শনিবার, মে ৪, ২০২৪
প্রচ্ছদচট্রগ্রাম প্রতিদিনমানুষের সাথে না মিশলে মানুষ চেনা কঠিন : জেলা প্রশাসক চট্টগ্রাম

মানুষের সাথে না মিশলে মানুষ চেনা কঠিন : জেলা প্রশাসক চট্টগ্রাম

দারিদ্র্যতাকে খুব কাছে থেকে দেখেছেন বলেই হতদরিদ্র মানুষগুলোর কষ্টকে অনুভব করতে পারেন। বুঝতে চেষ্টা করেন দিনশেষে তাঁদের খুব বেশি চাওয়ার থাকে কি না ? হতদরিদ্র মানুষের কষ্টগুলোকে ছুঁতে পারলে আহ্লাদে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর উঠে তাঁর। অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে নিজেকে চেনা, জানা ও বোঝার চেষ্টা করেন আত্মপ্রত্যয়ী এই তরুণ। লাজ-লজ্জা ঝেরে ফেলে মনের দর্পণে খুঁজেন আপন শৈশব, কৈশোর। কণ্ঠে তাঁর দ্বিধাহীন স্বীকারোক্তিÑ খুব অল্প বেতনের চাকরি করতেন বাবা। পাঁচ ভাই-বোনের লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে যেখানে সংসার চালানো দায়- সেখানে নতুন কাপড়ের বিলাসিতা খুব কম সময়েই পূরণ হতো আমাদের। বিশেষ করে ইদ ছাড়া নতুন জামা-কাপড় খুব একটা পাওয়া হতো না। বলেন, বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দূরে ছিলো আমাদের প্রাইমারি স্কুল। অতোটুকু বয়সে বইখাতা হাতে স্কুলে দৌড়াতে হতো গ্রামের আলপথ দিয়ে। পাড়ি দিতে হতো খাল-বিল। বেড়ার স্কুল ঘরেই আমার প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি। সেই প্রাইমারি স্কুলেই শিষ্যত্ব পেয়েছিলাম আব্দুর রহমান নামে এক শিক্ষকের। করদি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন তিনি।

‘আব্দুর রহমান স্যারের ¯েœহ-ভালোবাসা আজকের এই আমি’ -অকপটে জানালেন তিনি। তিনি চট্টগ্রাম জেলার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন। গত ৬ মার্চ, ২০১৮ তারিখে চট্টগ্রাম জেলার জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন সদালাপী, বিনয়ী এই মানুষটি।

তিনি বলেন- মা, বাবার প্রাণান্তক চেষ্টা ও অনুপ্রেরণার পাশাপাশি আমার এই সাফল্যে আরও একজন মানুষ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছেন। তিনি হলেন, আমার দাদা মৃত মইজ উদ্দিন সরদার। ধার্মিক এই মানুষটি আমাকে প্রায় বলতেন, ‘তুই হাকিম হবি।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্য অনুষদে পড়া এই আমাকে দাদা যখন বলতেন,তুই হাকিম হবিÑ আমি হাসতাম। মনে মনে ভাবতাম,হিসাবের মানুষ আবার বিচারক হয় কীভাবে ! অজ পাড়াগাঁয়ের সেই অর্ধশিক্ষিত মানুষটির কথাই সত্য হলো একসময়। ২০০১ সালে ২০তম (বিসিএস) সিভিল সার্ভিস ক্যাডারে (প্রশাসন) চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হই আর একই বছর সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বাগেরহাট জেলাতে যোগদান করি। বলেন, দাদার কথা মনে হলে আমি এখনো বিস্মিত হই, কী করে তিনি জানতেন আমি হাকিম হবো !

শিক্ষা জীবনে জয়নুল আবেদিন নামে আরও একজন মহান মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন তিনি। ইলিয়াস হোসেন বলেন, সম্পর্কে মামা হলেও শিক্ষক হিসেবে এগিয়ে যাবার পথটা মসৃণ করতে অনেক বেশি ভূমিকা রেখেছেন তিনিও। মাদারীপুর জেলার সদর উপজেলার চিড়াইপাড়া গ্রামে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারির প্রথম তারিখে জন্ম মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন-এর। ১৯৭৭ সালে। বাবা মোহাম্মদ তালেব আলী সরদার এ,আর হাওলাদার জুট মিলে চাকরি করতেন। মা ফিরোজা বেগম গৃহিণী।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিটি ক্লাসেই প্রথম ছিলেন তিনি। ক্লাসের প্রথম ছাত্র ছিলেন হাইস্কুলেও। ১৯৯১ সালে আলহাজ আমিন উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে স্টারমার্কসসহ প্রথম বিভাগে এসএসসি পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৯৩ সালে খোয়াজপুর সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় ঢাকা বিভাগে সম্মলিত মেধা তালিকায় সপ্তম স্থান অর্জন করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৩-৯৪ সেশনে বাণিজ্য অনুষদে ভর্তি হয়ে সেখান থেকে বি.কম অনার্স ও এম.কম মাস্টার্স পাস করেন।

২০০০ সালে বেসরকারি ব্যাংক এবি ব্যাংকে প্রবেশনারি অফিসার হিসেবে নিয়োগ পান ইলিয়াস হোসেন। ব্যাংকিং খাতে পেশাগত জীবন শুরু হলেও ২০০১ সালে বাংলাদেশ সরকারের সিভিল সার্ভিস প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগ পান মাদারীপুর জেলার অজ পাড়াগাঁয়ের মেধাবী এই তরুণ। বিসিএস কর্মকর্তা হিসেবে ২৮ মে, ২০০১ সালে সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বাগেরহাট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে যোগদান করেন। ২০০৪ সালের ৭ ডিসেম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে ঝিনাইদহে পোস্টিং হয় তাঁর। ঝিনাইদহে ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালীন বারবার হোঁচট খেয়েছেন প্রশাসন ক্যাডারে স্বচ্ছ ইমেজের এই ন্যায় বিচারক। কিন্তু কখনো হার মানেননি তিনি। চরমপন্থী গোষ্ঠী, স্থানীয় রাজনীতিবিদ, সন্ত্রাসীদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে জনস্বার্থে চালিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান। পরিবেশ রক্ষার্থে বন্ধ করেছেন অনুমোদনহীন অসংখ্য ইটভাটা। দুইপক্ষের গোলাগুলির মাঝখানে দাঁড়িয়েও স্বাভাবিক রেখেছেন আইনশৃঙখলা পরিস্থিতি। তবুও প্রাণের ভয়ে পিছু হটেননি তিনি।

জাপান সরকারের আমন্ত্রণে ২০০৭ সালে উচ্চ শিক্ষার্থে জাপান যান তিনি। ২০০৯ সালে ইয়ামাগুচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে দ্বিতীয়বার এম.এস ডিগ্রি অর্জন করেন। ২ ডিসেম্বর ২০০৯ থেকে ২০১২ পর্যন্ত যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সড়ক ও রেলপথ বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব ছিলেন। এরপর ২৬ জুন, ২০১২ থেকে ১১ মে, ২০১৪ পর্যন্ত ছিলেন খুলনার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি)। ১২ মে, ২০১৪ থেকে ১৪ মে, ২০১৬ মেয়াদে মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন চট্টগ্রাম জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) এবং অতিরিজলা প্রশাসক (রাজস্ব) হিসেবে সাফল্যের সাথে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ২০১৫ সালে ৬ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের উপসচিব পদে পদোন্নতি পান। ১৫ মে, ২০১৬ সালে যোগদান করেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের উপসচিব হিসেবে পুলিশ অধিশাখার দায়িত্ব পালন করেন চলতি বছর ১ মার্চ পর্যন্ত। ৫ মার্চ জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে চট্টগ্রাম জেলায় যোগদান করেন এবং ৬ মার্চ জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ইতোমধ্যে তিনি দেশ ও বিদেশে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, সেমিনার, ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, ইতালি, জার্মানি, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, সাইপ্রাস, বুলগেরিয়া, দুবাই, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভারত ও তুরস্ক।

পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে দ্বিতীয় মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন। বড় বোন রুবিয়া খাতুন, ছোট বোন আয়েশা আক্তার ও আসমা আক্তার গৃহিণী। ছোটভাই কাওসার হোসেন ব্যবসায়ী। ইলিয়াস হোসেন বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন টিউশনি করে মাসিক তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা রোজগার করতাম। মাঝে মাঝে টিউশনির আয় থেকে কিছু টাকা পাঠাতাম ভাইবোনদের জন্য। ছাত্রাবস্থায় টিউশনি করেই আমি নিজের লেখাপড়ার খরচ চালিয়েছি। পেশাগত জীবনের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, মানুষের কাছে আপনি যত ছোট হবেন উপরে উঠার রাস্তাটা আপনার জন্য ততই প্রসারিত হবে।

উপরে উঠার মন্ত্রটা কার কাছ থেকে শেখা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ২০০২সালে বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক ছিলেন পিউস কস্তা স্যার। আমি তার অধীনস্ত সহকারী কমিশনার। মূলত স্যারের কাছেই মানুষের সাথে মেশার মন্ত্রটা শিখেছিলাম। অসম্ভব অমায়িক মানুষ ছিলেন পিউস কস্তা স্যার। বিভিন্ন কাজে সাথে রাখতেন আমাকে। বলতেন, মানুষের সাথে না মিশলে মানুষ চেনা কঠিন। মানুষের সাথে মেশো, মানুষই তোমাকে মানুষ চিনিয়ে দেবে।

মানুষের সাথে মিশে মানুষ চেনা ও ভালোবাসার অনন্য উদাহরণ দিয়েছিলেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন। ২০১৫ সালে ইদুল ফিতরের রাতে প্রচ- বর্ষণে নগরীর মতিঝর্না এলাকায় নিহত হন এক মা ও মেয়ে। একই রাতে হতাহতের ঘটনা ঘটে নগরীর আমিন জুট মিল এলাকায়ও। ইলিয়াস হোসেন বলেন, তখন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন মেজবাহ উদ্দিন। স্যারের অনুমতি নিয়ে রাতেই মতিঝর্না ও আমিন জুট মিল এলাকায় ছুটে যাই। সারারাত বৃষ্টিতে ভিজে অসহায় মানুষগুলোকে নিরাপদে অন্য জায়গায় সরিয়ে নিই। সেদিন যদি সময় মতো ওখানে না যেতাম তা হলে হতাহতের ঘটনা হয়তো অনেক বেশি হতো। তিনি বলেন, পাহড়ের পাদদেশে বাস করা মানুষগুলোর জীবনের মূল্য যে কত কম সেদিন প্রথম বোঝলাম।

শুধু পাহাড়ে নয় তিনি ছুটে বেড়ান জেলার গ্রাম থেকে গ্রামে। থানা থেকে থানায়। প্রাত্যহিক কাজের রুটিনের বাইরে গিয়ে আমলা থেকে প্রায়শই তিনি হয়ে ওঠেন এক অতি সাধারণ মানুষ। ছুটে যান অসহায় মানুষগুলোর পাশে-সাহায্যের হাত বাড়াতে। সস্প্রতি ঘটে যাওয়া তেমনই একটি ঘটনায় ত্রাণকর্তা হয়ে ছুটে গেলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। গত মার্চ মাসে হাটহাজারী উপজেলায় একটি ধর্ষণের ঘটনায় মুমুর্ষ অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় এক কিশোরীকে। ঘটনার একদিন পর তিনি বিশেষ কাজে যান আনোয়ারা উপজেলায়। সেখানেই সংবাদ মাধ্যমে খবর পান ধর্ষিতা কিশোরী মরণাপন্ন। বুকের ভেতরটায় ঘূর্ণি পাকিয়ে ওঠে তাঁর। চোখের কোণে ভেসে ওঠে ছোট দুই বোনের ছবি। নির্ধারিত কাজ ফেলে দ্রুত ফিরে আসেন শহরে। যান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পরিচালকের সাথে আলাপ করে দ্রুত আইসিইউতে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করেন মেয়েটিকে। ওষুধসহ প্রয়োজনীয় খরচের জন্য ব্যক্তিগত ফান্ড থেকে কিছু অর্থ তুলে দেন মেয়েটির বাবার হাতে। শুধু তাই নয়, একই দিন চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপারের সাথে কথা বলে আসামি গ্রেফতারসহ ১৬৪ ধরায় জবানবন্দি রেকর্ড করার ব্যবস্থাও করেন তিনি।

সরকারি নথিপত্রের দায়-দায়িত্বের বাইরে গিয়ে মানুষের প্রয়োজনে মানুষের জন্য ছুটে চলা যার নেশা তার ঘরেও রয়েছে ফুটফুটে দুটি কন্যা শিশু। বড় মেয়ের নাম মাইমুনা জাফিরাহ নাশিহা (৭)। আর ছোট মেয়ে আজমাইন আফরা নাজিবা (৪)। সহধর্মিণী বেবী ফারহানা নাহার উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। যিনি সার্বক্ষণিক পাশে থেকে এ মহৎ কাজগুলোর জন্য অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছেন। চট্টগ্রামের প্রতি, চট্টগ্রামের মানুষের প্রতি অন্যরকম অনুগত মানবিক এই মানুষটি। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম হচ্ছে দেশের ইকোনমিক লাইফ লাইন। সেজন্য চট্টগ্রামকে নিয়ে একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা দরকার। চট্টগ্রাম শহরকে আরও সম্প্রসারণের প্রয়োজন জানিয়ে তিনি বলেন, পার্শ্ববর্তী আনোয়ারা ও কর্ণফুলী থানা হতে পারে চট্টগ্রামের মডেল সিটি। কর্ণফুলী নদীতে ট্যানেল নির্মাণের ফলে নদীর এপাশ-ওপাশে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। সে পরির্বতনকে কাজে লাগিয়ে আনোয়ারা উপজেলাকে পরিকল্পিত নগরায়ন করলে অর্থনৈতিকভাবে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে চট্টগ্রাম।

প্রশাসনিক কাজে ব্যস্ত এই মানুষটি কিছুটা সময় পেলেই ছুটে যান মান্না দে’র কাছে। ‘কফি হাউজের আড্ডা’তে হারিয়ে যান বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটানো সময়গুলোতে। সময় পেলেই রবীন্দ্র, সমরেশ, বুদ্ধদেব আর হুমায়ূন আহমেদ উলটে-পালটে দেখেন। পড়েন। চেষ্টা করেন চট্টগ্রামের ইতিহাস জানারও।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ