সীমানা নির্ধারণ নিয়ে আবারো জটিলতায় পড়েছে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন। উচ্চ আদালতের রায়ের পর দ্রুত নির্বাচনের যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, তা এখন অনেকটাই বিলম্বিত হতে চলেছে। সুলতানগঞ্জ ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত ডিসিসি দক্ষিণের ৫৭ নম্বর ওয়ার্ডের সীমানা বিষয়ক সমস্যার সমাধান না করে আবারো তফসিল ঘোষণা করতে চায় না নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কমিশনের এক বৈঠকে গতকাল মঙ্গলবার ডিসিসি নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। বৈঠকে সীমানা সংক্রান্ত বিষয় সমাধান না হওয়া পর্যন্ত ডিসিসি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা থেকে ইসি বিরত থাকবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।
ইসি সূত্রে জানা যায়, ডিসিসি নিয়ে গত ১৩ মে উচ্চ আদালতের এক রায়ে আইনি বাধা কাটলেও সুলতানগঞ্জের ১৩টি এলাকা ডিসিসির অন্তর্ভুক্ত না করার কারণে নতুন করে আবারো জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। তাই এ নিয়ে নতুন জটিলতা এড়াতে এখনই ডিসিসির তফসিল দিতে চায় না কমিশন। ইসি মনে করছে, ডিসিসির তফসিল ঘোষণা হলেই সীমানা জটিলতায় আবারো আটকে যেতে পারে এ নির্বাচন। এতে জাতীয় নির্বাচনের আগে আর দুই ডিসিসির নির্বাচন করা সম্ভব নাও হতে পারে। সুলতানগঞ্জের এই ১৩টি এলাকা বাদ দিলে আইনের ব্যত্যয় ঘটবে। এেেত্র কিছু সময় বেশি লাগলেও সীমানা পুনর্নির্ধারণ করে বা আইনগত জটিলতা দূর করে তফসিল ঘোষণা করতে চায় ইসি।
উল্লেখ্য, সুলতানগঞ্জ ইউনিয়নকে ঢাকার দণি সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত করে এসআরও জারি করা হয়। এটিকে ৫৭ নম্বর ওয়ার্ড ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু এখনো এই ওয়ার্ডের সীমানা নির্ধারণ করা হয়নি।
এদিকে সিটি করপোরেশনভুক্ত নতুন ১৩টি এলাকাকে ওয়ার্ডভুক্ত করার বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে গত ৯ মে স্থানীয় সরকার বিভাগের মতামত চায় ইসি সচিবালয়। জবাবে সুলতানগঞ্জের ওই ১৩টি এলাকাকে ওয়ার্ডভুক্ত না করেই ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন আয়োজনের অনুরোধ জানায় স্থানীয় সরকার বিভাগ।
এ বিষয়ে কমিশনার শাহনেওয়াজ জানান, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে ৫৭ নম্বর ওয়ার্ড বাদ দিয়েই ডিসিসি নির্বাচনের আয়োজন করতে বলা হয়েছে। কিন্তু কমিশন মনে করে, এটি করা হলে আবারো মামলা-মোকদ্দমা হতে পারে। আর আইনি জটিলতা তৈরি হলে নির্বাচন ঝুলে যাবে। সুলতানগঞ্জকে ডিসিসি নির্বাচন থেকে বাদ দিতে গেলে আইনি জটিলতায় নির্বাচন পিছিয়ে যাবে, যে ফাঁদে পা দিতে চায় না ইসি।
তাই কমিশনের প থেকে আবারো স্থানীয় সরকারকে চিঠি দেয়া হবে বলে জানান তিনি। সেখানে সুলতানগঞ্জ ইউনিয়নকে সিটি করপোরেশনের বাইরে রাখতে বা সীমানা নির্ধারণ করে অন্তর্ভুক্ত করতে বলা হবে। তবে রমজানের পর ডিসিসি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হতে পারে। রমজানের আগে ডিসিসি নির্বাচনের কোনো সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেন এই কমিশনার।
কমিশন সূত্রে জানা যায়, সুলতানগঞ্জকে ডিসিসি থেকে বাদ দিয়ে এই মুহূর্তে নির্বাচন করতে গেলে তা ‘স্থানীয় সরকার সিটি করপোরেশন আইন ২০০৯’-এর ৪-এর ২ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী হয়ে যাবে। কেননা,
এ অনুচ্ছেদের বিধান মতে এলাকাটিকে আইন মেনে পুনর্বিন্যাস করতে গেলে বেশ কয়েকমাস সময় লাগতে পারে। ফলে এ জটিলতায় ডিসিসি নির্বাচন পিছিয়ে যাবে। তবে দ্রুত এলাকাটি পুনর্বিন্যাস ও তফসিল ঘোষণা করা হবে বলেও কমিশন সূত্রে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন সচিব ড. মোহম্মদ সাদিক বলেন, একটি এলাকা পুনর্বিন্যাস করতে গেলে ৫ থেকে ৬ মাস সময় লেগে যায়। সে ক্ষেত্রে যতো দ্রুত সম্ভব হয় সুলতানগঞ্জকে অন্তর্ভুক্ত করে সীমানা নির্ধারণ করতে হবে নয় তো ডিসিসি থেকে তা বাদ দিতে হবে।
উল্লেখ্য, আইনের ৪-এর ২ অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, ‘কোন এলাকা সিটি করপোরেশন এলাকার অন্তর্ভুক্ত করা হইলে, এ আইন, বিধি, প্রবিধান, এ আইনের অধীন প্রদত্ত সকল আদেশ নির্দেশ ও মতা উক্ত এলাকায় প্রযোজ্য হইবে।’
প্রসঙ্গত বলা যায়, এর আগে গত বছরের এপ্রিলে দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। সে অনুযায়ী গেলো বছরের ২৪ মে নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত এর ওপর স্থগিতাদেশ দেন। গত ১৩ মে সেই রিট খারিজ করে হাইকোর্ট স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করলে আইনি বাধা কাটে।
গত বছর ডিসিসির তফসিল ঘোষণা করার পরে রাজধানীবাসীর মধ্যে নির্বাচনী আবহ তৈরি হয়। কমিশন দুটি ভাগের জন্য মনোনয়নপত্র বিক্রি ও জমা নেয়ার জন্য ডিসিসি উত্তরের আগারগাঁওয়ে এবং ডিসিসি দক্ষিণের জন্য মহানগর নাট্যমঞ্চে অস্থায়ী অফিস খোলে। এ সময় সব দলের বেশ কয়েকজন মেয়র পদের প্রার্থী মনোনয়নপত্রও কেনেন। তাছাড়া প্রচুর কাউন্সিলর পদের মনোনয়নপত্রও বিক্রি হয়। রাজধানীতে ছড়িয়ে পড়ে নির্বাচনী আবহ। প্রার্থীদের পক্ষ থেকে বিলবোর্ড ও ফেস্টুনে ভরে যায় ডিসিসি। কোথাও নির্বাচনের পক্ষে চলে প্রচারণা।
কিন্তু হিউম্যান রাইটস এন্ড পিস ফর বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট বিশিষ্ট আইনজীবী এডভোকেট মনজিল মোরশেদের হাইকোর্টে করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত তিন মাসের জন্য ডিসিসি নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করেন। এ রিটে ডিসিসির ভোটার লিস্ট হালনাগাদ নয় এবং ডিসিসি দুই ভাগ হওয়াতে এর সীমানা নির্ধারণ সঠিক হয়নি বলে অভিযোগ করা হয়। আদালত এ দুটি কাজ হালনাগাদ করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দেন।
এর পরে ইসি সীমানা নির্ধারণ বিষয়টি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বিভাগের কাজ বলে তাদের চিঠি দেন। কিন্তু স্থানীয় সরকার বিভাগের তরফ থেকে কোনো কাজই করা হয়নি। এর পরে আদালত আবারো তিন মাসের জন্য নির্বাচন স্থগিত করেন। পরে আরো তিন মাসের জন্য নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা হলে সর্বমোট ৯ মাসের স্থগিতাদেশের জালে জড়িয়ে যায় ডিসিসি নির্বাচন।
সে কারণে গত বছরের নভেম্বরে ইসি ভোটার লিস্ট হালনাগাদ করতে বাধ্য হয় এবং এ বিষয়ে আদালতকে অবহিত করে ইসি। সর্বশেষ গত ১৩ মে আদালত ডিসিসি নির্বাচনের ওপর থেকে স্থগিতাদেশ তুলে নিলে এ নির্বাচন নিয়ে আর কোনো বাধা নেই বলেও কমিশন সূত্রে জানানো হয়। ১৩ মের পর গত কয়েকদিন যাবৎ ইসির তরফ থেকে বলা হয়েছে, ২-১ দিনে মধ্যে তফসিল ঘোষণা করা হবে। এ বিষয়ে আর কোনো সমস্যা নেই।
এ দিকে ডিসিসি নির্বাচন ঈদের আগে বা পরে যে কোনো সময় হতে পারে বলে গণমাধ্যমে প্রচার হয়। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এ বিষয়ে আলোচনাও শুরু হয়। কবে ঘোষণা হবে তফসিল তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা। গত কয়েকদিনে রাজধানীর উত্তর ও দক্ষিণে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন প্রার্থীর পক্ষে ব্যানার ও ফেস্টুনও টাঙানো হয়। এমনই অবস্থায় আবারো ডিসিসি নির্বাচন নিয়ে পাকালো জট, অনিশ্চিত হয়ে পড়লো কাক্সিক্ষত এ নির্বাচন।
উল্লেখ্য, ২০০৭ সালের মে মাসে অবিভক্ত ডিসিসির নির্বাচনের মেয়াদ শেষ হয়। ২০১১ সালের নভেম্বরে ৫৬টি ওয়ার্ড নিয়ে দণি ও ৩৬টি ওয়ার্ড নিয়ে উত্তর নামে দুই ভাগ হয় ডিসিসি। সে হিসেবে মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার ৬ বছর অতিবাহিত হলেও ডিসিসি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি।