শনিবার, এপ্রিল ২০, ২০২৪
প্রচ্ছদআরো খবর......চেক প্রতারণা ও ডিজঅনারে করণীয়

চেক প্রতারণা ও ডিজঅনারে করণীয়

বর্তমান সময়ে ব্যাংকিং সেবার অনেক অল্টারনেটিভ ডেলিভারি চ্যানেল (এডিসি) উদ্ভাবনের ফলে অর্থ জমা, উত্তোলন কিংবা ট্রান্সফার সব ক্ষেত্রেই একাধিক বিকল্প পদ্ধতি চালু হয়েছে। এরই ফলে চেকের বিকল্প হিসেবে কার্ড, ইন্টারনেট ব্যাংকিং ও মোবাইল ব্যাংকিং সুবিধার মাধ্যমে টাকা উত্তোলন ও ট্রান্সফার হচ্ছে তাৎক্ষণিকভাবে। এজেন্ট আউটলেটগুলোতে এবং কিছু ব্যাংকের শাখা পর্যায়েও চেক ও কার্ড ছাড়া আঙুলের ছাপ দিয়েই বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে অর্থ উত্তোলন এখন অহর্নিশ হচ্ছে। তবে এত বিকল্পের পরও কি আমরা নিত্যদিনের ব্যাংকিংয়ে চেকের ব্যবহার থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছি বা পারব? কিছু ক্ষেত্রে হয়তো বের হয়ে আসা গেছে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এখনও চেকের কোনো বিকল্প নেই। ব্যবসায়িক লেনদেনে চেক যেভাবে প্রমাণযোগ্য দলিল হিসেবে কাজ করে, তা চেকের অন্য কোনো বিকল্প মাধ্যমের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। ব্যক্তিগত ধারদেনায়, ব্যবসায়িক লেনদেন বিশেষ করে বাকিতে পণ্য ক্রয়ে (ক্রেডিট পারচেজ) ও ব্যাংকঋণ উত্তোলনে এখনও চেক অত্যন্ত জনপ্রিয় ও বহুল প্রচলিত একটি মাধ্যম। বর্তমানে ব্যাংক গ্যারান্টির (সিকিউরিটি গ্যারান্টি) বিকল্প হিসেবেও কাজ করছে জামানতের চেক। ডিলারদের কাছ থেকে শুধু জামানতের চেক জমা রেখে কোটি কোটি টাকা বাকিতে পণ্য বিক্রি করছে বড় ব্যবসায়িক কোম্পানিগুলো। ব্যক্তিপর্যায়েও বিভিন্ন লেনদেনের দলিল ও নিশ্চয়তা হিসেবে কাজ করছে এই চেক। নেগোশিয়েবল ইন্সট্র–মেন্ট অ্যাক্ট, ১৮৮১ বলে প্রাপ্য প্রতিকারের ভরসায়ই ব্যক্তি ও ব্যবসায়ী মহলে লেনদেনের একটি দলিল হিসেবে চেক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। তবে চেকদাতা ও চেকগ্রহীতা উভয়ের অজ্ঞতা ও অসতর্কতার জন্য উভয়কেই পড়তে হয় বিড়ম্বনায়। আবার কখনও চেকদাতার ইচ্ছাকৃত প্রতারণার জন্যও হয়রানির শিকার হন চেকের গ্রহীতা বা প্রাপক। ত্রুটিপূর্ণ ও প্রতারণাপূর্ণ চেক পরিশোধে বা কালেকশনে ব্যাংক অস্বীকৃতি জানায়, অর্থাৎ পরিশোধের জন্য উপস্থাপিত চেক ব্যাংক কর্তৃক প্রত্যাখ্যান বা ডিজঅনার করা হয়। চেকদাতার সুনাম ক্ষুন্ন হয়, চেকগ্রহীতা পাওনা আদায়ে বা অর্থ উত্তোলনে অসমর্থ হন। অনেক ক্ষেত্রে চেকগ্রহীতার আইনি প্রতিকারও বাধাগগ্রস্ত হয়। আবার চেক জালিয়াতির কারণে চেকদাতারও মাথায় হাত পড়ে কখনও কখনও। তাই চেকের বিষয়ে সব মহলেরই সচেতনতা ও জানার প্রয়োজন আছে বৈকি।
চেকদাতার অ্যাকাউন্টে ব্যালান্স আছে, তথাপি চেকটি যদি যথাযথভাবে ইস্যু করা (ড্র করা) না হয়, তাহলে এই চেক দিয়ে ব্যাংক থেকে কোনো অর্থ উত্তোলন সম্ভব হবে না। তাই চেক ইস্যু করার সময় চেকদাতাকে কিছু সাধারণ বিষয় মাথায় রেখে চেক ইস্যু করতে হবে। যেমন এক. চেকের তারিখ সঠিকভাবে লেখা। চেকের তারিখ বলতে চেক ইস্যুর তারিখ বোঝায়। তবে প্র্যাকটিস হচ্ছে, যেদিন ব্যাংকে চেকটি উপস্থাপন করার কথা চেকে ওই তারিখটিই লিখতে হয়। চেকে উল্লিখিত তারিখ থেকে পরবর্তী সর্বোচ্চ ছয় মাসের মধ্যেই চেকটি নগদায়ন করতে হবে। তারিখ লিখতে দিন, মাস ও বছরের জন্য নির্ধারিত আটটি বক্স যথাযথভাবে পূরণ করতে হয়; দুই. প্রাপক বা চেকের গ্রহীতার (ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান) পূর্ণনাম সঠিকভাবে লিখতে হবে। আংশিক নাম বা ডাকনাম লেখা যাবে না; তিন. টাকার পরিমাণ কথায় ও অঙ্কে স্পষ্ট ও অভিন্নভাবে লিখতে হবে; চার. অঙ্কে ও কথায় লেখা টাকার পরিমাণের আগে, পরে ও মাঝখানে কোনো অতিরিক্ত ফাঁকা জায়গা রাখলে চেক অপব্যবহারের সম্ভাবনা থাকে। অঙ্কে লেখা টাকার পর ‘/’ চিহ্ন এবং কথায় লেখা টাকার পর ‘মাত্র’ লিখে পরবর্তী ফাঁকা অংশগুলো যথাসম্ভব আনুভূমিক দাগ টেনে দিতে হয়। প্রাপকের নাম লেখার ক্ষেত্রেও একই সতর্কতা অবলম্বন করা বাঞ্ছনীয়; পাঁচ. নগদ উত্তোলন পরিহার করতে এবং কেবল প্রাপকের অ্যাকাউন্টে চেকের অর্থ জমা নিশ্চিত করতে তথা ইস্যু করা চেকের অধিকতর নিরাপত্তার স্বার্থে যথাসম্ভব প্রাপকের নামের সঙ্গে তার হিসাব নম্বর (সম্পূর্ণ নম্বর) উল্লেখ করা এবং চেকের ‘অর বিয়ারার’ শব্দ দুটি দাগ টেনে কেটে (স্ট্রাইক আউট) দিতে হবে এবং চেকের বাঁ পাশের টপ কর্নারে আড়াআড়িভাবে ‘অ্যাকাউন্ট পেইয়ি অনলি’ ক্রসিং দিতে হয়। চেকের পেছনে নির্ধারিত স্থানে প্রাপকের নাম ও হিসাব নম্বর লিখে নিচে চেকদাতা সই করে এনডোর্স করে দেবেন। এতে চেকটির নগদ উত্তোলন রহিত হবে এবং চেকটি কেবল প্রাপকের (চেকে উল্লিখিত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান) ব্যাংক অ্যাকাউন্টেই জমা নিশ্চিত হবে; ছয়. চেকে কোনো অল্টারেশন (কাটাকাটি বা ওভাররাইটিং) থাকলে তা প্রত্যাখ্যাত হবে। যদি কোনো কাটিকাটি বা ওভাররাইটিং হয়েই যায়, তাহলে তা চেকদাতার (ড্রয়ার) পূর্ণ স্বাক্ষরে নিশ্চিত করতে হবে। অবশ্যই চেকে ঘষামাজা বা ফ্লুয়িড জাতীয় কিছু ব্যবহার করা যাবে না; সাত. চেক উপস্থাপনের তারিখে চেকদাকার অ্যাকাউন্টে চেকটি অনার করার মতো পর্যাপ্ত ব্যালান্স নিশ্চিত করা; আট. চেকদাতার ব্যাংকের নিয়মানুযায়ী ন্যূনতম স্থিতি রেখে চেক ইস্যু করতে হয়; নয়. ইস্যু করা চেকের পেমেন্ট অথারাইজ করতে চেকের ডান পাশে নিচের দিকে এমআইসিআর অংশের উপরিভাগে নির্দিষ্ট স্থানে চেকদাতা সই করবেন এবং সই ব্যাংকে সংরক্ষিত নমুনা স্বাক্ষরের (স্যাম্পল সিগনেচার) সঙ্গে যাতে মিল থাকে; দশ. আন্তঃব্যাংক বা আন্তঃশাখা চেক পরিশোধের জন্য চেকদাতার ব্যাংকে ‘পজিটিভ পে’ নির্দেশনা দিতে হবে এবং চেকদাতার কনফারমেশন সাপেক্ষে চেক পরিশোধের স্বার্থে ব্যাংকে প্রদত্ত চেকদাতার সেলফোন নম্বর সর্বদা সচল রাখতে হবে; এগারো. নিজের কলম দিয়ে এবং অমুছনীয় কালো কালির বলপয়েন্ট পেন দিয়ে চেক লিখতে হয়। পেন্সিল, জেলপেন বা অন্য রঙিন কালি (নীল, সবুজ, লাল প্রভৃতি) দিয়ে চেক লেখা যাবে না। বর্তমানে কেউ চেকের ডিটেইলস হাতে না লিখে প্রিন্ট করেও চেক ইস্যু করেন। চেকের গ্রহীতা বা অন্য কারও (সুপরিচিত নয় এমন কেউ) কলম দিয়ে চেক লিখলে বা অন্য কাউকে দিয়ে চেক লেখালে ব্যবহার করা কলমটি ‘ফ্রডস্টার পেন (যে কলমের কালি মুছনীয়)’ হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ফলে বড় ধরনের জালিয়াতির শিকার হতে পারেন চেকদাতা। কারণ এক্ষেত্রে সতর্ক না থাকলে প্রাপকের নাম ও টাকার পরিমাণ বদলে গিয়ে চেকদাতার অ্যাকাউন্টের অর্থ বেহাত হতে পারে অজান্তেই। এই ভয়ে বড় অঙ্কের চেকের ক্ষেত্রে প্রাপক ও টাকার অংশগুলোর ওপর কেউ সেলোটেপ (স্বচ্ছ স্কচ টেপ) পেস্ট করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তবে আমাদের দেশে এ প্র্যাকটিস প্রচলিত নয়, কারণ চেকের গায়ে ব্যাংকারও সই করার পাশাপাশি একাধিক সিল ব্যবহার করেন, যা সেলোটেপের ওপর সম্ভব নয়; বারো. চেকের আংশিক উত্তোলন সম্ভব নয়; তেরো. এক চেকে একাধিক গ্রহীতা কর্তৃক উত্তোলন বা একাধিক হিসাবে ট্রান্সফার সম্ভব (যেমনÑবেতন, বোনাস, ফি প্রভৃতি পরিশোধের ক্ষেত্রে)। তবে এক্ষেত্রে চেকদাতা কর্তৃক এনডোর্সমেন্ট বাঞ্ছনীয়। তবে নগদ উত্তোলনে এমন চেক ইস্যু করা যাবে না; চৌদ্দ. একই চেকে আংশিক নগদ উত্তোলন, আংশিক ট্রান্সফার সম্ভব নয়; পনেরো. ডিডি বা পে-অর্ডার ক্রয়ের ক্ষেত্রে চেকের প্রাপকের ঘরে ‘ইউরসেলফ ফর ডিডি/পে-অর্ডার’ লিখতে হয়; ষোলো. কোনো ব্ল্যাংক চেক ইস্যু করা ঠিক নয়। যদি ইস্যু করতেই হয় তাহলে প্রাপকের নাম ও টাকার ঘরগুলো যেন অন্তত ফাঁকা না থাকে। অথবা নিতান্ত প্রয়োজনে যদি টাকার অঙ্ক উল্লেখ না-ই করতে হয়, তবে চেকের গায়ে ঈপ্সিত টাকার সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দিয়ে লিখে দিতে পারেন ‘নট ওভার … টাকা’; সতেরো. চেকে অগ্রিম সই করে রাখা ঠিক নয়, যথাসম্ভব ব্যাংকে উপস্থাপনকালেই সই করা উচিত; আঠারো. দেনা বা দায় পরিশোধের পর জামানতের চেক ফেরত নিতে ভুলবেন না; উনিশ. অ্যাকাউন্টের জমা-উত্তোলনের রেকর্ড চেকদাতা সংরক্ষণ করবেন এবং অ্যাকাউন্ট স্টেটমেন্টের (হিসাব বিবরণী) সঙ্গে নিয়মিত মিলিয়ে নেবেন। মোবাইল ফোনে লেনদেনের এসএমএস নোটিফিকেশনগুলোতে চোখ রাখবেন অ্যাকাউন্টধারী। কোনো অস্বাভাবিক বা সন্দেহজনক লেনদেন প্রতীয়মান হলে তাৎক্ষণিকভাবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে জানাতে হবে; বিশ. জাল-জালিয়াতি রোধে চেক বইটি যথাসময়ে (আবেদনের ১০ দিনের মধ্যেই) ব্যাংক থেকে সংগ্রহ করতে হবে। নিজের চেক বই নিজে সংগ্রহ করবেন। বিশেষ প্রয়োজনে চেক বই গ্রহণের জন্য কাউকে পাঠালে তার নাম, ঠিকানা ও মোবাইল ফোন নম্বর উল্লেখপূর্বক তার সই সত্যায়িত করে ব্যাংকে অথারাইজেশন লেটার দিতে হবে; একুশ. কোনো চেক বা সম্পূর্ণ চেক বই হারিয়ে গেলে বা চুরি হলে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যাংককে জানাতে হবে। থানায় জিডি এন্ট্রি করিয়ে সেটির সত্যায়িত কপিসহ ব্যাংকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এবং নতুন চেকবই চেয়ে লিখিত আবেদন করতে হয়; বাইশ. কোনো চেক বাতিল (ক্যানসেল) করতে চাইলে চেকের গায়ে, টাকার অঙ্কে, স্বাক্ষরে, চেক নম্বরে ও এমআইসিআর অংশের কোডগুলোতে একাধিক ক্রস চিহ্ন এঁকে দিতে হয় অথবা আড়াআড়িভাবে দুটি সমান্তরাল দাগ টেনে মাঝে ‘বাতিল/ক্যানসেলড’ লিখে দিন অথবা চেকটি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ধ্বংস করে ফেলতে হয়। চেক বাতিল বা ধ্বংসের তথ্য নিজে সংরক্ষণ করবেন এবং ব্যাংককেও জানাতে হয়; তেইশ. নতুন চেক বইয়ের জন্য বর্তমান চেক বই নিঃশেষ হওয়ার আগেই চেকের শেষাংশে সংযুক্ত চেক রিকুইজিশন বা চেক রিকোয়েস্ট সিøপের মাধ্যমে আবেদন করতে হয়। ইন্টারনেট ব্যাংকিং অপশন অথবা ব্যাংকের মোবাইল অ্যাপ (যদি থাকে) ব্যবহার করেও আবেদন করা যায়; চব্বিশ. চেক হয়তো ইংরেজি ভাষায় প্রিন্টেড হতে পারে। গ্রাহক বাংলা অথবা ইংরেজি যেকোনো ভাষায় চেক লিখতে পারেন। কিন্তু উভয় ভাষার মিশ্রণ ঘটালে চেকটি প্রত্যাখ্যাত হতে পারে; পঁচিশ. কোনো চেকের পেমেন্ট যৌক্তিক কোনো কারণে (যেমনÑপাওনাদারের পাওনা এরই মধ্যে নগদে বা অন্য কোনোভাবে হয়তো পরিশোধ করে ফেললে অথবা কোনো চেক হারিয়ে গেলে বা চুরি হলে) স্টপ করাতে চাইলে গ্রাহক হিসাব নম্বর, সংশ্লিষ্ট চেকের নম্বর ও পেমেন্ট স্টপ করার কারণ উল্লেখ করে ব্যাংকে লিখিতভাবে জানাবেন; ছাব্বিশ. চেক গ্রহণকালে চেকের পাতা সংখ্যা গুণে-বুঝে নিতে হবে এবং প্রতিবার চেক ইস্যুর পরও চেক লিফের ব্যালেন্সিং করতে হয়; সাতাশ. নিয়মিত লেনদেন করে হিসাবটি অপারেটিভ রাখা উচিত; আটাশ. জ্ঞাতব্য বিষয়, চেক কেবল এক টুকরো কাগজ নয়। এটি একটি লিগ্যাল ডকুমেন্ট, যা চেকদাতা ও চেকগ্রহীতার লেনদেনের একটি আইনি চুক্তি। চেক অনেকটাই নগদ অর্থের শামিল এবং এর ডিজঅনার ও জালিয়াতিপূর্ণ ব্যবহার শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাই চেকের নিরাপদ ও সযত্ন হেফাজত (আন্ডার লক অ্যান্ড কি) করতে এবং নিশ্চিত করতে হবে, যাকে চেকটি যেন কোনোভাবেই রংহ্যান্ডেড না হয়।

চেকগ্রহীতাকেও সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। বর্তমানে মুদ্রিত এমআইসিআর চেক ইস্যু করে ব্যাংক। তাই আগে থেকে চেকে বেশ কিছু তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবেই গ্রাহক পেয়ে যান, যেমন ব্যাংক ও শাখার নাম, হিসাবের নাম ও নম্বর, শাখার রাউটিং নম্বর ও চেক নম্বর। তাই কোনো চেক গ্রহণ করার আগে উপরি-উল্লিখিত বিষয়গুলো ছাড়াও আরও যেসব বিষয় মিলিয়ে নিতে হবে এক. চেকের চারটি অ্যাপারেন্ট টেনর (তারিখ, প্রাপক, টাকার পরিমাণ, সই) যথাযথভাবে লেখা আছে কি না; দুই. চেকের নিচের অংশে এমআইসিআর কোড ব্যান্ডে যেন কোনো ভাঁজ, সিল, স্ট্যাপল, পিন, পেস্ট, ঘষামাজা (টেম্পারিং), লেখা, দাগ টানা প্রভৃতি না করা হয়। তাহলে চেকটি ইলেকট্রনিক্যালি ইনভ্যালিড হয়ে যাবে; তিন. জামানতের চেকের ক্ষেত্রে গ্রহীতার দায়িত্ব হচ্ছে, চেকে চেকদাতার সইটি তার নমুনা স্বাক্ষরের সঙ্গে মিল আছে কি না, তা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে গিয়ে যাচাই করা। তা না হলে ভবিষ্যতে চেক প্রেজেন্ট করলে হয়তো দেখবেন, চেকদাতার হিসাবে ব্যালান্স আছে, কিন্তু সইয়ে অমিলের কারণে চেকটি নগদায়ন করা যাচ্ছে না। কারণ চেকদাতা ইচ্ছা করেই প্রতারণার উদ্দেশ্যে ভিন্ন বা গরমিল সই দিয়েছেন। হিসাবটি চালু আছে কি না, ইস্যুকৃত চেকটি অ্যাকাউন্টহোল্ডার কর্তৃক স্টপ বা লস্ট বা স্টোলেন মার্ক করা কি না, সেটিও জেনে নিতে হয়; চার. প্রতিষ্ঠানের হিসাব হলে সইয়ের সঙ্গে সিলযুক্ত আছে কি না, তা দেখে নিতে হয়; পাঁচ. গ্রহীতা যদি ‘অ্যাকাউন্ট পেইয়ি’ চেক গ্রহণ করেন, তাহলে খেয়াল রাখতে হবে চেকে গ্রহীতার নামের বানান যেন তার ব্যাংক হিসাবে থাকা নামের সঙ্গে মিল থাকে। গ্রহীতার কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট না থাকলে চেকে লেখা নামটি এনআইডির সঙ্গে হুবহু মিল রেখে লেখাতে হবে এবং চেকটি উপস্থাপনের সময় নিজের এনআইডির কপি সংযুক্ত করবেন; ছয়. চেক যথাসম্ভব চেকদাতাকে দিয়েই লেখাবেন এবং আপনার সামনেই স্বাক্ষর করাবেন। এতে চেকদাতা পরবর্তী সময়ে ‘এই চেক আমি দিইনি’ বা ‘স্বাক্ষর আমি করিনি’ মর্মে অস্বীকার করার সুযোগ ও সাহস পাবে না। তাছাড়া চেকগ্রহীতার অনুপস্থিতিতে চেকদাতা অন্য কাউকে দিয়ে (যেমন ছেলে, স্ত্রী, কর্মচারী) চেক সই করিয়ে নিজের সই বলে চালিয়ে দিতে পারে এবং পরে আদালতে ‘এই স্বাক্ষর আমার নয়’ বলে ঘোষণা দিয়ে চেকগ্রহীতার বিরুদ্ধেই চুরি, প্রতারণা বা চেক জালিয়াতির মামলা ঠুকে দিতে পারে; সাত. এছাড়া খেয়াল রাখতে হবে চেকে চেকদাতার টাইপ করা নাম আছে কি না। তা না হলে দেখা যাবে চাতুর্যের সঙ্গে প্রতারণার উদ্দেশ্যে চেকদাতা অন্যের চেকে (যেমন স্ত্রীর বা অন্য কারও চেকে) নিজে সই করে চেকগ্রহীতাকে দেবে, যে চেক দিয়ে গ্রহীতা কখনোই টাকা উত্তোলন বা আদায় করতে পারবেন না, উল্টো নিজেই ফেঁসে যেতে পারেন; আট. নগদ গ্রহণের জন্য ক্যাশ কাউন্টারে চেকের সঙ্গে সংযুক্ত টোকেনটি জমা করুন।

বিয়ারার চেকের ক্ষেত্রে এই টোকেনের মাধ্যমেই ক্যাশ পেয়িং কর্মকর্তা আপনাকে চেকের প্রকৃত বাহক হিসাবে শনাক্ত করবে; নয়. চেকের অর্থ গ্রহণকালে চেকের পেছনে নামের পূর্ণ স্বাক্ষর করুন (আপনি নিজেই যদি চেকের ড্রয়ার হন, তাহলে ব্যাংকে সংরক্ষিত নমুনা স্বাক্ষর অনুসারে স্বাক্ষর করবেন); দশ. চেকদাতার মৃত্যু, মানসিক বৈকল্য ও দেউলিয়াত্বে কিংবা আদালতের গার্নিশি অর্ডার থাকলে চেকদাতার হিসাবের কোনো চেক নগদায়ন করতে পারবেন না। তাছাড়া নিয়মিত লেনদেনের অভাবে চেকদাতার হিসাবটি ইনঅপারেটিভ হয়ে গেলেও ওই হিসাবের কোনো চেক নগদায়ন করা যাবে না। তাই যথাশীঘ্র চেকের পেমেন্ট গ্রহণ করবেন; এগারো. চেকটি যেন মিউটিলেটেড (স্যাঁতসেতে, ভাঁজ পড়া, মেটে, জোড়াতালি দেওয়া, ঘষামাজা করা, কালি বা রংমাখা) না হয়; বারো. প্রাপক বা এনডোর্সি হিসেবে আপনার অধিকার সীমিত বা বারিত করে এমন কোনো এনডোর্সমেন্ট আছে কি না দেখে নেবেন; তেরো. কোনো চেকের জেনুইটি নিয়ে সন্দেহ হলে নিকটস্থ ব্যাংক শাখায় জালনোট শনাক্তকারী মেশিনে যাচাই করে নেবেন; চৌদ্দ. চেক মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার আগে ব্যাংকে উপস্থাপন করুন; পনেরো. ব্যাংকের বিজনেস আওয়ারে (সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা) চেক প্রেজেন্ট করুন। তবে অনলাইন বা ব্যাচের চেক হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই উপস্থাপন করতে হবে; ষোলো. আপনি যদি চেকের টাকা নগদ উত্তোলন করতে চান এবং নগদ প্রদানকারী শাখার গ্রাহক না হয়ে থাকেন, তবে চেকের সঙ্গে আপনার এনআইডির কপি ও মোবাইল নম্বর সংযুক্ত করবেন; সতেরো. চেকটি আপনার হিসাবে জমা করাতে চাইলে নির্দিষ্ট জমা সিøপে আপনার হিসাব ও চেকের তথ্যাদি, নাম, মোবাইল নম্বর উল্লেখ করে জমা সিøপটি স্বাক্ষর করে চেকসহ জমা করুন এবং জমা রশিদের কার্বন কপি বা ডুপ্লিকেট গ্রহণ করুন। ড্রয়ার যদি ইতোমধ্যে চেকে এনডোর্স না করে থাকেন, তাহলে জমার আগে চেকের পেছনে নির্ধারিত স্থানে প্রাপকের নাম (আপনার হিসাবের নাম), হিসাব নম্বর লিখে নিচে আপনি স্বাক্ষর করে এনডোর্স করে দিন; আঠারো. অনেকেই চেক ভেঙে বা কয়েক ভাঁজে ভাঁজ করে পকেটে বা মানিব্যাগে রাখেন। এমনটা কখনই করবেন না; উনিশ. চেকটি যদি অন্য কোনো ব্যাংকের বা একই ব্যাংকের ভিন্ন কোনো শাখার হয়ে থাকে, তবে ব্যাংক নির্দিষ্ট হারে কালেকশন চার্জ আদায় করবে। আর এই চেক কোনো কারণে ডিজঅনার হলেও ডিজঅনার চার্জ আদায় করা হবে আপনার কাছ থেকেই।
কত দিনের মধ্যে চেক উপস্থাপন বা ডিজঅনার করাবেন: চেক গ্রহীতাকে মনে রাখতে হবে চেকে উল্লিখিত তারিখে অথবা উল্লিখিত তারিখ থেকে পরবর্তী ছয় মাসের (অথবা চেকে উল্লিখিত মেয়াদের মধ্যে যেটি কম) মধ্যেই পরিশোধকারী ব্যাংকে চেকটি নগদায়নের জন্য উপস্থাপন করতে হবে। চেকে উল্লিখিত তারিখের আগে চেক উপস্থাপন করলে এই চেক পরিশোধকারী ব্যাংক ‘পোস্ট ডেটেড চেক বা অগ্রিম তারিখযুক্ত চেক’ বলে প্রত্যাখ্যান করবে। অন্যদিকে চেকের মেয়াদ ছয় মাস (অথবা চেকে উল্লিখিত মেয়াদের মধ্যে যেটি কম) অতিবাহিত হয়ে গেলে ব্যাংক চেকটিকে ‘স্ট্যাল চেক বা মেয়াদোত্তীর্ণ চেক’ বলে প্রত্যাখ্যান করবে। উভয় ক্ষেত্রেই চেকগ্রহীতা ১৩৮ ধারায় কোনো আইনি প্রতিকার পাবে না।

শুধু কি ‘তহবিল অপর্যাপ্ততা’ই ‘চেক ডিজঅনার’ ও শাস্তিযোগ্য: নেগোশিয়েবল ইনস্ট্র–মেন্ট অ্যাক্ট, ১৮৮১-এর ১৩৮ থেকে ১৪১ ধারাগুলো চেক ডিজঅনারের অপরাধ ও শাস্তির বিধান-সম্পর্কিত। তবে অপরাধ ও শাস্তি ১৩৮ ধারাতেই নির্ধারিত হয়। অনেকেই মনে করেন, শুধু ‘তহবিল অপর্যাপ্ততা’ই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবে তহবিল অপর্যাপ্ততার কারণে চেক ডিজঅনার না হয়ে আমলযোগ্য অন্য কোনো কারণে, যা চেকদাতার প্রতারণাপূর্ণ মনোভাব প্রমাণ করে, ডিজঅনার হলেও এ ধারার অপরাধ হবে। কারণ পর্যাপ্ত তহবিল থাকার পরও একটি চেক অন্য একাধিক কারণে ডিজঅনার হতে পারে, যেখানে ড্রয়ারকে দোষী সাব্যস্ত করার যৌক্তিক কারণ থাকে। যেমন রেফার টু ড্রয়ার, সিগনেচার ডিফারস, সিগনেচার ইনকমপ্লিট, পেমেন্ট স্টপড বাই ড্রয়ার, অ্যাকাউন্ট ক্লোজড, অ্যাডভাইস নট রিসিভড প্রভৃতি।
স্বয়ংক্রিয় স্বাক্ষরযুক্ত চেক: স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রিন্টেড বা রাবার স্ট্যাম্পের ইমপ্রেসড স্বাক্ষরযুক্ত চেকের প্রতিকার বিষয়ে আইনে কিছু বলা নেই। তথাপি বর্তমানে অনেক করপোরেট চেকে সিগনেটরির স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রিন্টেড বা ইমপ্রেসড স্বাক্ষর থাকে। কারণ কোনো বড় প্রতিষ্ঠানের ব্যস্ত প্রধানের পক্ষে হয়তো দিনে ১০০টি চেকে স্বাক্ষর করা সম্ভব নয়। এসব ক্ষেত্রে কোম্পানি স্বয়ংক্রিয় স্বাক্ষরযুক্ত চেক ইস্যু করে থাকে। তবে এসব চেক গ্রহণকালে চেকদাতা প্রতিষ্ঠানের ধরন, সুনাম, আর্থিক ভিত্তি, চেক পরিশোধের অতীত রেকর্ড ইত্যাদি বিবেচনায় নেওয়া উচিত।
চেক উপস্থাপনকারী পেয়িং ব্যাংকের ওয়াক-ইন কাস্টমার হলে চেক ডিজঅনার করা যাবে কি: চেক যদি ক্রসড চেক না হয়, তাহলে চেক উপস্থাপনকারীর ক্ষেত্রে হিসাবধারী গ্রাহক হওয়া নিষ্প্রয়োজন। তবে চেক ডিজঅনারের পরিণতি বিবেচনায় এক্ষেত্রে চেক উপস্থাপনকারীর পরিচিতি জ্ঞাত হওয়া উচিত। তাই ওয়াক-ইন কাস্টমার (হিসাবধারী নয় এমন গ্রাহক) কর্তৃক উপস্থাপিত চেক ডিজঅনার করতে ব্যাংক চেকের বাহক বা প্রেজেন্টারের এনআইডি গ্রহণ, ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর সংরক্ষণ করে, যাতে আদালত ব্যাংককে সাক্ষী হিসেবে তলব করলে বা প্রতিবেদন দাখিল করতে বললে ব্যাংক যেন তখন চেকের বাহক সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করতে পারে। ডিজঅনার করার পর ডিজঅনার করা চেক ও ডিজঅনার মেমোর ফটোকপি ব্যাংক সংগ্রহে রেখে মূল চেক ও ডিজঅনার মেমো চেকের বাহক বা প্রেজেন্টারকে প্রদান করে ডিজঅনার রেজিস্টারে তার প্রাপ্তিস্বীকারমূলক স্বাক্ষর রাখবে।
প্রাপকের ঘরে ‘ক্যাশ’ বা ‘সেলফ’ লেখা চেকে মামলা করা যাবে কি: এক্ষেত্রে চেক উপস্থাপনকারী চেকদাতা নিজেই হলে কোনো অপরাধ সংঘটিত হবে না। তবে চেকের ধারক যদি চেকদাতার পাওনাদার হয় বা যথানিয়মে ধারক হয়, তাহলে ১৩৮ ধারায় বিচার্য হবে। তবে এক্ষেত্রে মামলা দুর্বল হওয়ার অনেক উপাদান থেকে যাবে এবং এক্ষেত্রে ধারক কর্তৃক আদালতকে বোঝাতে এবং প্রমাণ করতে সমর্থ হতে হবে যে, সে-ই চেকের যথানিয়মে ধারক।
কে মামলা করবে: যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে (প্রাপক, এনডোর্সি, যথানিয়মে ধারক) চেক দেওয়া হয়েছে, সে ব্যক্তি বা তার পাওয়ার অব অ্যাটর্নি হোল্ডার, প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা প্রতিনিধিই মামলা করতে পারবে।

কতবার ডিজঅনার করাবেন: অনেকেই মনে করে মামলা করার জন্য চেকটি তিনবার ডিজঅনার করাতে হয়। এ ধারণাটি আইনসম্মত নয়। একবার ডিজঅনার হলেই মামলা করা যাবে।

আইনি নোটিস ও মামলা: ডিজঅনার হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে চেকের ড্রয়ারকে (চেকদাতা) চেক ডিজঅনার হওয়ার বিষয়টি জানিয়ে ৩০ দিনের সময় দিয়ে চেকে উল্লিখিত অঙ্কের টাকা প্রদানের দাবি জানিয়ে নির্ধারিত নিয়মে একজন আইনজীবীর মাধ্যমে আইনি নোটিস প্রদান করতে হবে। চেকের প্রাপক বা যথানিয়মে ধারক নিজেও ওই নোটিস প্রদান করতে পারে। তবে আইনজীবীর মাধ্যমে করাই ভালো। কোনোভাবেই নোটিস প্রেরণ না করে সরাসরি মামলা করা যাবে না। চেক প্রদানকারী নোটিসপ্রাপ্তির ৩০ দিনের মধ্যে চেকের প্রাপক বরাবরে চেকে উল্লিখিত অঙ্কের টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হলে পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যেই মামলা করতে হবে। তিন পদ্ধতিতে নোটিস দেওয়া যাবে এক. চেক ইস্যুকারীকে সরাসরি নোটিস প্রদান করে। তবে এক্ষেত্রে নোটিসের অনুলিপিতে প্রাপ্তি স্বীকারস্বরূপ নোটিসগ্রহীতা চেকদাতার স্বাক্ষর রাখতে হবে; দুই. নিয়মিত বাসস্থানের ঠিকানায় অথবা বাংলাদেশের যে স্থানে সর্বশেষ বসবাস করেছেন বা ব্যবসা করেছেন, সেই ঠিকানায় রেজিস্টার্ড এডি ডাকযোগে; তিন. বহুল প্রচারিত যেকোনো একটি জাতীয় দৈনিক বাংলা পত্রিকায় নোটিস প্রকাশ করে।
ডিজঅনারকারী ব্যাংক নির্ধারণ: ১৮৮১ সালে করা আইন দিয়ে বর্তমান সময়ে চেক ডিজঅনার করতে কালেক্টিং ব্যাংকার ও পেয়িং ব্যাংকারের ঠেলাঠেলির কারণে কখনও কখনও সমস্যায় পড়তে হয় গ্রাহককে। কারণ তৎকালীন সময়ে বা কয়েক বছর আগের ব্যাংকিং ব্যবস্থার কথাও যদি বিবেচনা করি, তাহলে দেখতে পাই, আগের দিনে একটি চেকের পেমেন্ট নিতে চেকের প্রাপককে চেকদাতার শাখায় গিয়ে তারপর চেকটির নগদ পেমেন্ট নিতে হতো, অথবা প্রাপক তার নিজের ব্যাংকের (চেকদাতার ব্যাংকের একই বা ভিন্ন কোনো শাখা যেখানে প্রাপকের অ্যাকাউন্ট আছে, অথবা অন্য কোনো ব্যাংকের শাখা, যেখানে প্রাপকের অ্যাকাউন্ট আছে) মাধ্যমে নিজের হিসাবে কালেকশন করিয়ে নিতেন। বর্তমানেও এ পদ্ধতিগুলো চালু আছে। তবে এর পাশাপাশি চেক পরিশোধ পদ্ধতিতে অনেক যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে যোগ হয়েছে অনলাইন, ব্যাচের মতো একাধিক নতুন, দ্রুততর ও প্রযুক্তিনির্ভর পদ্ধতি। অনলাইন ব্যাংকিংয়ের ফলে এক শাখার চেক একই ব্যাংকের অন্য শাখা থেকে ক্যাশ করা যাচ্ছে। ব্যাচের মাধ্যমে এক ব্যাংকের চেক অন্য ব্যাংকের মাধ্যমে কালেকশন হয়ে যাচ্ছে দিনে দিনেই। তবে সমস্যা দেখা দিচ্ছে নতুন এসব পদ্ধতিতে চেক ডিজঅনার করা নিয়ে। যেমন এক. একই ব্যাংকের অন্য কোনো শাখা থেকে অনলাইনে উত্তোলন করতে গেলে ডিজঅনারকারী শাখা নির্ধারণ; দুই. ভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে ওবিসি বা ব্যাচের মাধ্যমে কালেকশনের উদ্দেশ্যে জমাকৃত চেক ডিজঅনার হলে, ডিজঅনারকারী ব্যাংক হিসাবে গ্রাহককে ডিজঅনার মেমো কে দেবে?
মামলার স্থানীয় অধিক্ষেত্র ও সাক্ষী হিসেবে আদালত কি পেয়িং ব্যাংকারকে তলব করবেন, নাকি কালেক্টিং ব্যাংকারকে তলব করবেন: ধরি, মির্জা আসাদুল্লাহ গালিব একটি চেকের গ্রহীতা। মির্জা আসাদুল্লাহ গালিবের (চেকগ্রহীতা) ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ন্যাশনাল ব্যাংকের কিশোরগঞ্জ শাখায়। অন্যদিকে চেকদাতার অ্যাকাউন্ট হচ্ছে প্রাইম ব্যাংকের রাজশাহী শাখায়। এখন প্রাইম ব্যাংকের চেকটি ন্যাশনাল ব্যাংক কিশোরগঞ্জ শাখা (কালেক্টিং ব্যাংক) তার গ্রাহক মির্জা আসাদুল্লাহ গালিবের হিসাবে জমা করার উদ্দেশ্যে ইঅঈঐ-এর মাধ্যমে উপস্থাপন করার পর প্রাইম ব্যাংক রাজশাহী শাখা চেকটি তহবিল অপর্যাপ্ততার কারণে ডিজঅনার করলে মামলার স্থানীয় অধিক্ষেত্র কোনটি হবেÑকিশোরগঞ্জ নাকি রাজশাহী? এক্ষেত্রে যে ব্যাংকে চেকটি পরিশোধের জন্য উপস্থাপন (প্রেজেন্ট) করা হয়েছে, সেই ব্যাংক (পেয়িং বা পরিশোধকারী ব্যাংক) যে আদালতের স্থানীয় অধিক্ষেত্রে অবস্থিত, সেই আদালতে মামলাটি দায়ের করতে হবে। উপরোল্লিখিত ক্ষেত্রে চেকটি পরিশোধকারী ব্যাংক, অর্থাৎ প্রাইম ব্যাংকের রাজশাহী শাখা যে আদালতের স্থানীয় অধিক্ষেত্রে অবস্থিত, সেই আদালতে মামলাটি দায়ের করতে হবে। অন্যদিকে প্রাথমিকভাবে সাক্ষী হিসেবে আদালত পেয়িং ব্যাংকারকেই তলব করবেন।

আমলি আদালত ও বিচারিক আদালত: এই মামলা নালিশি মামলা বা সিআর মামলা হিসেবে প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দায়ের করতে হবে। মামলা করার সময় আদালতে মূল চেক, ডিজঅনারের রসিদ, আইনি নোটিশ বা বিজ্ঞপ্তির কপি, পোস্টাল রসিদ ও প্রাপ্তি রসিদ প্রদর্শন করতে হবে। এসবের ফটোকপি ফিরিস্তি আকারে মামলার আবেদনের সঙ্গে দাখিল করতে হবে। তবে মামলার বিচার/নিষ্পত্তি হবে দায়রা জজের আদালতে।

শাস্তি: চেক ইস্যুকারী ব্যক্তির অপরাধ প্রমাণিত হলে আদালত তাকে এক বছরের কারাদণ্ড অথবা চেকে বর্ণিত অর্থের তিনগুণ পর্যন্ত অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করতে পারেন।

দেওয়ানি আদালতে মামলা: যদি বিচারক এনআই আ্যাক্টের ১৩৮(১) উপধারা মোতাবেক দণ্ড প্রদান করেন, তবুও চেকের গ্রহীতা বা ধারক চেকে বর্ণিত সম্পূর্ণ বা আংশিক অনাদায়ী টাকা আদায়ের জন্য দেওয়ানি আদালতে মোকদ্দমা (মানি স্যুট) করতে পারবেন। তবে চেকের গ্রহীতা বা ধারক চাইলে এনআই অ্যাক্টে মামলা চলাকালে বা এনআই অ্যাক্টে মামলা করার আগে-পরেও মানি স্যুট করা যাবে। কারণ দুই আদালতের মামলাই স্বতন্ত্রভাবে পাশাপাশি চলতে পারে। তবে সর্বশেষ ডিজঅনারের তারিখ থেকে তিন বছরের মধ্যে মানি স্যুট করতে হবে।
আপিল: ধারা ১৩৮-এর উপধারা (১)-এ প্রদত্ত দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ আছে। তবে আপিল করার পূর্বশর্ত হচ্ছে, চেকে বর্ণিত টাকার কমপক্ষে ৫০ শতাংশ টাকা যে আদালত দণ্ড প্রদান করেছেন, সেই আদালতে জমা দিতে হবে চেক ইস্যুকারীকে।
এনআই অ্যাক্টে মামলা করতে না পারলে: নেগোশিয়েবল ইন্সস্ট্র–মেন্ট অ্যাক্টের ১৩৮ ধারার বিধানমতে যথাসময়ে অথবা যথানিয়মে মামলা দায়ের করতে না পারলে দণ্ডবিধির ৪০৬ ও ৪২০ ধারায় ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে কিংবা থানায় ফৌজদারি মামলা দায়ের করা যাবে। তবে এক্ষেত্রে টাকা ফেরত পাওয়ার সুযোগ নেই। দোষী সাব্যস্ত হলে সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও জরিমানা হতে পারে।

মোশারফ হোসেন, ব্যাংক কর্মকর্তা, কিশোরগঞ্জ ।
mosharafmau.200117@gmail.com

আরও পড়ুন

সর্বশেষ