শুক্রবার, মে ১৭, ২০২৪
প্রচ্ছদচট্রগ্রাম প্রতিদিন১০টি চেক প্রতারণার মামলা দায়ের এক শ্রমিক পরিবারের বিরুদ্ধে!

১০টি চেক প্রতারণার মামলা দায়ের এক শ্রমিক পরিবারের বিরুদ্ধে!

একে একে ১০টি চেক প্রতারণার মামলা দায়ের করা হয় এক শ্রমিক পরিবারের চার সদস্যের বিরুদ্ধে। আদালতে তাদেরকে উপস্থাপন করা হয় শিল্পপতি হিসেবে। ১০টি চেকে ৩ কোটি ২০ লাখ টাকা পাওনার কথা বলেন মামলা দায়েরকারী। এর মধ্যে ৮টি মামলায় ওই শ্রমিক পরিবারের চারজনের বিরুদ্ধে সাজাও করিয়ে নিয়েছেন তিনি। বাকি ২টি মামলা সংশ্লিষ্ট আদালত বাতিল করে দিয়েছেন। ৮ মামলার সাজা হওয়া পর্যন্ত ভুক্তভোগীরা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেননি মামলার বিষয়ে। তার ওপর সাজাপ্রাপ্ত এক নারী আসামিকে পুলিশ ধরে কারাগারে ঢোকায়। গর্ভবতী অবস্থায় কারাগারে যাওয়া এ নারীর সন্তানও নষ্ট হয়ে যায়। আদালতের রায় ঘোষণার পর ২০১৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পুলিশ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে আসামির ইপিজেড থানাধীন নিউমুরিং এলাকার বাড়িতে যায়। তখন থেকে চারজনই পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। কথিত আসামিরা হলেন, রেজিয়া বেগম এবং তার তিন সন্তান ফারহানা সুলতানা, সাবরিনা সুলতানা ও সৈয়দ আবদুল দাইয়ান।
অথচ, যাদেরকে শিল্পপতি বানিয়ে এতগুলো মামলা দায়ের করা হলো, কোনো ব্যাংকে তাদের নামে কোনো একাউন্ট নেই। এ ধরনের ঘটনায় তোলপাড় চলছে আদালত পাড়ায়। শুধু জালিয়াতি নয়, এটাকে ‘মহাজালিয়াতি’ বলছেন আইনজীবীরা। মহাজালিয়াতির এ নায়কের নাম মোহাম্মদ মোরশেদ। বহদ্দারহাটের চেয়ারম্যানঘাটা এলাকার মোহাম্মদ হাকিম শরীফের ছেলে মোরশেদ অবশেষে আইনের আওতায় এসেছেন। উল্লেখিত শ্রমিক পরিবারের পক্ষ থেকে করা মামলায় গত রোববার মোরশেদ মুখ্য মহানগর হাকিম মোহাম্মদ ওসমান গনির আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। তার জামিনের জন্য কয়েকজন আইনজীবী দাঁড়ান। কিন্তু ঘটনার ভয়াবহতা উপলব্ধি করে আদালতের বিচারক মোরশেদের জামিনের আবেদন ফিরিয়ে দেন। এসময় আদালতে উপস্থিত ভুক্তভোগীরা তাদের কষ্টের কথা চিন্তা করে অঝোর ধারায় কাঁদেন। এতে আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। মামলায় মোরশেদের সাথে তার সহযোগী হিসেবে ফটিকছড়ির ভূজপুর থানা এলাকার মৃত নুরুল ইসলামের ছেলে ওয়াহিদুল আলমও রয়েছে।
এর আগে সংশ্লিষ্ট আদালতের আদেশে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) দীর্ঘ তদন্ত প্রতিবেদনে এ ‘মহাজালিয়াতির’ ঘটনা উদঘাটন করা হয়। ২০১৮ সালের ১৭ নভেম্বর মহানগর হাকিম আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে জালিয়াতির পুরো ঘটনা উন্মোচন করেছেন পিবিআইয়ের এসআই মোহাম্মদ জাহেদুজ্জামান চৌধুরী।

মোহাম্মদ মোরশেদ ২০১৫ সালের ১৫, ১৭ ও ২৩ সেপ্টেম্বর ১০টি চেক প্রত্যাখ্যাত (ডিজঅনার) হওয়ার মামলা করেন। এর মধ্যে ৯টি চেক ৩০ লাখ টাকা করে মোট ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা। অন্যটি ৫০ লাখ টাকার চেক প্রত্যাখ্যাত হওয়ার মামলা। আসামিদের মধ্যে রেজিয়া বেগমের স্বামী আবদুল হাই চট্টগ্রাম বন্দরের মজুরিভিত্তিক শ্রমিক। তার দৈনিক মজুরি ৩০০-৪০০ টাকা। রেজিয়ার এক মেয়ে স্নাতক পাস করেছেন। আরেক মেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েছেন। ছেলেটি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় প্রতিনিধি ছিলেন।
মামলায় বাদী মোরশেদের ঠিকানা দেওয়া আছে চান্দগাঁও থানাধীন বহদ্দারহাটের চেয়ারম্যানঘাটার রাফি ভিলা। আরেকটি মামলায় নগরের মতিয়ারপুলের কুমারী লেনের কদমতলী স্কুল গলি ঠিকানা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।

রেজিয়ার স্বামী একজন বাক প্রতিবন্ধী। মোরশেদের কাছের আত্মীয়। ১৫/১৬ বছর আগে রেজিয়ার এক মেয়েকে নিয়ে ঝামেলা করে মোরশেদ। সেই থেকে বিরোধের শুরু।
এছাড়া রেজিয়ার স্বামী বাক প্রতিবন্ধী আবদুল হাই চট্টগ্রাম বন্দরে শ্রমিকের কাজ করতেন। ২০০৭ সালে ছাঁটাইয়ের সময় বন্দর কর্তৃপক্ষ তাকেও ছাঁটাই করে। বিনিময়ে তাকে ২ লাখ ৯০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। মোরশেদ ব্যবসার কথা বলে ওই টাকা ধার চায় বলে পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে। কিন্তু আবদুল হাই এতে সাড়া না দেওয়ায় মোরশেদের সাথে আরেক দফা বিরোধ বাঁধে।
এর মধ্যে মোরশেদের পিতা ২০০৮ সালে তার কদমতলীর পৈত্রিক ভিটা বিক্রি করে দেন। এরপর মানবিক কারণে মোরশেদকে রেজিয়া বেগমের বাড়িতে থাকতে দেন। এ সুযোগে মোরশেদ আবদুল হাইয়ের জায়গাটি আত্মসাৎ করার জন্য তৎপর হলে আবদুল হাই তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। এসময় মোরশেদ আবদুল হাইয়ের পরিবারকে দেখে নেবে বলে হুমকি দিয়ে যায়।

আবদুল হাইয়ের দরিদ্র পরিবারকে মামলায় ‘সানরাইজ টেঙটাইল মিলের’ মালিক সাজানো হয়। এ নিয়ে পিবিআই নাসিরাবাদ শিল্প এলাকায় অনুসন্ধান চালায়। কিন্তু এ ধরনের মিলের কোনো অস্তিত্ব পায়নি। অথচ ১০টি চেকের মামলা সাজানোর সময় উল্লেখিতদের শিল্পপতিই উল্লেখ করা হয়েছিল।

যে একাউন্ট নম্বর দিয়ে মামলাগুলো করা হয়েছে সেই একাউন্ট খুঁেজ বের করতে ব্র্যাক ব্যাংক মোমিন রোড শাখা কর্তৃপক্ষের শরণাপন্ন হন পিবিআইয়ের তদন্ত কর্মকর্তা। ব্যাংক থেকে এ সংক্রান্ত দেওয়া প্রতিবেদন অনুযায়ী আসামিদের কোনো ব্যাংক একাউন্ট এ শাখায় নেই। তবে যে হিসাব নম্বর দেখিয়ে মামলা করা হয়েছে তার গ্রাহক রাহাত মেটাল। এ প্রতিষ্ঠানের মালিক বলুয়ার দিঘি এলাকার হাজী আবদুল বারীর ছেলে আবদুস সাত্তার।
এ নিয়ে আবদুস সাত্তারকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি জানান, ২০০৯ সালে আমি ওই হিসাব নম্বর থেকে ৬ লাখ টাকা লোন নিই। পরিশোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আমার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। পূর্ব পরিচিত হওয়ার কারণে মামলার পরিচালনার ভার মোরশেদকে দেওয়া হয়েছিল।
তিনি আরো জানান, আমি ওই মামলায় জামিন নেওয়ার সময় তিনি জামিনদার হিসেবে জামিননামায় স্বাক্ষর করেন। ব্যাংকের সাথে সমন্বয় করার কারণে ওই মামলাটি পরে প্রত্যাহার করা হয়। ২০১৬ সালের ২৯ মার্চ এ হিসাবটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। মামলা পরিচালনার সময় রাহাত মেটাল স্টোরের ১০টি অব্যবহৃত চেক ব্যাংকে জমা দেওয়ার কথা বলে মোরশেদ আবদুস সাত্তারের কাছ থেকে নিয়েছিলেন। এ চেকগুলোই ব্যবহার করা হয়েছে উল্লেখিত চারজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার সময়।
ভুক্তভোগীরা যাতে মামলা সম্পর্কে কোনো ধরনের তথ্য জানতে না পারে সেজন্য মোরশেদ আদালতের মামলা রুজুর রেজিস্ট্রারে আসামিদের নামের কলামে রেজিয়া বেগম কেটে রফিক গং লিখে রাখেন। এরপর ১০ মামলায় আসামিদের ফাঁসানোর জন্য লোকমান নামে একজন আইনজীবীর (অস্তিত্বহীন) মাধ্যমে ভুয়া ১০ জন পুরুষ-মহিলা দাঁড় করান আদালতে। এরপর উল্লেখিত চারজনের জামিন নেন আদালতকে ধোঁকা দিয়ে। অথচ এ চারজন কিছুই জানেন না। এক্ষেত্রে ভুয়া জামিননামাও তৈরি করা হয়। ফলে মামলা সম্পর্কে জানতেই পারলেন না ভুক্তভোগীরা।
এরপর মামলাগুলো বিচার নিষ্পত্তির জন্য আসে মহানগর দায়রা জজ আদালতে। মামলার বিষয়ে আসামিরা (নির্দোষ) না জানতে দায়রা মামলার রেজিস্ট্রার খাতার পাতা ছিঁড়ে ফেলেন বলে পিবিআই জানায়। ফলে ১০ মামলার মধ্যে ৮ মামলায় তাদের বিরুদ্ধে সাজা হয়ে যায়।
অবশেষে জানতে পারলেন তারা
বাকি ২টি মামলা ৪র্থ মহানগর দায়রা জজ আদালতে রায় পর্যন্ত গড়ায়। এরই মধ্যে আদালতের সন্দেহ হলে রায় পর্যায় থেকে যুক্তিতর্ক পর্যায়ে নিয়ে আসেন বিচারক। ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি পুলিশের কাছ থেকে মামলা ২টি সম্পর্কে জানতে পারেন চার আসামি। পরে একই বছরের ৩ জানুয়ারি আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন লাভ করেন তারা।
অ্যাডভোকেট লোকমান নামে কেউ নেই জালিয়াতির মামলাগুলোতে আইনজীবী হিসেবে দেখানো লোকমান সম্পর্কে জানতে আইনজীবী সমিতি থেকে প্রতিবেদন চাওয়া হয় আদালতের পক্ষ থেকে। আইনজীবী সমিতির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন চৌধুরী প্রতিবেদন দিয়ে জানান, লোকমান নামে কোনো আইনজীবী এসব মামলা পরিচালনায় ছিলেন না। একইসাথে মোহাম্মদ মোরশেদ এ ধরনের কার্যকলাপের সাথে জড়িত রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
যে মামলায় পিবিআইয়ের প্রতিবেদন মহাজালিয়াতির বিষয় নজরে আসার পর আদালতের অনুমতি নিয়ে রেজিয়া বেগমের ছেলে আবদুল দাইয়ান বাদী হয়ে আদালতে একটি মামলা দায়ের করে প্রতিকার চান। মামলায় আসামি করা হয় মোহাম্মদ মোরশেদ ও ওয়াহিদুল আলমকে।
আদালত মামলাটি গ্রহণ করে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে পিবিআইকে নির্দেশনা দেন। ২০১৮ সালের ১২ আগস্ট এ মামলা দায়ের করা হয়। পিবিআই মামলাটি তদন্তে বাদীর নির্দেশিত ৪ ও নিরপেক্ষ ৭ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করে।
এ মামলায় রোববার আদালতে হাজির হয়ে আসামি মোরশেদ জামিনের আবেদন জানালে বিচারক তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। আসামি মোরশেদ এক অতিরিক্ত পিপির মুন্সি বলে পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ