বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ১৮, ২০২৪
প্রচ্ছদচট্রগ্রাম প্রতিদিননগরীতে গ্যাসের আরো এক লাখ মিটার স্থাপন করতে চায় সরকার

নগরীতে গ্যাসের আরো এক লাখ মিটার স্থাপন করতে চায় সরকার

নগরীতে গ্যাসের আরো এক লাখ মিটার স্থাপন করতে চায় সরকার। এর আগে ৬০ হাজার প্রি-পেইড মিটার স্থাপন করা হয়েছে। প্রি-পেইড মিটার স্থাপন করায় গ্রাহকদের ব্যয় বহুলাংশে কমে গেছে। কমে গেছে গ্যাসের অপচয়ও। এতে গ্রাহক যেমন উপকৃত হচ্ছে তেমনি উপকৃত হচ্ছে দেশও। প্রি-পেইড মিটারের বহুমুখী সাফল্যের পর চট্টগ্রামে নতুন করে আরো এক লাখ প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের প্রকল্প গ্রহণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কিন্তু সংকট তৈরি করছে ‘অর্থ’। এক লাখ প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রায় তিনশ’ কোটি টাকার সংস্থান কে করবে তা নিয়ে পুরো বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে রয়েছে। সরকার বলছে, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করুক। কিন্তু কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি বলছে তাদের কাছে অত ‘অর্থ’ নেই। এই অবস্থায় অত্যন্ত প্রয়োজনীয় প্রকল্পটি কিভাবে বাস্তবায়ন করা হবে তা নিয়ে সংশয় ব্যক্ত করা হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে চট্টগ্রামে এক লাখ গ্রাহকের বছরে অন্তত ৫০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। একই সাথে বর্তমানে গ্যাস পাইপের লিকেজ দিয়ে হাওয়ায় মিশে যাওয়া কয়েক কোটি টাকার গ্যাসও রক্ষা পাবে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, আবাসিক খাতে গ্যাসের অপচয় রোধ, চুরি বন্ধসহ বিভিন্ন অনিয়ম ঠেকিয়ে সাশ্রয়ী ব্যবহার নিশ্চিত করতে চট্টগ্রামের ৬০ হাজার গ্রাহকের গ্যাস সংযোগকে প্রি-পেইড মিটারের আওতায় আনা হয়েছে। নগরীর খুলশী, নাসিরাবাদ, জামালখান, হালিশহর, চান্দগাঁও, কোতোয়ালী, লালখান বাজার, আন্দরকিল্লা, চকবাজার, কাজীর দেউড়ি, পাঁচলাইশসহ নির্দিষ্ট কয়েকটি এলাকায় এই ৬০ হাজার প্রি-পেইড মিটার স্থাপন করা হয়েছে। জাপান সরকারের সাথে সম্পাদিত চুক্তির আওতায় ২৪৬ কোটি ৫৬ লাখ টাকা ব্যয় করে ৬০ হাজার প্রি পেইড মিটার স্থাপন করা হয়।। এর মধ্যে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) দিয়েছে ১৫৪ কোটি ১১ লাখ টাকা। বাংলাদেশ সরকার ৮১ কোটি ৪৫ লাখ এবং কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড দিয়েছে ১০ কোটি ৯১ লাখ টাকা। জাপান থেকে আনা প্রি-পেইড মিটারগুলো জাপানি একটি কোম্পানির নির্দেশনায় গ্রাহকদের বাসা বাড়িতে স্থাপন করা হয়েছে।
গ্যাসের প্রি-পেইড মিটার নিয়ে শুরুতে গ্রাহকদের কিছুটা অস্বস্তি বা সংশয় থাকলেও ব্যবহারের পর সব সংশয় কেটে গেছে। দেশে আবাসিকের একজন গ্রাহক প্রতিমাসে ৮৮ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার করেন হিসেব কষে চুলার বিল নির্ধারিত করা হয়েছে। প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৯ টাকা ১০ পয়সা করে ডাবল বার্নারের একটি চুলায় মাসিক ৮০০ টাকা বিল আদায় করা হয়। একজন গ্রাহককে কোন গ্যাস ব্যবহার না করলেও এই বিল পরিশোধ করতে হয়। পুরো মাস চুলা বন্ধ থাকলেও বিলের অংকে হেরফের হয়না। কিন্তু প্রি-পেইড মিটার লাগানোর পর দৃশ্যপট পুরোপুরি পাল্টে যায়। প্রি-পেইড মিটারের ডাটাবেস হিসেব করে দেখা যায় যে, ৫/৭ জনের পরিবারের একটি চুলায় মাসে মাত্র ৪শ থেকে ৫শ টাকার গ্যাস ব্যবহার হয়। প্রতিটি চুলায় তিন থেকে চারশ টাকার গ্যাস সাশ্রয় হচ্ছে। প্রি-পেইড মিটার লাগানো এবং ব্যবহারের পর ষাট হাজার গ্রাহকের মাসে অন্তত দুই কোটি টাকা সাশ্রয় হওয়ার ব্যাপারটি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। আবার কোন গ্রাহক চুলা না জ্বালালে এক টাকাও বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে না। বিদেশ গেলে বা বেড়াতে গেলেও গ্যাসের বিলের চাকা ঘোরার অবস্থাটা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। চুলা না জ্বালালে মিটার ঘুরছে না। আবার পুরোমাস চুলা জ্বালিয়েও নির্দিষ্ট বিলের বহু কম খরচ হচ্ছে। এতে করে প্রি-পেইড মিটার গ্রাহকদের নিকট বেশ প্রত্যাশিত হয়ে ওঠে। চট্টগ্রাম শহরের সব গ্রাহকই প্রি-পেইড মিটারের আওতায় আসতে আগ্রহী হয়ে উঠে। অনেকেই কর্ণফুলী গ্যাসের কর্মকর্তাদের নিকট নিজেদেরকে প্রি-পেইড মিটারের আওতায় আনার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু শহরের ৬০ হাজার সংযোগে প্রি-পেইড স্থাপনের পর আর একটি সংযোগও দেয়ার সুযোগ নেই।

নগরীর খুলশী আবাসিক এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ নিজামউদ্দিন বলেন, গ্যাস ব্যবহার করছি বহু বছর ধরে। প্রতিমাসেই নির্দিষ্ট বিল দিয়ে আসছিলাম। কিন্তু প্রি-পেইড মিটার ব্যবহারের পর বুঝতে পারছি যে কিভাবে এতদিন বাড়তি বিল দিয়েছি। তিনি বলেন, পুরো মাসে চারশ’ টাকাও খরচ হচ্ছে না। আমাদের চার জনের পরিবারের রান্নাবান্না চারশ’ টাকারও কমে হয়ে যাচ্ছে। দুই হাজার টাকা কার্ড রিচার্জ করেছিলাম। চার মাস চলে গেছে। এখনো চুলা জ্বলছে।

মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন নামের অপর একজন গ্রাহক বলেন, এটি একটি অসাধারণ ব্যাপার। চুলা না জ্বালালে বিল দিতে হবে না, এটাতো ভাবাই যায় না। বাড়িতে একটি বাড়তি চুলা করিয়ে রেখেছিলাম। বছরের পর বছর বিল দিয়েছি। অথচ প্রি-পেইড মিটার হওয়ার পর এই চুলার জন্য আর একটি কানাকড়িও খরচ হচ্ছে না। ভবিষ্যতের প্রয়োজনে লাগবে আশায় চুলাটির অনুমোদন করে রেখেছি।

কর্ণফুলী গ্যাসের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেছেন, গ্রাহকদের আগ্রহ, চাহিদা এবং সর্বোপুরি গ্যাস খাতের উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার চট্টগ্রামের জন্য আরো এক লাখ প্রি-পেইড মিটার স্থাপন করতে নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে প্রকল্প গ্রহন করার জন্যও কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিকে নির্দেশনা দিয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিকে নির্দেশনা দেয়। কিন্তু কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ফান্ডে এই মুহূর্তে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার মতো কোন ‘অর্থ’ নেই। এতে করে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হলে তা বাস্তবায়নের জন্য অর্থের উৎস খুঁজতে হবে।
কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির শীর্ষ একজন কর্মকর্তা চট্টগ্রামের ৬০ হাজার গ্রাহকের প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের প্রসঙ্গ তুলে বলেন, এটি অত্যন্ত সফল একটি প্রকল্প। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ফলে শুধু গ্রাহকই নন, দেশও উপকৃত হচ্ছে। তিনি বলেন, গ্যাসের রাইজার থেকে বাসা বাড়িতে গ্যাস সরবরাহের জন্য গ্রাহকেরা যেই লাইনটি নির্মাণ করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা বাথরুমের কাজ করে এমন মিস্ত্রিরা করে থাকে। এতে একটি পাইপ থেকে দশ চুলার জন্য দশটি পাইপ টানা হয়। লাইনজুড়ে থাকে প্রচুর লিকেজ। এই লিকেজ দিয়ে রাতে দিনে চব্বিশ ঘন্টাই বিপুল পরিমাণ গ্যাস বাতাসে উড়ে যায়। গ্যাসের লিকেজ দিয়ে হাওয়ায় উড়ে যাওয়া গ্যাসের কোন হিসেব থাকে না। চট্টগ্রামের ছয় লাখ আবাসিক গ্রাহকের লিকেজ পাইপ দিয়ে কোটি কোটি টাকার গ্যাস নষ্ট হয়। এই নষ্ট গ্যাস কারো কোন কাজেও লাগে না।

সংশ্লিষ্ট একজন প্রকৌশলী নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, প্রি-পেইড মিটার লাগানোর কাজ শুরু করতে গিয়ে একটি লাইনও লিকেজ ছাড়া পাওয়া যায়নি। নগরীর যেই ষাট হাজার গ্রাহকের মিটার প্রি-পেইড করা হয়েছে সেগুলোর প্রতিটিতেই কমবেশি লিকেজ ছিল। প্রি-পেইড মিটার লাগানোর আগ দিয়ে প্রতিটি লাইনই ঠিকঠাক করিয়ে নেয়া হয়েছে। প্রতিটি লাইনকেই লিকেজ মুক্ত করতে হয়েছে। এতে কোটি কোটি টাকার গ্যাস হাওয়ায় মিশে যাওয়ার অপব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ হয়েছে। তবে ৬০ হাজার গ্রাহকের বাইরে চট্টগ্রামে আরো যেই ৫ লাখ ৪০ হাজার গ্রাহক রয়েছেন তাদের প্রত্যেকের লাইন দিয়েই গ্যাস উড়ছে। হাওয়ায় মিশছে। অপচয় হচ্ছে।

অপরদিকে বকেয়া বিল কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির মাথা ব্যথার অনেক বড় একটি কারণ। কোটি কোটি টাকা বকেয়া আটকে রয়েছে গ্রাহকদের কাছে। নিয়মিত অভিযান এবং সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেও গ্রাহকদের নিকট আটকা পড়া বকেয়া বিল উদ্ধার করতে হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। সব গ্রাহককে প্রি-পেইড মিটারের আওতায় নিয়ে আসা গেলে বকেয়া বিলের টেনশন থেকেও কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি নিস্তার পায়। প্রি-পেইড গ্রাহকদের অগ্রিম কার্ড রিচার্জ করে গ্যাস জ্বালাতে হয়। এতে বকেয়ার কোন হিসেবই নেই।

নাম প্রকাশ না করার কর্ণফুলী গ্যাসের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, সরকার নতুন করে এক লাখ প্রি-পেইড মিটার লাগানোর চিন্তাভাবনা করছে। আপাতত ফান্ডের সমস্যা হলেও সরকারের জন্য এটি বড় কোন সমস্যা হবে না। নতুন প্রকল্পের আওতায় আরো এক লাখ প্রি-পেইড মিটার হয়ে যাবে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটি সময়ের দাবি। এসব সুযোগ জনগনের দোরগোড়ায় না পৌঁছালেই দেশ এগুবে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

অপর একজন বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী বলেন, চট্টগ্রামে আরো এক লাখ প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের লক্ষে প্রাথমিক কিছু কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আমাদেরকে নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে বলা হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে আরো অনেক আলাপ আলোচনা হবে। পরিকল্পনা হবে। হিসেব নিকেশ হবে। তবে কর্ণফুলীর ফান্ডে প্রকল্পটি নিজস্ব অর্থায়নে করার মতো ‘অর্থ’ জমা নেই। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে ‘অর্থের’ উৎস খুঁজতে হবে। জাইকার সাথেও সরকারি পর্যায়ে আলাপ আলোচনা হতে পারে।

নতুন করে এক লাখ প্রি-পেইড মিটার স্থাপন করতে কমপক্ষে তিনশ’ কোটি টাকা লাগবে বলে উল্লেখ করে একজন বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী বলেছেন, নগরীতে ৬০ হাজার মিটার স্থাপন করতে গিয়ে অবকাঠামোগত বেশ কিছু কার্যক্রম ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। নতুন প্রি-পেইড মিটার স্থাপিত হলেও আর নতুন করে সার্ভার স্টেশন করতে হবে না। এই ধরনের আরো বেশ কিছু কাজই না করে প্রকল্প সম্পন্ন করা যাবে। এতে করে পরবর্তী এক লাখ প্রি-পেইড মিটার লাগাতে অনেক খাতে অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে না। আগেকার চেয়ে কম খরচে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত করা সম্ভব হবে বলেও উক্ত বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী মন্তব্য করেন।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ