শুক্রবার, মে ১৭, ২০২৪
প্রচ্ছদঅর্থ ও বানিজ্য সময়মহাদুর্নীতির ফাঁদে আটকে বড় ধরনের ঝুঁকিতে জনতা ব্যাংক

মহাদুর্নীতির ফাঁদে আটকে বড় ধরনের ঝুঁকিতে জনতা ব্যাংক

বড় ঝুঁকিতে পড়েছে সরকারি খাতের জনতা ব্যাংক। ঋণ জালিয়াতি, ঋণ আদায়ে অব্যাহত ব্যর্থতা, ভুয়া রফতানির বিপরীতে সরকারি অর্থ ছাড় ব্যাংকটিকে মহাদুর্নীতির ফাঁদে আটকে ফেলেছে। উপরন্তু বিপুল অঙ্কের খেলাপি ঋণ কিনে খেলাপিকে ফের লম্বা কিস্তিতে ঋণ দেয়ার মতো নজিরবিহীন ঘটনাও ঘটেছে। এভাবে সীমাহীন অনিয়ম, দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে ব্যাংকটিকে একেবারে খাদের কিনারে নিয়ে গেছে প্রভাবশালী একটি চক্র। যারা এ ব্যাংকের বড় সুবিধাভোগী। এ তালিকায় ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ছাড়াও শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা জড়িত। যাদের সব ধরনের সহায়তা দিয়েছে পর্দার আড়ালে থাকা রাজনৈতিক বড় শক্তির আধার। ফলে এক বছরের ব্যবধানে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ৩ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া এই দুর্বিপাকে পড়ে ব্যাংকটি নতুন করে মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে, যা নিকট অতীতে ছিল না। তা সত্ত্বেও ব্যাংকটিকে পুঁজি করে প্রভাশালীরা তাদের ব্যক্তিগত আখের গোছাতে এখনও মরিয়া।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে জনতা ব্যাংক ডুবতে আর বেশি দেরি হবে না। তারা মনে করেন, কোনো জবাবদিহিতা না থাকায় অপরাধীরা বারবার পার পেয়ে গেছে। মূলত শাস্তি না হওয়ায় জনতা ব্যাংকসহ পুরো ব্যাংকিং সেক্টরে আজ অরাজকতা বিরাজ করছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ রোববার যুগান্তরকে বলেন, এর মধ্যে নিশ্চয় বড় বড় প্রভাবশালী লোকজন জড়িত। তবে আমি মনে করি, যারা এ কাজে সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা করেছে, তাদের সবাইকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককে দিয়ে এটি হবে না। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক ভয় পায়, অথর্ব হয়ে গেছে, কোনো কাজ করতে পারে না। বাংলাদেশ ব্যাংক একটি ভীতু প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তাই তার মতে, এটি ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে হস্তান্তর করা দরকার।

সূত্র জানায়, জনতা ব্যাংকের ঋণ বিতরণ, ঋণ আদায়, গ্রাহকের ঋণসীমা অব্যাহত গতিতে বেড়ে যাওয়া, মন্দঋণ কেনা, পুনর্গঠন করা ঋণ ও বড় অঙ্কের ঋণ নতুন করে খেলাপি হয়ে যাওয়ার প্রবণতা, ব্যাংকের মূলধন পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক সতর্কীকরণ প্রতিবেদন দিয়েছে। এতে বলা হয়, জনতা ব্যাংক বড় অঙ্কের একক ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে ঋণ আদায় বাড়াতে না পারলে বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়বে। ব্যাংকের ঋণ আদায় ও বিতরণ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ঋণ বিতরণের তুলনায় আদায় কম হওয়ায় ব্যাংকটি বড় ধরনের ঝুঁকিতে রয়েছে।

ঋণ আদায় না বাড়লে এ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ভয়ানকভাবে বেড়ে যাবে। ফলে তখন প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণও বাড়বে। কিন্তু বিপুল অঙ্কের প্রভিশন ঘাটতি পূরণের মতো পর্যাপ্ত মূলধন তাদের রিজার্ভে নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, জনতা ব্যাংকের খেলাপি, মূলধন ও প্রভিশন ঘাটতিতে ব্যাপক অবনতি ঘটেছে। বিশেষ করে গত এক বছরে ব্যাংকটির শুধু খেলাপি ঋণই বেড়েছে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। এছাড়া আগে কোনো ধরনের ঘাটতি না থাকলেও বর্তমানে মূলধন ঘাটতির পরিসংখ্যানও উদ্বেগজনক। অথচ সরকারি এই ব্যাংকটির আগে খেলাপি ঋণ কম ছিল। মূলধনও উদ্বৃত্ত ছিল।

খেলাপি সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত জনতা ব্যাংক ঋণ বিতরণ করেছে ৪৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ৯ হাজার ৭০২ কোটি ৪১ লাখ টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ২২ দশমিক ৩৪ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে ব্যাংকটি ঋণ বিতরণের পরিমাণ ছিল ৩৬ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ছিল ৬ হাজার ৫০৯ কোটি ৬৭ লাখ টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ১৭ দশমিক ৮১ শতাংশ। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ হাজার ১৯২ কোটি ৭৪ লাখ টাকা।

মূলধন সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি বছরের মার্চ শেষে জনতা ব্যাংক ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে। ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়ে যাওয়ায় বেহাল এ অবস্থা দেখা দিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুছ ছালাম আজাদ যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংকের আর্থিক খাতের সূচকগুলোর সার্বিক অবস্থা এখন খারাপের দিকে আছে। গত মার্চ পর্যন্ত একটু খারাপ অবস্থা ছিল। তবে আগামী জুন প্রান্তিকে অবস্থার উন্নতি হবে বলে তিনি আশাবাদী।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বিধি অনুযায়ী, কোনো ব্যাংক তাদের মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি কোনো একক গ্রাহককে ঋণ দিতে পারে না। জনতা ব্যাংক কয়েকটি ছোট শিল্প গ্রুপকে এই সীমার অতিরিক্ত ঋণ দিয়েছে। এর মধ্যে এনন টেক্সকে দিয়েছে ৫৬ শতাংশ, ক্রিসেন্ট গ্রুপকে দিয়েছে ৫৫ শতাংশ, রতনপুর গ্রুপকে ২৭ শতাংশ, এমআর গ্রুপকে ২৯ শতাংশ, থার্মেক্স গ্রুপকে ৩২ শতাংশ ঋণ দিয়েছে। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য একমুখী।

এসব গ্রুপ এত বেশি পরিমাণে ঋণ পেতে পারে না। তারপরও বিশেষ বিবেচনায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনাপত্তিপত্র এনে এসব ঋণ দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে অনাপত্তিপত্র নেয়ার সময় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে শর্ত দেয়া হয়েছে ঋণ দেয়ার আগে যাতে গ্রাহকের সক্ষমতা ও ব্যাংকের ঝুঁকির বিয়য়টি বিবেচনায় নেয়া হয়।

কিন্তু ব্যাংক এ ঝুঁকির মাত্রা বিবেচনায় না নিয়েই গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী ঋণ বিতরণ করেছে। ফলে ওইসব ঋণ এখন খেলাপি হয়ে গেছে। ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ৪৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণেই ঘটেছে বড় ধরনের জালিয়াতি। এ কারণে ব্যাংকটির আর্থিক ভিত্তি দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়েছে।

এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, এভাবে অবনতি ঘটতে থাকলে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদকে ভেঙে ঢেলে সাজাতে হবে। এছাড়া রাজনৈতিক বিবেচনায় কোনো ঋণ দেয়া হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে। তবে সবকিছুর আগে রাজনৈতিক প্রতিশ্র“তি থাকতে হবে। তা না হলে এটি করা সম্ভব হবে না।

সূত্র জানায়, জনতা ব্যাংক থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে দেশের ছোট ছোট কয়েকটি শিল্প গ্রুপকে বড় অঙ্কের ঋণ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ পেয়েছে ক্রিসেন্ট গ্রুপ। এই একটি ব্যাংকেই তাদের ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ১২৮ কোটি টাকা। ভুয়া রফতানির বিপরীতে নগদ সহায়তা বাবদ সরকারি খাতের ১ হাজার ৭৫ কোটি টাকা নিয়েছে জনতা ব্যাংক থেকে।

ব্যাংকের ইমামগঞ্জ ও মোহাম্মদপুর কর্পোরেট শাখা থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে এসব ঋণ দেয়া হয়েছে। এ ঘটনার সঙ্গে দুই শাখার কতিপয় কর্মকর্তাও জড়িত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে এ ঘটনা প্রমাণিত হওয়ায় দুটি শাখারই বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবসার লাইসেন্স স্থগিত করেছে। একই সঙ্গে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়েছে। এর জবাব শাখাটি থেকে দেয়া হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের বক্তব্য গ্রহণ করেনি। ফলে এখনও বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবসার লাইন্সেসের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হয়নি।

এদিকে গুরুত্বপূর্ণ ওই দুটি শাখার বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবসার লাইসেন্স স্থগিত হয়ে পড়ায় শাখা দুটি আমদানির জন্য কোনো এলসি ও রফতানির জন্য কোনো এলসির এডভাইস করতে পারছে না। এ ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবসা সংক্রান্ত কোনো কাজও করতে পারছে না। শাখা দুটির মোট ব্যবসার প্রায় অর্ধেকই আসে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবসা থেকে। ফলে শাখা দুটির আয় কমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে জনতা ব্যাংকের এমডি আবদুছ ছালাম আজাদ বলেন, ক্রিসেন্ট গ্রুপ নিয়ে বিপদে আছি। এই বিপদ দ্রুতই কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। মোহাম্মদপুর ও ইমামগঞ্জ শাখার বৈদেশিক লেনদেনের লাইসেন্স বাংলাদেশ ব্যাংক সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে। অবস্থার উন্নতি হলে আবার তা প্রত্যাহার করবে বলে আশা করি। এনন টেক্স গ্রুপের নামে জনতা ব্যাংকের ঋণ রয়েছে ৫ হাজার ৫১০ কোটি টাকা। এ ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংক প্রচলিত নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেনি। ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের হাতে পর্যাপ্ত জামানতও নেই। রতনপুর গ্রুপের নামে রয়েছে ৭০০ কোটি টাকার ঋণ। এসব ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের হাতে পর্যাপ্ত জামানত নেই।

এমআর গ্রুপের রয়েছে ৬৫০ কোটি টাকা। এসএ গ্রুপের রয়েছে ২৩০ কোটি টাকা। থার্মেক্স গ্রুপের রয়েছে ৮৭০ কোটি টাকা। এসব ঋণও ব্যাংকের জন্য ঝুঁকি তৈরি করেছে। ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে নানা ধরনের অনিয়ম হয়েছে। এর আগে বিসমিল্লাহ গ্রুপকে ব্যাংকের তিনটি শাখা থেকে ৫৫০ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। ওই ঋণ নিয়ে গ্রাহক বিদেশে পালিয়ে গেছেন। ঋণের টাকা পাচার করে দেয়া হয়েছে। এর বাইরে প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার মন্দ ঋণ কিনেছে জনতা ব্যাংক।

এসব ঋণ নগদ টাকায় কিনে সেগুলোর মেয়াদ বাড়িয়ে আবার নতুন করে তাদের নামে ঋণ দিয়েছে। এ ঘটনার পর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একটি সার্কুলার দিয়ে বলা হয়েছে, কোনো ব্যাংক এখন থেকে অন্য কোনো ব্যাংকের খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত কোনো ঋণ কিনতে পারবে না। – যুগান্তর

আরও পড়ুন

সর্বশেষ