বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২৫, ২০২৪
প্রচ্ছদটপরাজনীতিতে চট্টগ্রামের অভিভাবক জননেতা আখতারুজ্জামান চৌধুরী

রাজনীতিতে চট্টগ্রামের অভিভাবক জননেতা আখতারুজ্জামান চৌধুরী

আখতারুজ্জামান চৌধুরী রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী নেতা, শিল্পপতি, সংবিধান প্রণয়নকারী গণপরিষদ ও সংসদ সদস্য, সমাজসেবী, বিদ্যোৎসাহী, উদার হৃদয় পুরম্নষ ছিলেন। তিনি বর্ণাঢ্য, আকর্ষণীয় জীবনের অধিকারী ছিলেন। তাঁর জীবন যখন নিঃশেষ হয়, তখন তিনি চট্টগ্রামের মানুষের কাছে তাদের অভিভাবকরূপে চিহ্নিত, জনপ্রিয়তায় সবাইকে ছাড়িয়ে ছাপিয়ে এত উঁচুতে উপনীত হয়েছিলেন যে, তিনি তখন এক কিংবদনত্মী-জননেতা। একটি দলেরই নেতা তিনি, কিন’ সর্বদলের কাছেই তখন তাঁর গ্রহণযোগ্যতা। মৃত্যুকালে তিনি আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী সংস’া প্রেসিডিয়ামের সদস্য ছিলেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে চট্টগ্রাম দড়্গিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদক পদাধিকারী ছিলেন।
BABU (139)১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচন, যার রায়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ভিত্তি রচিত হয়, মুক্তিযুদ্ধ হয় এবং বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়, সেই নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আখতারুজ্জামান বাবু প্রবেশ করেছিলেন সংসদীয় জীবনে। সেটা ছিলো তাঁর জীবনের প্রথম নির্বাচন। তারপর আরো পাঁচবার তিনি সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং প্রত্যেকবারই বিজয়ী হয়েছিলেন। অর্থাৎ কোনবারই তিনি ভোটে হারেননি। তাঁর নির্বাচনী এলাকাটা অদ্ভূত-আনোয়ারার মানুষ তিনি, আনোয়ারার ত বটেই, পটিয়ার (বর্তমানে কর্ণফুলী থানা) পাঁচ ইউনিয়ন তাঁর নির্বাচনী এলাকার অনত্মর্গত। একজন মানুষ নিজ এলাকায় পরিচিত হতে পারেন, প্রভাবশালী হতে পারেন এবং সে কারণে ভোটও পেয়ে নিজের বিজয় সুনিশ্চিত করতে পারেন। কিন’ যা’ নিজের থানা বা উপজেলা নয়, সেখানকার মানুষের কাছ থেকেও বারবার ভোট পেয়ে বিজয়ী হওয়া, এটা খুব সহজ সমীকরণ নয়। মানুষের হৃদয় রাজ্যের রাজা না হলে কেউ বারবার এভাবে বিজয় করায়ত্ত করতে পারে না।
আখতারুজ্জামান বাবু একই সঙ্গে ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ। রাজনীতি করার সুবাদে তাঁর সাংগঠনিক অতিজ্ঞতা ছিলো প্রচুর। সেই অভিজ্ঞতা দিয়ে তিনি বুঝেছিলেন ব্যবসা করতে গিয়ে তিনি যেসব সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন অন্যান্য ব্যবসায়িরাও সেসব সমস্যা পোহাচ্ছেন, সুতরাং তাদেরকে সংগঠিত করে ঐসব সমস্যা থেকে প্রতিকারের উপায় খুঁজতে হবে। তিনি এবার চেম্বারের দিকে মনোযোগী হলেন, ১৯৮৬ সালে তিনি চিটাগাং চেম্বারের সভাপতি নির্বাচিত হলেন। পরবর্তী মেয়াদেও ব্যবসায়িরা তাঁকে সভাপতি নির্বাচিত করলো। এরপর তাঁর ঢাকা বিজয়ের পালা। ঢাকা গিয়ে ৮৮ সালের দিকে তিনি দেশের ব্যবসায়িদের সর্বোচ্চ সংস’া এবং চেম্বার সমূহের ফেডারেশন এফবিসিসিআই’র সভাপতি নির্বাচিত হলেন। এফসিবিসিআই সভাপতি হিসেবে তাঁর বড়ো কাজ হচ্ছে এফবিসিসিআইকে একটা ঠিকানা উপহার দেয়া। তাঁর আগে এফসিবিসিআই-এর কাজ চলতো ভাড়া করা অফিসে। তিনিই প্রথম এফসিবিসিআইর জন্য জায়গা খরিদ করে নিজস্ব ভবনে সি’ত করার পদক্ষেপ নেন।
চেম্বার নেতা আখতারুজ্জামান বাবু কিন’ সেখানেই থেমে থাকেন নি। তাঁর আগে জহিরউদ্দিন খান এফবিসিসিআইতে গিয়েছিলেন। মোর্শেদ খান ঢাকা মেট্রোপলিটন চেম্বার প্রতিষ্ঠা করেছেন। কিন’ তাঁরা সেখানেই থেমে গেছেন। কিন’ আখতারুজ্জামান বাবু আরো অগ্রসর হয়ে ৭৭ জাতি গ্রম্নপের চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (জাতিসংঘের একটি প্রতিষ্ঠান) ভাইস চেয়ারম্যান, ওআইসি ভুক্ত দেশসমূহের চেম্বার অব কমার্সের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। চট্টগ্রামাবাসী তো নয়ই, আর কোন বাঙালি ৭৭ জাতি গোষ্ঠীর ভাইস চেয়ারম্যান হতে পারেন নি। এটি একটি বিরল সম্মান, আখতারুজ্জামান বাবুর অনন্য অর্জন।
আখতারুজ্জামান বাবুর পরিবারে পুুঁজির অনুপ্রবেশ ঘটেছিলো তাঁর বড় ভাই বশিরুজ্জামান চৌধুরীর হাত ধরে। বশিরুজ্জামান ষাটের দশকে রীতিমতো প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। আখতারুজ্জামান বাবু বড় ভাইয়ের উৎসাহে ব্যবসায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং এবং ক্রমশ পাকা ব্যবসায়ী হয়ে ওঠেন। ব্যবসায় সিদ্ধি লাভের পর তিনি শিল্প প্রতিষ্ঠার দিকে মনোযোগ নিবদ্ধ করেন। রয়েল ইন্ডাস্ট্রি নামে একটি ছোট ইন্ডাস্ট্রি থেকে তিনি একটি বৃহৎ শিল্প সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে সড়্গম হন। আরামিট নামে, সুইজারল্যান্ডভিত্তিক এসবেস্টর’স সিমেন্টের একটি কারখানার ৫১% শেয়ার কিনে তিনি কারখানাটির পরিচালন ভার গ্রহণ করেন এবং তাঁর সুদড়্গ পরিচালনা ও ব্যবস’াপনায় আরামিট অত্যনত্ম লাভজনক একটি শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
তিনি পঞ্চাশের দশকে থেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৯৫৭ সালে চট্টগ্রাম জেলা ছাত্রলীগের যে কমিটি হয়, তিনি তার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। বাবু ভাই আমাকে বলেছেন তিনি কিছুদিন দক্ষিণ জেলা (সম্ভবত মহকুমা, কারণ তখনো দক্ষিণ জেলা হয়নি) ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
আখতারুজ্জামান বাবুর জীবনে আরো নানা গুণের সমারোহ ঘটেছিলো, যা তাঁকে সমসাময়িক অন্য নেতার চেয়ে বিশেষ মর্যাদা দান করেছে। সেই নেতা তাঁর দলের বা অন্য দলের যা-ই হোক না কেন। তাঁর সামাজিক চরিত্র নানাদিকে বিকশিত হয়ে দেশকে আলোকিত ও সুরভিত করেছিলো। যে কারণে মানুষ আজো তাঁর কথা মনে করে নিরবে নিভৃতে চোখের জল ফেলে। তিনি দান করতেন, ব্যক্তিগতভাবে চুপিচুপি; দেশে বিদেশে অনেক মানুষ তাঁর কাছ থেকে উপকার পেয়েছে, কেউ তাঁর স্মরণাপন্ন হলে তিনি তাঁকে বিমুখ করেন না। জনাব আখতারুজ্জামান চৌধুরী তৃণমূল পর্যায় থেকে রাজনীতি করে বৃহত্তর রাজনৈতিক ড়্গেত্রে প্রবেশ করেন। আখতারম্নজ্জামান বাবু ’৭০ সালে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিজয়ী হয়ে বৃহত্তর রাজনৈতিক অঙ্গনে পা রাখেন। এমপিএ নির্বাচনে অংশগ্রহণের পূর্বে তিনি তাঁর এলাকা হাইলধর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। স্বাধীনতার পরেও তিনি আনোয়ারা থানা উন্নয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন।
হাইলধর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকালীন সময়টুকু তাঁর জীবনের জন্য অত্যনত্ম গুরম্নত্বপূর্ণ ও স্মরণীয় একটি অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। হাইলধর তাঁর রাজনীতি ও সমাজসেবার ভিত্তি। সেখানে তিনি গ্রামীণ সমাজ কাঠামো, ক্ষমতা কাঠামো, গ্রামীণ নেতৃত্ব এবং জনমানস সম্পর্কে বাসত্মব জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা লাভ করেন। হাইলধর ও আনোয়ারা থেকে তিনি রাজনীতির যে পাঠ নেন, সেটাই হয় তাঁর পরবর্তী জীবনের মূল্যবান পাথেয়। পরবর্তীকালে তাঁকে চট্টগ্রামের রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিতে হয় এবং আরো পরে সময় যখন তাঁকে জাতীয় নেতৃত্বের সত্মরে উপনীত করে, তখন হাইলধর জীবনের সঞ্চিত অভিজ্ঞতা তাঁকে পথ প্রদর্শন করেছে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ