শুক্রবার, এপ্রিল ২৬, ২০২৪
প্রচ্ছদটপভাষা সৈনিক, কিংবদন্তি ছাত্রনেতা দবিরুল ইসলামের ৫৯তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ ।

ভাষা সৈনিক, কিংবদন্তি ছাত্রনেতা দবিরুল ইসলামের ৫৯তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ট সহচর ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, ভাষা সৈনিক, কিংবদন্তি ছাত্রনেতা মুহম্মদ দবিরুল ইসলামের ৫৯তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ ।FB_IMG_1578886094778

বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নাম কিংবদন্তি ছাত্রনেতা বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য অ্যাডভোকেট দবিরুল ইসলাম। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূচনা পর্বে যে কয়জন সাহসী সূর্যসন্তান তত্কালীন পাকিস্তান সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন, দবিরুল ইসলাম ছিলেন সেই সাহসী সারথিদের অন্যতম। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ আন্দোলন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের ন্যায্য আন্দোলন, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন, যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন—এসবের পেছনে অসামান্য অবদান রেখেছেন এই মেধাবী ও তেজোদীপ্ত ছাত্রনেতা দবিরুল ইসলাম।

দবিরুল ইসলাম বৃহত্তর দিনাজপুরের তত্কালীন ঠাকুরগাঁও মহকুমার বামুনিয়া গ্রামে ১৯২২ সালের ১৩ মার্চ এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছাত্রাবস্থায়ই তিনি মেধার স্বাক্ষর রাখা শুরু করেন। লাহিড়ী এম ই হাই স্কুল থেকে বিভাগীয় বৃত্তি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় রাজশাহী বিভাগীয় ‘মায়াদেবী উন্মুক্ত রচনা প্রতিযোগিতা’য় লাভ করেন স্বর্ণপদক। এরপর ১৯৩৮ সালে ঠাকুরগাঁও থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে ভর্তি হন রাজশাহী সরকারি কলেজে। এখান থেকে আইএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন মেধাতালিকায় চতুর্থ স্থান নিয়ে। ১৯৪৭ সালে প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করে বিএ পাসের পর আইন বিভাগে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগেই দিনাজপুরে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের জন্য তখনই ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান আমার বাবা দবিরুল ইসলাম। তাই ১৯৪৬ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠেয় গণতান্ত্রিক যুবলীগের কর্মী সম্মেলনে ডাক পড়ে তাঁর। সেই সম্মেলনে দবিরুল ইসলামের সঙ্গে আরো যোগ দেন মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, এম আর আখতার মুকুল, আব্দুর রহমান চৌধুরী, রিয়াজুল ইসলাম প্রমুখ। সেদিন গণতান্ত্রিক যুবলীগের কর্মী সম্মেলনে এক আগুনঝরা বক্তব্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তত্কালীন ছাত্রনেতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হন তিনি। এরপর ১৯৪৮ সালে সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের প্রথম আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হলে আহ্বায়ক হন রাজশাহীর নঈমুদ্দিন আহম্মেদ। নবগঠিত এই কমিটিতে ফরিদপুর থেকে শেখ মুজিবুর রহমান, কুমিল্লা থেকে অলি আহাদ এবং দিনাজপুর থেকে দবিরুল ইসলামসহ মোট ১৪ জন প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত হন। কমিটির নেতাদের অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা, মেধা আর পরিশ্রম পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম আওয়ামী লীগ গঠনের প্রক্রিয়াকে কয়েক ধাপ এগিয়ে নেয়। চলতে থাকে পাকিস্তানবিরোধী ও রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করার দুর্বার আন্দোলন। সারা দেশের মতো দিনাজপুরেও ছড়িয়ে পড়ে এ আন্দোলনের উত্তাপ। তখন দিনাজপুরে দবিরুল ইসলাম, নুরুল হুদা, কাদের বক্স (ছোটি ভাই), এম আর আখতার মুকুলসহ অনেকেই ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ আন্দোলন প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছিলেন। এরই মধ্যে দিনাজপুরের সুরেন্দ্রনাথ কলেজের (বর্তমানে সরকারি মহিলা কলেজ) এক ছাত্র জনসভায় বক্তব্য দিতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন দবিরুল ইসলাম। দিনাজপুর জেলখানায় তাঁকে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। বেয়নেট দিয়ে তাঁর বুকে আঘাত করা হয়। নির্মম নির্যাতন ও অত্যাচারের কারণে আমার বাবার স্বাস্থ্য চিরতরে ভেঙে যায়। বঙ্গবন্ধুসহ বেশ কয়েকজন নেতা দবিরুল ইসলাম ও অন্য ছাত্রনেতাদের প্রতি এ রকম নির্যাতনের খবর শুনে দিনাজপুরে ছুটে যান। যা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে উল্লেখ করেছেন। এরই মাঝে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ন্যায্য আন্দোলন বেগবান করার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যদের সঙ্গে দবিরুল ইসলামও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আজীবন বহিষ্কৃত হন।

এদিকে রাষ্ট্রভাষা অধিকার বাস্তবায়নের দাবির মধ্য দিয়ে ১৯৪৯ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রথম কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এ অধিবেশনে দবিরুল ইসলাম ঢাকা জেলখানায় অন্তরীণ থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্য ছাত্রনেতাদের সার্বিক সম্মতি ও মতামতের ভিত্তিতে দেশের ইতিহাসে দবিরুল ইসলামকে ছাত্রলীগের প্রথম কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচন করা হয় এবং ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত তিনিই সভাপতি ছিলেন। কমিটি হওয়ার কিছুদিন পর জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আবারও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর রোষানলে পড়েন তিনি। আবার তাঁকে গ্রেপ্তার করে জেলখানায় ঢুকিয়ে দেয় পাকিস্তান সরকার। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে ঠাকুরগাঁও আসনের জন্য মনোনয়ন পেয়ে বিপুল ভোটের ব্যবধানে মুসলিম লীগের তত্কালীন বাঘা নেতা নুরুল হককে পরাজিত করে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (এমএলএ) নির্বাচিত হন দবিরুল ইসলাম। পরে ১৯৫৪ সালের ৩০ আগস্ট পাকিস্তান সরকার যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দিলে আবারও পাকিস্তানবিরোধী মনোভাব দেশজুড়ে তুঙ্গে ওঠে। এরই মধ্যে ১৯৫৬ সালে আবু হোসেন সরকারের নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রিসভায় স্থান করে নেন দবিরুল ইসলাম। তিনি প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি (শিল্প, বাণিজ্য ও শ্রম) নিযুক্ত হন। এ সময় তিনি ঠাকুরগাঁওয়ে একটি সুগার মিল স্থাপনের জন্য তত্কালীন সরকারের কাছে জোরালো দাবি তুলে ধরেন।

বারবার কারাভোগ এবং জেলখানার ভেতরে অমানুষিক নির্যাতনের কারণে তিনি ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন ঠিকই, তার পরও দেশ ও জনগণের মুক্তির জন্য বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে রাজপথে নিজেকে সর্বদা সরব রেখেছিলেন। অবশেষে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম আন্দোলনের এ অগ্রসৈনিক, বিরল প্রতিভার অধিকারী মুহম্মদ দবিরুল ইসলাম ১৯৬১ সালের ১৩ জানুয়ারি মাত্র ৩৮ বছর বয়সে তাঁর নিজ গ্রাম বামুনিয়ায় মৃত্যুবরণ করেন।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ