শুক্রবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৪
প্রচ্ছদটপমহামানবের জন্মশতবার্ষিকী : গৌরাঙ্গ নন্দী

মহামানবের জন্মশতবার্ষিকী : গৌরাঙ্গ নন্দী

সবাই সবকিছু পারে না। এক একজন মানুষের বিশেষ বিশেষ ক্ষমতা বা গুণ থাকে, যা তাকে অন্যদের থেকে পৃথক করে। যে মানুষটির মধ্যে বিশেষ গুণাবলি অনেকগুলো, তিনি অনন্য। মানুষের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করা, আকৃষ্ট করা, বুঝতে এবং বুঝাতে পারা মানুষের অনন্য গুণগুলোর মধ্যে পড়ে। সব মানুষ পারে না অন্যদের বুঝতে এবং পরিস্থিতি যথাযথভাবে অনুধাবন করতে বা কোনো একটি বিষয়ে সকলকে এক কাতারে দাঁড় করাতেও পারে না। এই গুণ বা বৈশিষ্ট্য যেসব মানুষের থাকে, তিনি বা তাঁদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলী রয়েছে আর সেই কারণেই তাঁদেরকে নেতা বলা হয়ে থাকে।Mujib_100_Guideline_v4_copy-1-1024x590-1

যিনি অবস্থিত সমাজের অগ্রসরমান ব্যক্তি তিনি হলেন নেতা। নেতা নিজেকে ছাড়িয়ে অন্যের সমস্যা নিয়ে ভাবেন, সমস্যা সমাধানে আগুয়ান হন, সমাধান করে মানুষের সামনে দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠেন। মানুষও নেতাকে আস্থায় নেয়, তাঁদের সুখ-দু:খের সাথী বলে মনে করে, তাঁকে পথ-প্রদর্শক মনে করে। এ কারণে সাধারণ মানুষ নেতার কথা শোনে ও মান্য করে। তাঁর জন্যে জীবন উৎসর্গ করতেও পারে। আর নেতাও মানুষকে উদাত্ত আহ্বান জানাতে পারে। এমনি একটি অবস্থা, আমরা এই বাঙালি জাতির জীবনে দেখেছি। নেতা এলেন এবং তর্জনী উঁচিয়ে বললেন, ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা প্রস্তুত থাকবা; ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল।

একজন নেতা কতোটা আত্মবিশ্বাসী, জনগণের প্রতি আস্থাশীল হলে বলতে পারেন, ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি’। তিনি যদি হুকুম দিতে না পারেন, যদি দিক-নির্দেশনা দিতে না পারেন; অর্থাৎ সংশয় ছিল, যদি শত্রুপক্ষ তাকে তাঁর প্রিয় মানুষদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়; একারণেই তিনি বলেছেন, তখন নির্দেশনার জন্যে আর অপেক্ষা করার দরকার নেই। যার কাছে যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে যেন জনগণ ঝাঁপিয়ে পড়ে।

 হ্যাঁ, নেতার কথা জনগণ অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করেছে, পালন করেছে। সত্যিই নেতাকে শত্রুরা ধরে নিয়ে আটকে রেখেছে; আর জনতা নেতার আহ্বানে উদ্ববুদ্ধ হয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে মাঠে নেমেছে। মার খেয়েছে, মরেছে; মেরেছেও। যেহেতু শত্রুরা ছিল সংঘবদ্ধ, পরিকল্পিত আক্রমণে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, আর তাই তারা বাঙালিদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিল বলে সাধারণের ওপর বর্বর নির্যাতন করেছে। বাড়ি-ঘরে আগুন দিয়েছে। মা-বোনদের ওপর পাশবিক নির্যাতন করেছে। সম্পদ লুণ্ঠন করেছে। সর্বোপরি হত্যা করেছে বেশুমার।

বলা হয়, ত্রিশ লক্ষ শহিদের কথা, দু’লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম হারানোর কথা; প্রকৃতপক্ষে তার চেয়ে আরও বেশি মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে; লুটপাট, অগ্নিসংযোগের ফলে সম্পদহানিও হয়েছে বিপুল পরিমাণে। মানুষ অকাতরে ওই নেতার আহ্বানেই জীবন দিল, সম্ভ্রম বিলিয়ে দিলো, সম্পদ হারালো। সেই নেতা কে? কে সেই মহান মানুষ, মহামানব? তিনি আর কেউ নন; তিনি বাঙালির নয়নমণি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।ছাত্ররা ভালোবেসে তাঁকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু উপাধি পাওয়ার দুই বছর পর তিনি জনতাকে তর্জনী উঁচিয়ে আহ্বান জানালেন, আর মানুষ ওই নেতার ডাকে সাড়া দিয়ে আত্মোৎসর্গ করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হলো। দীর্ঘ ৯ মাসের লড়াই-সংগ্রাম-নিপীড়ন-হত্যাকাণ্ড শেষে দেশ দখলদার বাহিনী মুক্ত হলো।

নেতা জনতার মাঝে আবারও এলেন, প্রকৃতপক্ষে নেতাকে হাজির করতে প্রতিপক্ষরা বাধ্য হলো। নেতা মানুষের মাঝে এলেন। আবারও সেই উদাত্ত আহ্বান। এবারে দেশ গড়ার সংগ্রাম। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত, ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশটিকে আবারও সাজানো-গোছানোর পালা। জনতাও নেতাকে অনুসরণ করলো। তবে পরাজিত হায়েনারা থেমে ছিল না।

তারা সুযোগ বুঝে নেতাকে, নেতার পরিবারের সদস্যদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করলো। হত্যা করলো তাঁর প্রধান চার সহযোগীদের, যাঁরা নেতার অনুপস্থিতিতে যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল। অবশ্য, আগেই তাঁদেরকে জেলখানায় পোরা হয়েছিল, সেই জেলখানায় তাঁদেরকে হত্যা করা হলো। কি নির্মম! নিষ্ঠুরতা!! জাতি তাঁর পিতাকে হারিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। দিশাহীন হয়ে পড়ে। দেশটি ছেয়ে যায় কালো  অন্ধকারের দৈত্য-দানোরা এসে মানুষের ওপর খবরদারি করতে থাকে। মানুষদের পিষে মারতে থাকে। সকল ধরণের বর্বরতা নেমে আসে সবখানে। নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে না, বলে আইন করা হয়। ভাবা যায়, খুনিদের বিচার করা যাবে না, খুনিদের নিরাপদে দেশের বাইরে পাঠানো হয়। নিকষ কালো আঁধারে সময় শুষে নিতে থাতে। কতোদিন আর অন্ধকার যাত্রা চলতে পারে। মানুষ শিকলভাঙ্গার গান গেয়ে ওঠে, আবারও মানুষ ঘুরে দাঁড়ায়। ওই মহামানবের কন্যা -শেখ হাসিনা। এবার নতুন নেতা। ইস্পাত দৃঢ়কণ্ঠে, দৃপ্ত পদভারে ওই মানুষের ওপর ভর করেই এগিয়ে যাওয়া।

জনতার রায়ে ক্ষমতাসীন হয়ে ওই সেই কালো বাধা, পিতা হত্যার খুনিদের বিচার করা যাবে না, এ কলঙ্কতিলক মুছে ফেলা। খুনিদের বিচার করা এবং মুক্তিযুদ্ধকালের বিরোধিতাকারীদের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের সাজা দেওয়া। প্রচলিত আইনে সেসব যুদ্ধাপরাধী, মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো; আইনে অপরাধী সাব্যস্ত করে দণ্ড দেওয়া এবং তা বাস্তবায়ন করা। পাশপাশি দেশকে নেতৃত্ব দেওয়া। দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্যে একের পর এক দৃঢ় পদক্ষেপ নেয়া। এবং সবচেয়ে আশাপ্রদ, সুখকর হচ্ছে, যুদ্ধাপরাধীদের সাজা কার্যকর করে, পিতা হত্যার বিচার করে সেই পিতা, মহামানবের সাড়ম্বরে জন্মশতবর্ষ উদ&যাপন করা।

 হ্যাঁ, জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ। একশ’ বছর আগে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ ফরিদপুর অধুনা গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেয়া খোকা, শেখ মুজিবুর রহমান। যে ছাত্রাবস্থায়ই নেতৃত্ব গুণে অনেকের আস্থাভাজন হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে, ১৯৪৭ উত্তরকালে পূর্ব-পাকিস্তান পর্বে পাকিস্তানি প্রায় ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে তাঁর ধারাবাহিক লড়াই, মানুষকে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে একজোট করে পথে নামানো, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে দেশ স্বাধীন করা, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা-এ এক অনন্য কীর্তি। যা সকলের পক্ষে সম্ভব নয়। সম্ভব হয়েছিল একারণেই যে, মানব থেকে তিনি নিজেকে মহামানবে উন্নীত করেতে পেরেছিলেন। যা সকলে পারে না। কাল-ভদ্রে দু’-একজন পারে। সেই মানুষ বাঙালির আপনজন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের দিন থেকেই শুরু হচ্ছে জন্মদিনের ক্ষণগণনা। আসুন, তাঁর জন্মশতবছরে নানান আয়োজনের মধ্যে তাঁকে স্মরণ করি।

গৌরাঙ্গ নন্দী : সাংবাদিক, লেখক ও গবেষক। খুলনা অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যা এবং পরিবেশ বিষয়ক  একাধিক গ্রন্থপ্রণেতা।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ