতে নানান রকমের মেলা বসে। সেখানে মানুষ যায়ও। তবু মাঝেমধ্যে অবাকই লাগে, এখন যখন অনলাইনে অর্ডার দিলেই দ্রব্যটি পৌঁছে যাবে আপনার ঘরে, যখন হাতের নাগালেই পাওয়া যাচ্ছে সবকিছু এবং অনলাইনেও মেলা হচ্ছে, তখনো কষ্ট করে কেন মেলায় যায় মানুষ? তারা যায় নিজেদের মধ্যে সংযোগ ঘটাতে, আত্মার টানে।

সূত্র: বিবিসি, ফেয়ারসেন্ডএক্সপো ডটকম, এনসাইক্লোপিডিয়া ডটকম, উইকিপিডিয়া ডটকম ও ব্রিটানিয়া ডটকম

আরও পড়ুন

সর্বশেষ