শনিবার, এপ্রিল ২৭, ২০২৪
প্রচ্ছদইসলাম ও জীবনআত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা : আমাদের করণীয়! - একটি ধর্মীয় ব্যাখ্যা

আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা : আমাদের করণীয়! – একটি ধর্মীয় ব্যাখ্যা

মানুষ কখনোই একা বসবাস করতে পারে না। আত্মীয় স্বজন , বন্ধু বান্ধব আর পাড়া প্রতিবেশী নিয়েই মানুষের বসবাস। শুধু একসাথে বসবাস করলেই তো হবে না, থাকতে হবে পারস্পরিক সু-সম্পর্ক। কিন্তু বর্তমানে আমাদের লাইফ স্টাইল এমনভাবে পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে যে, সম্পর্কের মূল্যবোধগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।মানুষের মাঝে ভালোবাসা, দয়া, সহযোগিতার মূল ভিত্তি হচ্ছে আত্মীয়তার সম্পর্ক। এই সম্পর্ক নষ্ট হলে সমাজ বিনষ্ট হবে। আত্মীয়তার সম্পর্ক বলতে বুঝানো হয়, পিতা-মাতা, ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে এবং এসবের উর্ধ্বতন ও নি¤œতন আত্মীয়। আবার প্রতিবেশীরা আত্মীয় না হলেও তাদের সাথে আত্মীয়দের মত সম্পর্ক বজায় রাখতে বলা হয়েছে।
মানুষ এখন একা থাকতে চায়, নিজের সুযোগ সুবিধাই তার কাছে বেশী প্রাধান্য পায়। সমাজের সিস্টেমটাই এমন ভাবে তৈরি করা হয়ে গিয়েছে। মানুষ এখন প্রচণ্ড ব্যস্ত এবং ইচ্ছে থাকলেও মানুষ আত্মীয় স্বজনের বাসায় যেতে পারে না , এমনকি খোঁজ খবর নিতেও তার সময় থাকে না। বেশীর ভাগ মানুষ সপ্তাহের ছয় দিন কাজে ব্যস্ত। আর একদিন থাকে ছুটির দিন। সেইদিনে মানুষ তার ব্যক্তিগত কাজগুলো সেরে নেয় অথবা রিল্যাক্স করে। বিয়ে বাড়িতে দাওয়াত দিলে বা কেউ মারা গেলে সেখানে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের এখন এমন পরিস্থিতি যে, সেখানে গেলে অনেক আত্মীয় স্বজনের সাথে দেখা সাক্ষাত হবে, এই মন মানসিকতা নিয়েই যাই। এটা কোন দোষের ব্যাপার না। কিন্তু আমাদের ব্যস্ত জীবন আমাদেরকে এভাবে ভাবতে বাধ্য করে, যেখানে কিনা সবসময়ই আমাদের আত্মীয় স্বজনের খোজ খবর রাখা উচিৎ।
আতœীয়তার বন্ধন রক্ষা করা উত্তম কাজ। আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার ব্যাপারে পবিত্র কুরআন এবং হাদিসে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। বিশেষ করে নিকটাত্মীয়ের অধিকার রক্ষার ব্যাপারে লোকদের উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। আজ বড়ই পরিতাপের বিষয়, আমাদের সমাজের অনেক মুসলমানই পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য ও আত্মীয়-স্বজনের অধিকার সম্পর্কে একেবারেই অসচেতন। তারা আতœীয়-স্বজনের সঙ্গে মিলনের সেতুবন্ধকে ছিন্ন করে চলছেন। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, আমার আত্মীয়রাই তো সুসম্পর্ক বজায় রাখছেন না। আমি একাই এর জন্য দায়ী নই। কিন্তু এ বক্তব্য তাদের কোনো উপকারে আসবে না। কারণ যে আতœীয়তার সম্পর্ক ঠিক রাখবে, শুধু তার সঙ্গেই সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে- এই যদি নীতি হয় তাহলে তা আল্লাহর জন্য হলো না, বরং তা হলো বদলা।
আল্লাহ  তাআলা বলেন, ‘আর আল্লাহর বন্দেগী কর এবং তার সাথে কাউকে শরীক করো না, এ ছাড়া মাতা-পিতার সাথেও উত্তম আচরণ কর, আর উত্তম আচরণ কর নিকটাতœীয়ের সাথে।’ [সূরা আন-নিসা: ৩৬]
ইসলামে আত্মীয়তা সম্পর্ক রক্ষা করা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আতœীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা জাহান্নামে যাওয়ার অন্যতম কারণ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ক্ষমতা লাভ করলে সম্ভবত তোমরা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করবে এবং আতœীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে। এদের প্রতি আল্লাহ তায়ালা অভিসম্পাত করেন, অতঃপর তাদের বধির ও দৃষ্টি শক্তিহীন করেন।’[সুরা মুহাম্মদ : ২২-২৩]
হযরত যুহায়র ইবনু মুতঈম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত যে, রাসুলে পাক  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  বলেছেনঃ বলেছেনঃ সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না। ইবনু আবূ উমর (রহমাতুল্লাহ আলাইহি) বলেন, সুফিয়ান বলেছেন, অর্থাৎ আতœীয়তা সম্বন্ধ ছিন্নকারী। (সহীহ মুসলিম,হাদিস নং-৬২৮৯)

আতœীয়তার প্রকারঃ
আতœীয় প্রধানত দু’প্রকার। যথা-
(১) রক্ত সম্পর্কীয় বা বংশীয়। যেমন পিতা-মাতা, দাদা-দাদী, ভাইবোন, চাচা-চাচী, মামা-খালা ইত্যাদি।
(২) বিবাহ সম্পর্কীয়। যেমন শ্বশুর-শ্বাশুড়ি, শ্যালক-শ্যালিকা ইত্যাদি।
যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,‘নিশ্চয়ই তোমরা অচিরেই মিসর জয় করবে। সেটা এমন একটি ভূমি যাকে ‘কবীরাত্ব’ বলা হয়। অর্থাৎ যেখানে দীনার-দিরহামের প্রাচুর্য রয়েছে। যখন তোমরা সেটা জয় করবে, তখন সেখানকার অধিবাসীদের সাথে উত্তম ব্যবহার করবে। কেননা তাদের জ্ঞাতি সম্পর্ক রয়েছে। অথবা তিনি বলেছেন, বংশীয় ও বৈবাহিক সম্পর্ক রয়েছে’। অর্থাৎ ইসমাঈল (আলাইহিস সালাম)-এর মাতা হাজেরার দিক দিয়ে বংশীয় বা রক্ত সম্পর্ক এবং রাসূলপতœী মারিয়া কিবতিয়ার দিক দিয়ে বৈবাহিক সম্পর্ক। [মুসলিম হা/২৫৪৩; মিশকাতহা/৫৯১৬।]
পরিত্যক্ত সম্পদের অধিকারী হওয়ার দিক দিয়ে আতœীয় দু’প্রকার। (১) উত্তরাধিকারী, যেমন- পিতা-মাতা, ভাই-বোন, স্ত্রী, পুত্র-কন্যা প্রভৃতি (২) উত্তরাধিকারী নয়, যেমন- চাচা-চাচী, মামা-খালা ইত্যাদি।
আতœীয়তার সম্পর্ক রক্ষার হুকুমঃ
আতœীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার হুকুম ফরয, সুন্নাত ও বৈধ বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে অবস্থার প্রেক্ষিতে এবং আতœীয়দের ভিন্নতার কারণে। তবে সাধারণভাবে সবার সঙ্গে আতœীয়তার বন্ধন অক্ষ্যুণ্য রাখা ওয়াজিব এবং সম্পর্ক ছিন্ন করা সকলের ঐক্যমতে হারাম। তবে কারো কারো নিকটে কবীরা গোনাহ।
(১) ফরযঃ পিতা-মাতার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা ফরয। কেননা আল্লাহ  পাক বলেন,
‘আমরা মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি তার পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে’ (সূরা আনকাবূত,আয়াতঃ ৮)।
মহান আল্লাহ আরো বলেন, ”আর তোমার রব আদেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদাত করবে না এবং পিতা-মাতার সাথে সদাচরণ করবে। তাদের একজন অথবা উভয়েই যদি তোমার নিকট বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে ‘উফ’ বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না। আর তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বল।
(সূরা বনী ইসরাঈল,আয়াতঃ ২৩-২৪)।
পিতা-মাতার সাথে সম্পর্ক রক্ষার ব্যাপারে হাদীছে অনেক নির্দেশ এসেছে। আর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করাকে বড় গোনাহ বলা হয়েছে। যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনবার বললেন,
আবদুর রাহমান ইবনু আবী বাকরা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে তার বাবার সূত্রে বর্ণিত আছে, তিনি (আবূ বাকরা) বলেন, রাসূলুল্লাহ  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমি কি তোমাদেরকে সর্বাধিক কাবীরা গুনাহের ব্যাপারে জানিয়ে দিবো না? সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। অবশ্যই জানিয়ে দিন। তিনি বললেনঃ আল্লাহ্ তা’আলার সাথে অংশীদারিতু স্থাপন করা এবং বাবা-মায়ের অবাধ্য হওয়া।বর্ণনাকারী বলেন, তিনি হেলান দিয়ে বসা ছিলেন। তিনি সোজা হয়ে বসেন এবং বলেনঃ এবং মিথ্য সাক্ষ্য দেয়া ও মিথ্যা বলা। একথাটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবিরতভাবে বলতে থাকেন। আমরা (মনে মনে) বলতে লাগলাম, আহা! তিনি যদি থামতেন, চুপ করতেন! [তিরমিযী হাদিস নং-১৯০১]
আব্দুল্লাহ ইবনু আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, এক বেদুইন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! কবীরা গুনাহসমূহ কি? তিনি বললেন,উমাইর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) সূত্রে বর্ণিত। যিনি সাহাবী ছিলেন। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলো, হে আল্লাহর রাসূল! কোনগুলি কবীরাহ গুনাহ? তিনি বললেনঃ এর সংখ্যা নয়টি। অতঃপর উপরোক্ত হাদীসের অনুরূপ বর্ণিত। এতে আরো রয়েছেঃ মুসলিম পিতা-মাতাকে কষ্ট দেয়া এবং তোমাদের জীবন-মরণের কিবলাহ কা‘বা ঘরের চত্বরে নিষিদ্ধ কাজকে হালাল গণ্য করা। [আবু দাউদ হাদিস নং-২৮৭৫]
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -কে জিজ্ঞেস করলাম,
‏আবদুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -কে জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহর  নিকট কোন্ কাজ সব থেকে অধিক পছন্দনীয়? তিনি বললেনঃ সময় মত সালাত আদায় করা। ‘আবদুল্লাহ) জিজ্ঞেস করলেনঃ তারপর কোনটি? তিনি বললেনঃ পিতা-মাতার সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করা। ‘আবদুল্লাহ জিজ্ঞেস করলেনঃ তারপর কোনটি? তিনি বললেনঃ আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। ‘আবদুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বললেনঃ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এগুলো সম্পর্কে আমাকে বলেছেন। আমি তাঁকে আরও অধিক প্রশ্ন করলে, তিনি আমাকে আরো জানাতেন। [বুখারী হাদিস নং-৫৯৭০]
অন্যত্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  ইরশাদ করেছেন ,হযরতআবূ হুরায়রা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  ইরশাদ করেছেন  ঃ সে ব্যক্তির নাক ধুলিমলীন হোক, আবার সে ব্যক্তির নাক ধুলিমলীন হোক, সে ব্যক্তির নাক ধূলায়মলীন হোক! বলা হল ইয়া রাসুলুল্লাহ! কার? যে ব্যক্তি তার পিতামাতা উভয়কে কিংবা একজনকে বার্ধক্যাবস্থায় পেল এবং সে জান্নাতে প্রবেশ করার সুযোগ লাভ করল না। । [মুসলিম হাদিস নং- ৬২৭৯]
(২) সুন্নাতঃ অন্যান্য আতœীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করা সুন্নাত। যেমন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  এর হাদিস,
উম্মুল মুমেনীন হযরত আয়িশা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  বলেছেনঃ রেহম (আত্মীয়তার সম্বন্ধ) আল্লাহ পাক এর  আরশের সাথে ঝুলন্ত রয়েছে। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি আমার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখবে আল্লাহ  তার সাথে সম্পর্ক রাখবেন। আর যে আমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে আল্লাহ পাক তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবেন। (সহীহ মুসলিম হাদিস নং-৬২৮৮)
(৩) মানদূব বা বৈধঃ কাফির-মুশরিক পিতা-মাতার সাথে সন্তানের সুসম্পর্ক বজায় রাখা বৈধ। যেমন আল্লাহ পাক বলেন,
আর যদি তারা তোমাকে আমার সাথে শির্ক করতে জোর চেষ্টা করে, যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তখন তাদের আনুগত্য করবে না এবং দুনিয়ায় তাদের সাথে বসবাস করবে সদ্ভাবে। আর অনুসরণ কর তার পথ, যে আমার অভিমুখী হয়। তারপর আমার কাছেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন। তখন আমি তোমাদেরকে জানিয়ে দেব, যা তোমরা করতে। (সুরা লুকমান, আয়াতঃ ১৫)
হযরত আসমা বিনতে আবূ বাকর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  -এর যুগে আমার আম্মা মুশরিক অবস্থায় আমার নিকট এলেন। আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  )-এর নিকট ফাতওয়া চেয়ে বললাম, তিনি আমার প্রতি খুবই আকৃষ্ট, এমতাবস্থায় আমি কি তার সঙ্গে সদাচরণ করব? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তুমি তোমার মায়ের সঙ্গে সদাচরণ কর। [বুখারী হাদিস নং- ২৬২০]
আতœীয়দের মাঝে মর্যাদা বা স্তরের ভিন্নতাঃ
আত্মীয় নিকটত্ব ও দূরত্বের ভিত্তিতে এবং বংশ ও স্থানের দূরত্বের দৃষ্টিকোণে ভিন্নতর হয়ে থাকে। সুতরাং বংশীয় দিক দিয়ে নিকটাত্মীয় হচ্ছেন পিতা-মাতা। তবে এর মধ্যে মায়ের স্তর ঊর্ধ্বে। যেমন আল্লাহ বলেন,
“আর আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের জোর নির্দেশ দিয়েছি। তার মাতা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে। তার দুধ ছাড়ানো দু বছরে হয়। নির্দেশ দিয়েছি যে, আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। অবশেষে আমারই নিকট ফিরে আসতে হবে। (সূরা লোক্বমান,আয়াতঃ ১৪)।
হাদীছ শরীফে এসেছে,
হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  এর নিকটে এসে জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  ! আমার নিকট কে উত্তম ব্যবহার পাওয়ার অধিক হকদার? তিনি বললেন, ‘তোমার মা’। লোকটি বলল, তারপর কে? তিনি বললেন, ‘তোমার মা’। সে বলল, অতঃপর কে? তিনি বললেন, ‘তোমার পিতা’। [বুখারী হাদিস নং- ৫৯৭১]
অন্যত্র তিনি (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)বলেন,
হযরত মুগির রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  বলেছেনঃ আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের উপর হারাম করেছেন, মা-বাপের নাফরমানী করা, প্রাপকের প্রাপ্য আটক রাখা, যে জিনিস গ্রহণ করা তোমাদের জন্য ঠিক নয় তা তলব করা এবং কন্যা সন্তানকে জীবিত ক্ববর দেয়া। আর তিনি তোমাদের জন্য অপছন্দ করেছেন গল্প-গুজব করা, অতিরিক্ত প্রশ্ন করা ও সম্পদ অপচয় করা।
[বুখারী হাদিস নং- ৫৯৭৫]
নিকটাতœীয়ের মধ্যে ভাই-বোনও অন্তর্ভুক্ত। তবে ভাই-বোন বৈমাত্রেয় ও বৈপিত্রেয় হয়ে থাকে। আবার সম্পর্কের কারণে তারা দূরবর্তীও হয়। যেমন চাচাত, মামাত, খালাত, ফুফাত ভাই।
আবার স্থানের দূরত্বের কারণেও স্তরের ভিন্নতা হয়। যেমন নিজ মহল্লা ও নিজ শহরে বসবাসকারী আত্মীয় নিকটের। পক্ষান্তরে ভিন্ন মহল্লায় ও ভিন্ন শহরে বসবাসকারী আত্মীয় দূরের অন্তর্ভুক্ত। তবে রক্ত বা বংশ সম্পর্কিত আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা জরুরী অন্যদের অপেক্ষা। এখানে সময়ের কোন নির্ধারিত সীমা নেই। আজীবন এ সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে।
আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার গুরুত্ব ও ধর্মীয় ব্যাখ্যা
আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা অতি জরূরী। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন “তোমরা ইবাদাত কর আল্লাহর, তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করো না। আর সদ্ব্যবহার কর মাতা-পিতার সাথে, নিকট আত্মীয়ের  সাথে, ইয়াতীম, মিসকীন, নিকট আতœীয়- প্রতিবেশী, অনাতœীয়- প্রতিবেশী, পার্শ্ববর্তী সাথী, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাভুক্ত দাস-দাসীদের সাথে। নিশ্চয় আল্লাহ পছন্দ করেন না তাদেরকে যারা দাম্ভিক, অহঙ্কারী।”
(সূরা আন-নিসা,আয়াতঃ ৩৬)
আল্লাহপাক রাব্বুল আলামীন আরো বলেন
েেহ মানুষ, তোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এক নফ্স থেকে। আর তা থেকে সৃষ্টি করেছেন তার স্ত্রীকে এবং তাদের থেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বহু পুরুষ ও নারী। আর তোমরা আল্লাহকে ভয়কর, যার মাধ্যমে তোমরা একে অপরের কাছে চেয়ে থাক। আর ভয় কর রক্ত-সম্পর্কিত আত্মীয়ের ব্যাপারে। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর পর্যবেক্ষক। (সূরা আন-নিসা,আয়াতঃ ১)
মহান আল্লাহ পাক আরো বলেন,“আর আল্লাহ যে সম্পর্ক অটুট রাখার নির্দেশ দিয়েছেন, যারা তা অটুট রাখে এবং তাদের রবকে ভয় করে, আর মন্দ হিসাবের আশঙ্কা করে।” (সূরা আর রা‘দ,আয়াতঃ ২১)।
আল্লাহ বলেন,“ আর স্মরণ কর, যখন আমি বনী ইসরাঈলের অঙ্গীকার গ্রহণ করলাম যে, তোমরা আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদাত করবে না এবং সদাচার করবে পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম ও মিসকীনদের সাথে। আর মানুষকে উত্তম কথা বল, সলাত কায়েম কর এবং যাকাত প্রদান কর। অতঃপর তোমাদের মধ্য থেকে স্বল্প সংখ্যক ছাড়া তোমরা সকলে উপেক্ষা করে মুখ ফিরিয়ে নিলে। (সূরা বাক্বারাহ,আয়াতঃ ৮৩)
তিনি (আল্লাহপাক রাব্বুল আলামীন )আরো বলেন,
তবে কি তোমরা প্রত্যাশা করছ যে, যদি তোমরা শাসন কর্তৃত্ব পাও, তবে তোমরা যমীনে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং তোমাদের আতœীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে? (সূরা মুহাম্মাদ,আয়াতঃ ২২)
অন্যত্র তিনি (আল্লাহপাক রাব্বুল আলামীন )বলেন,
আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ ও আত্মীয়-স্বজনকে দানের নির্দেশ দেন। (সূরা নাহল,আয়াতঃ ৯০)
তিনি (আল্লাহপাক রাব্বুল আলামীন )আরো বলেন,
আর আতœীয়কে তার হক দিয়ে দাও এবং মিসকীন ও মুসাফিরকেও। আর কোনভাবেই অপব্যয় করো না।
(সূরা ইসরাঈল,আয়াতঃ ২৬)
অতএব আতœীয়-স্বজনকে তাদের হক দিয়ে দাও এবং মিসকীন ও মুসাফিরকেও। এটি উত্তম তাদের জন্য, যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি চায় এবং তারাই সফলকাম। (সূরা আর-রূম,আয়াতঃ ৩৮)
হাদীছ শরীফে ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার ব্যাপারে অনেক তাকীদ করেছেন :
যেমন- হযরত যুহায়র ইবনু মুতঈম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত যে, রাসুলে পাক  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  বলেছেনঃ বলেছেনঃ সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না। ইবনু আবূ উমর (রহমাতুল্লাহ আলাইহি) বলেন, সুফিয়ান বলেছেন, অর্থাৎ আতœীয়তা সম্বন্ধ ছিন্নকারী। (সহীহ মুসলিম,হাদিস নং-৬২৮৯)
আনাস ইবনু মালিক (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  কে বলতে শুনেছি, যাকে এ বিষয়টি আনন্দিত করে যে, তার রিযিক (জীবিকায়) সচ্ছলতা দেয়া হোক অথবা (এবং) তার অবদান আলোচিত হোক (দীর্ঘায়ু দেয়া হোক) সে যেন তার আতœীয়তার সংযুক্ত রাখে। (সহীহ মুসলিম,হাদিস নং-৬২৯২)
উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা এবং ঐ সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ ও অটুট রাখার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা সবার জন্য আবশ্যক। যে ব্যাপারে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  আমাদেরকে বিশেষভাবে নির্দেশ দিয়েছেন। এ সম্পর্ক বজায় রাখলে ইহকালীন ও পরকালীন ফায়দা রয়েছে। আবার এ সম্পর্ক ছিন্ন করলে পরকালে শাস্তি রয়েছে। তাই আত্মীয়তার সম্পর্ক সংরক্ষণে আমাদেরকে যথা সম্ভব সচেষ্ট হতে হবে। আল্লাহ  আমাদেরকে আতœীয়তার বন্ধন রক্ষা করার  তৌফিক দান করুণ । আমিন।Muhammad Obidur Rahman

লেখনী  : মোহাম্মদ ওবায়দুর রহমান

ইমেইল : patanshah@gmail.com মোবাইল ঃ ০১৮১৮৬২৫৪৭১

আরও পড়ুন

সর্বশেষ