বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২৫, ২০২৪
প্রচ্ছদটপফুলেল শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় সাদেক হোসেন খোকাকে চিরবিদায়

ফুলেল শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় সাদেক হোসেন খোকাকে চিরবিদায়

একাত্তরের রণাঙ্গনের বীর যোদ্ধা, অবিভক্ত ঢাকার সর্বশেষ মেয়র ও বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকাকে চিরবিদায় জানিয়েছেন সহযোদ্ধা, রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও সমাজের সর্বস্তরের মানুষ। দিনের আনু্ষ্ঠানিকতা শেষে ৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদকে  জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা

৪ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ম্যানহ্যাটনে মেমোরিয়াল স্লোয়ান ক্যাটারিং ক্যান্সার সেন্টারে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সাদেক হোসেন খোকা। তিনদিন পর ৭ নভেম্বর সকাল সাড়ে ৮টায় রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে খোকার মরদেহ এসে পৌঁছায়।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু তার মরদেহ গ্রহণ করেছেন। বিমানবন্দর থেকে খোকার মরদেহ জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় নেওয়া হয়। বেলা ১১টায় সাবেক এই সংসদ সদস্যের প্রথম জানাজা হয়। পরে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য মরদেহ নেওয়া হয় শহীদ মিনারে। শহীদ মিনার থেকে বাদ জোহর নয়াপল্টনে বিএনপির দলীয় কার্যালয়ে নেওয়া হয়। নয়াপল্টনের জানাজা শেষে বিকেল ৩টায় খোকার মরদেহ নেওয়া হয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ভবনে। সেখানে জানাজার পর মরদেহ নেওয়া হয় গোপীবাগে সাদেক হোসেন খোকার নিজ বাসভবনে। ধূপখোলা মাঠে জানাজার পর জুরাইন কবরস্থানে বাবা-মায়ের পাশে সাদেক হোসেন খোকাকে দাফন করা হয়।

এদিকে অবিভক্ত সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার মৃত্যুতে তার স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে সিটি করপোরেশনের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী অফিস ছুটি ঘোষণা করা হয়। ফলে বৃহস্পতিবার করপোরেশনের প্রধান কার্যালয় নগর ভবনসহ আঞ্চলিক কার্যালয়গুলো বন্ধ ছিল। তবে জরুরি সেবা এই ছুটির আওতামুক্ত ছিল।

সংসদ ভবন প্লাজায় প্রথম জানাজা: বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকার প্রথম জানাজা সকাল ১১টা ১২ মিনিটে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় অনুষ্ঠিত হয়।  সাদেক হোসেন খোকার দুই ছেলে ইশরাক হোসেন ও ইসহাক হোসেন ছাড়াও সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক মৎস্য ও পশুসম্পদমন্ত্রী আবদুল্লাহ আল নোমান, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান, বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক উপমন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হাজি সেলিম, জাতীয় পার্টির মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গাঁ, বিকল্পধারা বাংলাদেশের মহাসচিব মেজর (অব.) মান্নান, জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশিদ, এলডিপির মহাসচিব ড. রেদওয়ান আহমেদ, কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম খোকার জানাজায় উপস্থিত ছিলেন। জানাজা শেষে জ্যেষ্ঠ এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান সহযোদ্ধা, বিভিন্ন রাজতিক দল ও সংগঠনের নেতারা। এরপর সাদেক হোসেন খোকাকে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য বেলা ১ টা ২০ মিনিটে নেওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে।

শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা: সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা জানাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেওয়া হয় সাদেক হোসেন খোকার মরদেহ। সংসদ প্লাজায় প্রথম জানাজা শেষে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য মরদেহ সেখানে রাখা হয়। খোকার মরদেহে শ্রদ্ধা জানান, রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন, মুক্তিযোদ্ধাসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ।

শহীদ মিনারে সাদেক হোসেন খোকার মরদেহের পাশে অবস্থান করছিলেন তার ছেলে ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন, ঢাকার সাবেক ডেপুটি মেয়র আব্দুস সালাম, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মঈন খান, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি জাফরুল্লাহ চৌধুরীসহ সাদেক হোসেন খোকার রাজনৈতিক সহকর্মীরা।

শহীদ মিনারে সাদেক হোসেন খোকার মরদেহে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন বাংলাদেশ ন্যাপের মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া, সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গাজী মাজহারুল আনোয়ার, চিত্রনায়ক উজ্জল এবং গণফোরাম ও এলডিপির পক্ষ থেকেও অনেক নেতা শ্রদ্ধা জানান।

শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘সাদেক হোসেন খোকা একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তার রাজনৈতিক পরিচয় ছাপিয়ে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়েই তিনি মানুষের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।’

শহীদ মিনার শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সাদেক হোসেন খোকার মরদেহ নয়া পল্টনে নেওয়া হয়।

শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় সিক্ত খোকা: বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নানা-শ্রেণিপেশার মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের পর দুপুরে তার মরদেহ নয়া পল্টনের কার্যালয়ের সামনে আনা হলে শেষ শ্রদ্ধা জানান দলের নেতারা।

প্রথমে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায় প্রয়াত নেতার কফিনটি দলীয় পতাকা দিয়ে মুড়িয়ে দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

এরপর দলের পক্ষ থেকে কারাবন্দি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকে কফিনে ফুল দেওয়া হয়। কালো কাপড়ে মোড়া অস্থায়ী মঞ্চে রাখা হয় খোকার কফিন।

নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমাদের সকলের প্রিয় নেতা, দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা, দুই বারের নির্বাচিত ঢাকার সাবেক মেয়র, সাবেক মন্ত্রী, সাবেক সংসদ সদস্য, ঢাকা মহানগরের সাবেক সভাপতি সাদেক হোসেন খোকা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। এমন এক সময় চলে গেলেন যখন আমাদের দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে। তিনি তাকে শেষ দেখা দেখতে পারলেন না।

‘আজকে এই ফ্যাসিবাদী সরকারের নির্যাতনে সারা বাংলাদেশের মানুষ যখন অত্যাচারিত, লাঞ্ছিত, সেই সময়ে যে মানুষগুলো ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল সাদেক হোসেন খোকা তার অন্যতম। তিনি চলে গেছেন; তার বর্ণাঢ্য রাজনীতির কথা বলার সময় নয়।’

ফখরুল বলেন, ‘সাদেক হোসেন খোকার এই অকালে চলে যাওয়ায় যে রাজনৈতিক শূণ্যতা সৃষ্টি হলো তা পুরণ হওয়ার নয়। আল্লাহ তালার কাছে দোয়া করি তিনি যেন তার সকল গুনাহ মাফ করে দেন, তাকে বেহেশত নসিব করেন।

এর আগে কার্যালয়ের সামনের খোকার জানাজায় ইমামতি করেন উলামা দলের আহ্বায়ক মাওলানা শাহ নেছারুল হক। এরপর তার কফিনে স্যালুট জানায় সেক্টার কমান্ডার শাহজাহান ওমরের নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল।

সকাল ৮টা থেকে নয়া পল্টনের অফিসের নিচতলায় কোরানখানি অনুষ্ঠিত হয়।

শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, শাহজাহান ওমর, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, বরকত উল্লাহ বুলু, আবদুল আউয়াল মিন্টু, জয়নাল আবেদীন, আহমেদ আজম খান, এজেডএম জাহিদ হোসেন, রুহুল কবির রিজভী, হাবিবউন নবী খান সোহেল, শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসহ দলের ভাইস চেয়ারম্যান, উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য, যুগ্ম মহাসচিবসহ কেন্দ্রীয় ও অঙ্গসংগঠনের নেতৃবৃন্দ অংশ নেন। ২০ দলীয় জোটের জামায়াতে ইসলামী অধ্যাপক মজিবুর রহমান, হামিদুর রহমান আজাদ, শামীম সাঈদী, খোন্দকার লুফর রহমান, ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, মুফতি মহিউদ্দিন ইকরামসহ নেতারাও জানাজায় অংশ নেন।

নয়া পল্টনের কার্যালয় থেকে ফকিরেরপুল মোড় পর্যন্ত সড়ক ও তার পাশ-পাশের গলিতে হাজার হাজার নেতা-কর্মী-সমর্থক জানাজায় দাঁড়ান। পুরো পল্টন রোড কানায় কানায় পূর্ণ হয়। তখন ফুটপাতে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরাও মাথা নিচু করে শ্রদ্ধা জানান।

নগর ভবনে শেষবারের মতো খোকা: নয়াপল্টনে বিএনপি’র দলীয় কার্যালয়ে জানাজা শেষে সাদেক হোসেন খোকার মরদেহ নেওয়া হয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি)। সেখানে কর্মী-সমর্থক শুভাকাঙ্ক্ষী ও অনুরাগীদের শেষ শ্রদ্ধায় সিক্ত হন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক নগরপিতা।

দুপুর ৩টার দিকে তাকে নেওয়া হয় ডিএসসিসিতে। এ সময় নগর ভবনের সামনে হাজার হাজার মানুষ অংশ নেন সাদেক হোসেন খোকার জানাজায়।

জানাজায় অংশ নিয়ে ডিএসসিসির মেয়র সাঈদ খোকন বলেন,  শ্রদ্ধেয় সাদেক হোসেন খোকার যে আদর্শ সে আদর্শকে ধারণ করে আমরা এগিয়ে যাব। সেইসঙ্গে তার আদর্শকে ধারণ করে দেশপ্রেমে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সকলের কাছে অনুরোধ করব। মহান মুক্তিযুদ্ধে এই বীর মুক্তিযুদ্ধার অবদান ভোলার নয়।

মেয়র বলেন, ‘আমরা সবাই দোষগুণে মানুষ। আল্লাহ আমাদেরকে সেভাবেই সৃষ্টি করেছেন। ওনার যদি কোনো ভুল ত্রুটি থেকে থাকে তাহলে সবাই তাকে ক্ষমা করে দেবেন।’

নগর ভবন থেকে খোকার মরদেহ নেওয়া হয় তার গোপীবাগের বাসায়। সেখানে বাদ আসর শেষ জানাজা অনুষ্ঠিত হওয়ার পর জুরাইন কবরস্থানে সাদেক হোসেন খোকাকে দাফন করা হয়। এর আগে একাত্তরের এই বীর সেনানীকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শ্রদ্ধা জানানো হয়।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ