শনিবার, এপ্রিল ২০, ২০২৪
প্রচ্ছদচট্রগ্রাম প্রতিদিনজাবেদ-নওফেল রাজনীতিতে দুই ভাগ্যবান

জাবেদ-নওফেল রাজনীতিতে দুই ভাগ্যবান

চট্টগ্রামের আওয়ামী রাজনীতির সোনালী অর্জন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু  ও এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। স্ব স্ব অবস্থান থেকে দুই নেতাই আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করেছেন। জীবনবাজি রেখে দুঃসময়েও দলকে  এগিয়ে নিয়ে গেছেন। জীবদ্দশায় রাজনীতির এই দুই বটবৃক্ষের মধ্যে কখনো বা মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব, ব্যক্তিত্বের সংঘাত থাকলেও দলের স্বার্থে, দলের প্রয়োজনে তারা ছিলেন এক, ঐক্যবদ্ধ।

রাজনীতির এই দুই সূর্যসন্তান জীবনের শেষদিন পর্যন্ত দল, রাষ্ট্র ও সমাজকে দিয়ে গেছেন অকাতরে। বিনিময়ে রাজনীতি থেকে সম্মান, যশ, খ্যাতি অনেক কিছুই পেয়েছেন তারা। সেই অনেক কিছু পাওয়ার মাঝেও তাদের না পাওয়ার বেদনা আছে। আছে নীলকষ্ট। বর্ষীয়ান এই দুই নেতার কেউ জীবনে একবার মন্ত্রী হননি। মন্ত্রী দূরের বিষয়, একটিবারের জন্যও সংসদেও যেতে পারেননি মহিউদ্দিন চৌধুরী। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত অধরা থেকে যায় তাঁর সেই স্বপ্ন।

১৯৮৬ সালে জীবনে প্রথমবারের মতো চট্টগ্রামের রাউজান থেকে সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করেছিলেন এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। লুঠপাট, ভোট ডাকাতির সেই নির্বাচনে জাতীয়পার্টির প্রার্থী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর কাছে হারতে হয় তাঁকে। ১৯৯১ সালে চট্টগ্রাম -৯ (কোতোয়ালী) আসন থেকে নির্বাচন করে মহিউদ্দিন চৌধুরী মাত্র ১০৩৯ ভোটে পরাজিত হন বিএনপি প্রার্থী আবদুল্লাহ আল নোমানের কাছে।

১৯৯৪ সালের ৩০ জানুয়ারি দলের সমর্থন নিয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচিত মেয়র হন মহিউদ্দিন চৌধুরী। এরপর ২০০১ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবং ২০০৫ সালে চারদলীয় জোটের তৎকালীন প্রভাবশালী মন্ত্রী মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দীনকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে তৃতীয়বারের মত মেয়র হন তিনি। ২০১০ সালে রাজনৈতিক শিষ্য প্রাক্তন ওয়ার্ড কাউন্সিলর এম মনজুর আলমের কাছে পরাজিত হওয়ার পর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ঘোষণা দেন তিনি আর মেয়র পদে নির্বাচন করবেন না। এরপরও একটা প্রচ্ছন্ন ইচ্ছা থেকে যায় জীবনে একটিবার সংসদে যাবার।

ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে অনির্ধারিত আলোচনা, ঘরোয়া বৈঠকেও সেই মনোবাসনার ইঙ্গিত পাওয়া গেলেও অবশ্য কখনো প্রকাশ্যে বলেননি তিনি সংসদে যাবেন অথবা মন্ত্রী হবেন। টানা দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর গুন্জন ওঠে টেকনোক্রেট কোটায় মহিউদ্দিন চৌধুরী মন্ত্রী হচ্ছেন বা হবেন। যদিও মহিউদ্দিন চৌধুরী মন্ত্রীত্বের অফার ফিরিয়ে দিয়েছেন বলেও গুন্জন আছে মহিউদ্দিন-শিবিরে।  তবে সব গুন্জন ছাপিয়ে এটাই সত্য, জীবনে একটিবার সংসদে যেতে চেয়েছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। কিন্তু সেটি তার ভাগ্যে জোটেনি বা হয়ে উঠেনি।

মৃত্যুর আগে জ্যেষ্ঠ সন্তান ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। এ লক্ষ্যে ২০১৩ সালে গঠিত চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটিতে সদস্যপদ দেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। এরপর মৃত্যুর আগে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগে পুত্রের একটি স্থান দেখে যেতে চেয়েছিলেন তিনি। তার জীবদ্দশাতেই ২০১৬ সালের ২৪ অক্টোবর আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা মহিউদ্দিন-পুত্র নওফেলকে ভালোভাবেই জায়গা করে দেন।  এক লাফে সাংগঠনিক সম্পাদক বানিয়ে দেন প্রাচীন এই রাজনৈতিক দলের। রাজনীতিতে নবাগত পুত্রের বিশাল এই প্রাপ্তির ‘তৃপ্তি’ নিয়ে ২০১৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর চিরদিনের জন্য বিদায় নেন মহিউদ্দিন চৌধুরী।

এরপর ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের সবচেয়ে প্রেস্টিজিয়াস আসন খ্যাত চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থেকে দলের মনোনয়ন দিয়ে এমপি করে আনেন এবং ৬ জানুয়ারি ২০১৭ সালে তাঁর গঠিত মন্ত্রীসভার কনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে নওফেলকে স্থান দেন শিক্ষা উপমন্ত্রী হিসেবে। ২০১৬ সালের ২৪ অক্টোবর থেকে ২০১৯ সালের ৬ জানুয়ারি। দুইবছর দুই মাস ১২ দিনের মাথায় বাবার পরিচয়ে নওফেল হয়ে ওঠেন দলের সাংগঠনিক সম্পাদক থেকে এমপি অতপর উপমন্ত্রী।

অপরদিকে, বর্ষীয়ান নেতা আওয়ামী লীগের আশ্রয়-ছায়া খ্যাত আখতারুজ্জান চৌধুরী বাবুর বেলায়ও ঘটেছে অনেকটা একই ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিয়ন ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি এবং পরে নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবসা প্রশাসনে অ্যাসোসিয়েট ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে ১৯৬৫ সালে ব্যবসায় যুক্ত হন বাবু।  ১৯৬৭ সালে দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগ কার্যকরী কমিটির সদস্য পদের মাধ্যমে রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে পিছনে আর ফিরতে হয়নি আখতারুজ্জামান বাবুকে। নিজের অর্থ-সম্পদ বিলিয়ে দিয়ে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশই শুধুই নেননি; মুুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অন্যদের সংগঠিত করেন। ১৯৭২ সালে ৩৭ বছর বয়সে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন বাবু। ১৯৮৬ সালে আনোয়ারা-পশ্চিম পটিয়া আসন থেকে দ্বিতীয়বার সাংসদ নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসছে তা অনেকটাই নিশ্চিত নানা সমীক্ষা-বিশ্লেষণে। ওই সময়ের তুমুল জনপ্রিয় নেতা আখতারুজ্জামান বাবুর ধারণা ছিল, দল ক্ষমতায় আসলে তিনি নিশ্চিত মন্ত্রী হবেন। চট্টগ্রামের আনোয়ারা-পশ্চিম পটিয়া এবং সাতকানিয়া লোহাগাড়া দুইটি আসনে থেকে নির্বাচন করে আনোয়ারা আসনে জয়ী হন বাবু। কিন্তু আওয়ামী লীগ নয়, সরকার গঠন করে ওই সময়ের নবাগত বিএনপি।

১৯৯৬ সালে ১২ জুনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে শিল্পপতি হুমায়ুন জহির হত্যা মামলায় জড়িয়ে দেশ ছাড়েন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলেও বাবু দেশে নেই। এমনকি নির্বাচনেও অংশ নিতে পারেননি। তার আসনে আওয়ামী লীগের আরেক বর্ষীয়ান নেতা আতাউর রহমান খান কায়সার নির্বাচন করেও বিএনপির সারোয়ার জামাল নিজামের কাছে পরাজিত হন।  সেই যাত্রায় মন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নটি আর পূরণ হলো না বাবুর।

২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকার গঠন করে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট। সেবার এমপিও হতে পারেননি আখতারুজ্জমান বাবু। এরপর এক-এগারোর দুঃশাসন, জুলুম রক্তচক্ষু ছাপিয়ে আখতারুজ্জামান বাবুর সামনে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচন। সেই নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট। বিপুল ভোটে এমপি হন বাবু। কেবল তিনি নন, রাজনীতি-সচেতন সকলেই ধরে নিয়েছিলেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু নিশ্চিত মন্ত্রী হচ্ছেন। কিন্তু মন্ত্রীসভা থেকে ছিটকে পড়েন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, তোফায়েল আহমেদ, আব্দুর রাজ্জাক, আমির হোসেন আমু, সুরন্জিত সেন গুপ্ত, ওবায়দুল কাদেরের মত আওয়ামী রাজনীতির বটবৃক্ষরা। সেবার মন্ত্রীসভায় জায়গা করে নেন রাজনীতিতে অপেক্ষাকৃত তরুণ ও নবীনরা।

মন্ত্রী হওয়া কিংবা গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়ানোর ‘স্বপ্ন’ বারবার বাধাগ্রস্ত হওয়ার পরও দলীয় আনুগত্য, নীতি-আদর্শের বাইরে যাননি আখতারুজ্জামান চৌধুরী। বরং পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতির পদটিকেই ‘প্রধানমন্ত্রীর বড় উপহার ভেবে’ গাড়িতে সংসদীয় পতাকা, পুলিশ প্রটোকল আর গানম্যান নিয়ে মন্ত্রীত্বের স্বাদ বা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে দেখা যেত দলের এই প্রবীণ নেতাকে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ১৩ নভেম্বর নগরের এক কমিউনিটি সেন্টারে আখতারুজ্জামান বাবুর স্মরণসভায় আখতারুজ্জামান বাবুর মন্ত্রীত্ব না পাওয়ার প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, বাবু ভাইয়ের মন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছা ছিল, নেত্রীরও ইচ্ছা ছিল। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস তিনি বেশিদিন বেঁচে থাকেননি। নেত্রী আমাকে বললেন, বাবু ভাইকে আমি কিছু দিতে পারলাম না। বাবু ভাইকে মন্ত্রী করতে পারলে আমার ভালো লাগতো। কিন্তু তিনি বেঁচে থাকেননি।

২০১২ সালের ৪ নভেম্বর মন্ত্রীত্বের স্বাদ অপূর্ণ রেখেই পরপারে পাড়ি জমান আওয়ামী রাজনীতির অত্যুজ্জ্বল সম্পদ আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। তাঁর মৃত্যুতে শূন্য হওয়া আসনের উপ নির্বাচনে তাঁর জ্যেষ্ঠ সন্তান সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদকে এমপি করে আনেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সদস্য করেন জাবেদকে। ২০১৩ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে দ্বিতীয়বার এমপি হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী জাবেদকে ভূমিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন।  ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে তৃতীয় বারের মতো এমপি করে জাবেদকে ভূমি মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রী করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এ প্রসঙ্গে ওবায়দুল কাদের আখতারুজ্জামান চৌধুরীর স্মরণসভায় বলেন, বাবু ভাইয়ের কথা স্মরণ করে তার রক্তের উত্তরসূরি সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদকে নেত্রী আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সদস্য করেছিলেন এবং তাকে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বও দিয়েছিলেন। পরে নিজের যোগ্যতা, সততা দিয়ে জাবেদ পূর্ণমন্ত্রী হয়েছেন। নেত্রী তাকে প্রতিমন্ত্রী থেকে পূর্ণমন্ত্রী করার আগে আমাকে বলেছেন, চট্টগ্রাম থেকে জাবেদকেও পূর্ণমন্ত্রী করতে হয়। তার সততা আছে। জাবেদ পূর্ণমন্ত্রী হয়েছে তার সততা দিয়ে।

আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ও এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী জীবদ্দশায় যা পাননি, তাদের বদৌলতে তা-ই পেয়েছেন তাদের দুই পুত্র যথাক্রমে সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ ও ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। বুধবার নগরের একটি কমিউনিটি সেন্টারে বাবুর স্মরণসভায় পাশাপাশি আসনে বসে এই দুই বরপুত্রের খোশগল্প, হাস্যরসমূলক কথাবার্তার অনন্য এক ফ্রেম চোখে পড়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত অনেকের। দর্শক সারিতে বসা এক প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা দুই দিকপালের দুই সন্তানের এমন প্রাণবন্ত, হাস্যোজ্জ্বল দৃশ্য দেখে বলে উঠেন, জাবেদ-নওফেল সত্যিকার অর্থেই রাজনীতিতে দুই ভাগ্যবান তরুণ। বাবার যোগ্যতায় তারা আজ মন্ত্রী-এমপি। রাজনীতিতে তাদের টিকে থাকতে হবে নিজেদের যোগ্যতায়। রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনে তাদেরকেই বেশি ভূমিকা রাখতে হবে। তাদের কাছে মানুষের প্রত্যাশা বেশি। কারণ তারা আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ও এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী পুত্র।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ