শুক্রবার, এপ্রিল ২৬, ২০২৪
প্রচ্ছদটপআমি সেই জাতির পিতা ।। বাঙালীর খোকা : শিপন নাথ

আমি সেই জাতির পিতা ।। বাঙালীর খোকা : শিপন নাথ

ইসলাম স্যারের মুখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা শুনে শিপন পাড়ি জমায় এক ভাবনার জগতে। স্কুলে যাওয়ার পথে নদীর পাড়ের বিশাল বটগাছ বসে পাখিরা ডাকছে। নদীর কলকল ধ্বনি শুনতে পায় শিপন। বইয়ে আঁকা বঙ্গবন্ধুর সুদর্শন ছবিটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। একজন লোক ছোট থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত কত কিছুই না করলো। কত অত্যাচার, নিপীড়ন, যন্ত্রণা। এতকিছুর পরেও নীতি থেকে এক পা নড়েনি।Bangabandhu

বাড়ি ফিরে শিপন আনমনা হয়ে আছে। কোনো কাজে মন বসছে না তার। পুকুর ঘাটে একা একা বসে পাখিদের মিলনমেলা লক্ষ্য করছে সে। তার বিষণ্ণ মনে কিছু প্রশ্ন বারবার উঁকি দিচ্ছে। “কেন তারা বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেললো?” ইসলাম স্যার কেন আজও এভাবে কাঁদেন? লেখাপড়ায় কিছুতেই মন বসাতে পারছেনা সে। মাথায় নানান প্রশ্ন। এক সমুদ্র আক্ষেপ নিয়ে ঘুমোতে গেলো সে। আজ স্কুলের ইংরেজী, অঙ্কের হোমওয়ার্ক গুলোও করা হয়নি। ইসলাম স্যারের ভাষ্যমতে, সে যেন অবশ্যই লাইব্রেরি থেকে বঙ্গবন্ধুর “অসমাপ্ত আত্মজীবনী ” বইটি পড়ে। শিপন লাইব্রেরিতে গিয়েছিলো বটে। কিন্তু লিংকন স্যার তাকে বইটি নিতে দেননি। কারণ তার লাইব্রেরি কার্ড ছিলোনা। মনে কস্ট নিয়ে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ে সে। পড়ার টেবিলে বইপত্র সব এলোমেলো। একনজরে তাকিয়ে আছে টেবিলে উপুড় হয়ে থাকা অগোছালো বইয়ের স্তুপের দিকে।

হঠাৎ শিপনের খেয়াল হলো তার ঘরে কেউ যেন পায়চারী করছে। সারা ঘর মূহুর্তেই আলোকিত হয়ে উঠেছে। স্পষ্ট আলোয় সে দেখতে পেলো তারই সমবয়সী পাজামা পাঞ্জাবী পরিহিত একটি ছেলে টেবিলটা সুন্দরভাবে গুছিয়ে দিচ্ছে। তার চোখে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা। বয়সে শিপনের চেয়ে একটু বড় হলেও চোখেমুখে দুষ্টুমি খেলা করছে। শিপন ভয় না পেয়ে জিজ্ঞেস করলো,

–কে তুমি?

— আমি বাংলার খোকা। তোমাদের খোকা। মিষ্টি হাসলো ছেলেটি।

— বাংলার খোকা? তাৎপর্য কী?

— বাহ! সারাদিন আমাকে নিয়েই ভাবছো। পড়ালেখার কথা না হয় বাদই দিলাম। ঠিকমতো ঘুমোতেও পারছোনা। আবার জিজ্ঞেস করা হচ্ছে কোন খোকা? ইসলাম স্যারের কথা মনে নেই বুঝি?

— হ্যাঁ। মনে আছে খুব। কিন্তু স্যারতো আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা বলেছিলেন।

–আমি সেই জাতির পিতা। বাঙালীর খোকা।

–কিন্তু তুমি এত মোটা চশমা পরেছো কেন?

–আর বলো না। খুব দুষ্টু ছিলাম তো। তাই শাস্তি পেতে হয়েছে।

–সে কী! দুষ্টু হলে শাস্তি পেতে হয়? তুমি তো মানুষের জন্যই সর্বদা ভালো কিছু করার চেস্টা করেছো। পুরো একটি জাতির জনক তুমি। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী।

–তা করেছি। কেউ অন্যায় কিছু করুক কিংবা বলুক। তা আমি একেবারেই সহ্য করতে পারিনা।

শিপন খোকার হাত ধরে পাশে বসিয়ে বলে,
–তুমি খুব ভালো গো। কিন্তু কি হয়েছিলো বললে না তো?

–আমি তখন সেভেনে পড়ি। খুব দুরন্ত ছিলাম। একদিন হঠাৎ ই আমার হার্ট দুর্বল হয়ে পরলো। কলকাতার ডাক্তার বললো বেরিবেরি রোগ। চিকিৎসা চললো। সুস্থ হতে পুরো দুবছর লেগে গেলো।

–তারপর?

–তারপর আর কি? আবার দুবছর পর চোখ খারাপ হয়ে গেলো। ডাক্তার বললো, গ্লুকোমা রোগ। অপারেশন করাতে হবে। দশদিনের মধ্যেই দুটো চোখই অপারেশন হলো। তখন থেকেই চশমা পরছি। পড়ালেখা ততদিন বন্ধই ছিলো। চার বছর বাদে আবার গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে ভর্তি হলাম।

–তুমি এত সুদর্শন। পুরো একটি জাতির অবিসংবাদীত নেতা। এক মহান রাষ্ট্রনায়ক। কিন্তু তার পরেও ওরা তোমাকে কেন হত্যা করলো? কেন?

—সেটা যে আমার কাছেই অপ্রকাশিত। কিন্তু আমি ভালোবাসি বাংলাদেশকে। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষকে।

শিপনের চোখ লেগে আসছে। একধরণের উপেক্ষিত ঘোরের মধ্যে হারিয়ে গেছে সে। বিশ্বাসই করতে পারছে না, স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর সাথে এতটা গভীরভাবে মিশেছে সে। ইসলাম স্যারের মুখে শোনা বঙ্গবন্ধুর সাথে পাশে বসা খোকার অনেকাংশেই মিল রয়েছে। বঙ্গবন্ধু এতটা দরদী! বন্ধুবৎসল, পরোপকারী! মানুষের জন্য যে কিনা নিজের জীবন দিতেও রাজি সে তো দেশের পিতা হবেই। জাতিকে সে আলোর পথে ধাবমান করবে। মুক্তির পথ দেখাবে। সবচেয়ে ভালো লাগলো বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে তার পড়ার টেবিল গুছিয়ে দিয়েছে। এমনটাও হতে পারে! ইসলাম স্যার ঠিকই বলতেন, এমন মানুষ হাজার বছরে একবারই আসেন। বারবার আসেন না।

ঘুম থেকে উঠেই শিপন স্কুল গমনের জন্য তাড়াহুড়ো করে। স্কুলে গিয়ে প্রিয় ইসলাম স্যারকে যেভাবেই হোক সবটা খুলে বলতে হবে। তাড়াহুড়োর কারণে সে দরজার চৌকাঠে হোচট খেয়ে পড়ে যায়। চোখ ঝাপসা লাগছে তার। স্কুলে পৌঁছেই ক্লাসে মনোযোগী হয় সে। ক্লাস টিচার আরিফ স্যার বোর্ডে অংক কষছেন। শিপনের বুজতে কস্ট হচ্ছে খুব। এমনটা আগেও হয়েছে। চোখ টানটান করছে। খোকার চোখে গ্লুকোমা হয়েছিলো। তাহলে কি আমারও তাই হবে? হলে বুজবো কীভাবে? খোকাকে লক্ষণগুলো জিজ্ঞেস করা উচিত ছিলো।
ভাবনার জগৎে পাড়ি দেয় সে।

পঞ্চম ঘণ্টায় ইসলাম স্যারের সমাজ ক্লাস। এই ক্লাসটার জন্যই অপেক্ষা করছিলো শিপন। স্যার “অসমাপ্ত আত্মজীবনী ” বইটি নিয়ে ক্লাসে ঢুকলেন। এসেই বইটা শিপনের হাতে দিয়ে বললেন,
—তুমি বইটা চেয়েছিলে। কিন্তু তোমাকে দেয়নি। তুমি তাড়াতাড়ি লাইব্রেরি কার্ডটা করে নিয়ো।

–জ্বি আচ্ছা স্যার।
বলেই বইটি হাতে নিয়ে দেখলো মলাটের ছবিটার চশমাটাই বঙ্গবন্ধু গতকাল রাতে পরেছিলেন। ঝাপসা চোখেই কয়েকটা লাইন পড়েই শিপনের মনে হলো, গতকাল রাতেই বঙ্গবন্ধু তাকে এসব কথা বলেছিলেন। চোখ মুছতে আরম্ভ করলো সে। তার চোখে জল। কাঁদতে কাঁদতেই শিপন ইসলাম স্যারকে বললো,
—স্যার আমার চোখ জ্বালা করছে। মাথা ব্যাথা করছে প্রচন্ড।

–তোমার কী শরীর খারাপ?

–জানি না স্যার। আমি আর পারছি না।
একটা কথা বলবো?

–বলো।

— স্যার এই বইতে খোকার ছোটবেলার যে কথা আছে তা গতরাতে তিনি আমাকে নিজের মুখে বলেছিলেন।

কথাটা শোনামাত্রই পুরো ক্লাস হাসিতে ফেটে পরলো। ইসলাম স্যারের রক্তচক্ষু দেখা মাত্রই মূহুর্তের মধ্যে পুরো ক্লাস স্থগিত হয়ে গেলো। কারো মুখে কোনো কথা নেই। শিপন এবার ভয়ে ভয়ে বললো,
–আমি সত্যি বলছি স্যার। ছোটবেলায় খোকার বেরিবেরি এবং গ্লোকোমা রোগ হয়েছিলো। যার কারণে তিনি চারটা বছর পড়ালেখা থেকে পিছিয়ে ছিলেন। দশদিনের মধ্যেই তার চোখের অপারেশন সম্পন্ন হয়েছিলো। তিনি এমন দুষ্টু ছিলেন যে, হাসপাতাল ছেড়ে পালাতে চেয়েছিলেন তিনি।

ইসলাম স্যার একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন শিপনের দিকে। এই ছেলে বলে কি! তিনি বললেন,
–খোকার আরেকটি মজার কথা বলো তো।

–স্যার, খোকার বাপ বেটার ফুটবল খেলাটা বেশ মজার ঘটনা। খোকা এবং তার বন্ধুরা অফিসার্স ক্লাবের হয়ে খেলতেন না। তারা তখনো ছাত্র। নিজেরাই খেলতেন। বাবার দল বাইরের খেলোয়াড় আনতেন। আর খোকারা সেই এগারোজন। প্রায় প্রতিটি ম্যাচই খোকার দল জিততেন। বাবার দল যেদিন ফাইনাল খেলতে বললো সেদিন ছিলো খোকাদের পরীক্ষা। এ জেড খান শিল্ডের ফাইনাল খেলা। খোকার দলের প্রায় খেলোয়াড় ইনজুরিতে। কিন্তু তারপরেও তারা দলবল নিয়ে গোলপোস্টে দাঁড়িয়েছিলেন। বাপের দলের কাছে বেটার দল এক গোলে পরাজিত হয়েছিলো।

ইসলাম স্যারের চোখে তখন জল টলমল করছে। তিনি তৎক্ষণাৎ শিপনকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, –“ওরে তোমরাই আমার খোকাবাবু। তোমরাই আমার বঙ্গবন্ধু।”
সবাই মনে রাখবে,
“যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা গৌরি যমুনা বহমান,
ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।”
“আজই বাবাকে গিয়ে চোখের ডাক্তার দেখাতে বলো।”
শিপন ভাবছে, আজ রাতে যদি বঙ্গবন্ধু আসেন তবে তারও গ্লুকোমা হয়েছে কি না জিজ্ঞেস করবে।

শিপনে চোখের অসুখ। ডাক্তার বললো, চশমা পরতে হবে। বহু দোকানে ঘুরেও কোনো চশমাই শিপনের পছন্দ হলো না। শেষমেশ একটি দোকানে তার চোখ আটকে গেলো। যে চশমাটা পছন্দ হলো সেটা হুবহু খোকার চশমার মতো। শিপন বললো, বাবা আমি এই চশমাটাই নিবো। বাবা হাসিমুখে ছেলের মাথায় হাত রাখেন।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ