মঙ্গলবার, মে ১৪, ২০২৪
প্রচ্ছদচট্রগ্রাম প্রতিদিনসৌন্দর্যের নগরী চট্টগ্রাম শহর এখন হতশ্রী

সৌন্দর্যের নগরী চট্টগ্রাম শহর এখন হতশ্রী

সৌন্দর্যের নগরী চট্টগ্রাম শহর এখন হতশ্রী। অল্প বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় নগরীর পথঘাট। জোয়ারের পানিতেও ডুবে যায় নিম্নাঞ্চল। সিটি করপোরেশনের হিসেবে, চট্টগ্রাম নগরীর ২০ শতাংশ সড়ক চলাচলের প্রায় অনুপযোগী অবস্থায় আছে। আর ট্রাফিক পুলিশের মতে, অর্ধেকের কাছাকাছি সড়কে এখন যানবাহন চলাচল দায় হয়ে পড়েছে। তাই ৬০ লাখ মানুষের এই শহরে নিত্য যন্ত্রণা নিয়ে পথ চলতে হয় নগরবাসীকে। দুর্ভোগ এখন চট্টগ্রামের মানুষের নিত্যসঙ্গী। স্থানীয়দের অভিযোগ আছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), সিটি করপোরেশন আর ওয়াসার খোঁড়াখুঁড়ি ও তাদের মধ্যে সমন্বয় না থাকায় জনদুর্ভোগ বাড়ছে। নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বলেন, উন্নয়নের জন্য খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। এতে মানুষের দুর্ভোগ হচ্ছে। যেসব সরকারি সংস্থা উন্নয়ন কাজ করছে তাদের মধ্যে কোন ধরনের সমন্বয় নেই। সিটি করপোরেশন রাস্তা মেরামত করে আসার পর ওয়াসা গিয়ে খুঁড়ে দিচ্ছে। সিডিএ যেখানে ফ্লাইওভার বানাচ্ছে তার নিচের সড়ক ভাঙাচোরা অবস্থায় মাসের পর মাস পড়ে থাকছে। আর জলাবদ্ধতা এটা যেন নিয়তি হয়ে গেছে।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ওয়াসা-সিডিএ’র উন্নয়ন কাজ চলছে। আমাদেরও কিছু কাজ চলছে। এসব কারণে অনেক রাস্তাঘাট সাময়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় আছে। এবার বর্ষা শুরুর আগ থেকেই চট্টগ্রামে প্রচুর বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এতে রাস্তার বিটুমিন উঠে গিয়ে বড় বড় গর্ত তৈরি হচ্ছে।

চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) কুসুম দেওয়ান বলেন, নগরীর প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি সড়কে যানবাহন চলাচল কিংবা যানজট নিয়ন্ত্রণ দুরূহ হয়ে পড়েছে। সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে কোন সমন্বয় নেই। যে যেভাবে পারছে সড়কের উপর কাজ করছে। পুরো শহরের ট্রাফিক সিস্টেমই আর কার্যকর থাকছে না।

চট্টগ্রাম নগরীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি সড়কের মধ্যে আছে আগ্রাবাদ এক্সেস রোড এবং পোর্ট কানেকটিং সড়ক। জাইকা’র অর্থায়নে সড়ক দুটি চার লেইন করার কাজ করছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। সরেজমিনে এক্সেস রোডে গিয়ে দেখা গেছে, সড়কের দুই পাশে ড্রেনের কাজ চলছে। একপাশের সড়ক উঁচু, আরেকপাশ নিচু। উঁচু সড়কে ঢালাই নেই। গর্ত, খানাখন্দকে ভরা। আর নিচু সড়কে পানি জমে খালের আকৃতি ধারণ করেছে। সড়কে গাড়ি চলছে মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে। পোর্ট কানেকটিং সড়কের নিমতলা থেকে অলঙ্কার মোড় পর্যন্ত এলাকায় পুরো সড়কজুড়ে বড় বড় খানাখন্দ। পানি, কাদামাটিতে একাকার। সেই সড়কেও যানবাহন চলতে বেগ পেতে হচ্ছে।

পুলিশ কর্মকর্তা কুসুম দেওয়ান বলেন, পোর্ট কানেকটিং রোড এবং আগ্রাবাদ এক্সেস রোডে যানবাহন চালানো কোনোমতেই সম্ভব নয়। যারা গাড়ি নিয়ে যাচ্ছে তারা নিতান্ত নিরুপায় হয়ে সেই সড়ক পাড়ি দিচ্ছেন। এই সড়কগুলো পাড়ি দিয়ে নিজের এলাকায় যেতে গিয়ে সবচেয়ে দুর্ভোগ পোহাড়ে হচ্ছে নগরীর হালিশহর, আগ্রাবাদ বেপারি পাড়াসহ বিশাল এলাকার বাসিন্দাদের। হালিশহরের বাসিন্দা আইনজীবী টি আর খান বলেন, ‘নিমতলা থেকে অলঙ্কার মোড় পর্যন্ত পুরো সড়ক অকেজো করে ফেলা হয়েছে। গত ৬-৭ মাস ধরে এই দুর্ভোগ চলছে। কাজ এমন ধীরগতিতে হচ্ছে মনে হচ্ছে ৬ বছরেও শেষ হবে না। রাস্তার এমন করুণ হাল বোধহয় দেশের আর কোথাও নেই।

হালিশহরের বাসিন্দা সাংবাদিক তুষার হায়াত বলেন, সন্ধ্যার পর কোন গাড়ি শহরের মূল অংশ থেকে হালিশহরের দিকে যেতে চায় না। কাউকে যদি রাজি করানো যায়, দ্বিগুণ-তিনগুণ ভাড়া দিয়ে যেতে হয়। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ২০১৯ সালের মে মাসে সড়ক দুটির কাজ শেষ হওয়ার সময় নির্ধারিত আছে। তবে আমরা চেষ্টা করছি যাতে এই বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করতে পারি।

এলাকার বাসিন্দা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অসহযোগিতার কারণে সড়কগুলো ঠিক রাখা যাচ্ছে না বলেও অভিযোগ করেছেন এই কর্মকর্তা। চট্টগ্রাম নগরীতে ৬৫০ কিলোমিটার পানি সরবরাহ লাইন স্থাপন করছে ওয়াসা। এছাড়া মদুনাঘাট পানি শোধনাগারের সঙ্গে নগরীর সংযোগ ঘটাতে গিয়ে আরকান সড়কের প্রায় ১০ কিলোমিটারেরও বেশি এলাকায় গত দেড় বছর ধরে খোঁড়াখুঁড়ি করছে ওয়াসা। আরাকান সড়কেও একপাশ গত দেড় বছর ধরে বন্ধ আছে। চট্টগ্রাম নগরীর মোহরা, হাটহাজারীর কুয়াইশ, চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কে চলাচলকারী যানবাহনগুলোকে ব্যাপক দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে আরকান সড়কের এই উন্নয়ন কাজের জন্য। বোয়ালখালী-পটিয়া উপজেলার লোকজনকেও এই দুর্ভোগ এড়িয়েই যেতে হচ্ছে নিজের এলাকায়।

পুলিশ কর্মকর্তা কুসুম দেওয়ান বলেন, আরকান সড়কে বহদ্দারহাট থেকে কাপ্তাই রাস্তার মাথা পর্যন্ত এলাকায় ঘন্টার পর ঘন্টা যানজট থাকছে। কোনভাবেই আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। সড়কের একপাশ যদি বছরের পর বছর বন্ধ থাকে তাহলে এত গাড়ি সামাল দেব কীভাবে?

ওয়াসার এই উন্নয়ন কাজে আরও বড় ভোগান্তি সৃষ্টি হয়েছে চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন নতুন-পুরনো আবাসিক এলাকা, পাড়া-মহল্লায়। অধিকাংশ অলিগলিতে সড়ক খুঁড়ে পাইপলাইন স্থাপন করা হচ্ছে। এতে রাস্তায় বড় বড় খানাখন্দ সৃষ্টি হচ্ছে। নগরীর আসকার দিঘীর পাড় ঘিরে অন্তত চারটি সড়কেরও একই দশা। বর্ষা শুরুর পর গত সপ্তাহে রাস্তাগুলোতে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করেছে ওয়াসা।

আসকার দিঘীর পাড়ের বাসিন্দা ক্রীড়া সংগঠক মো. সোহাগ বলেন, বড় বড় গাড়ি এনে হঠাৎ করে রাস্তা খুঁড়ে ফেলা হচ্ছে। আগে থেকে কোনো ঘোষণাও দেওয়া হচ্ছে না। এখন আসকার দিঘীর পাড় দিয়ে বড় কোন গাড়িই ঢুকতে পারছে না। আর বৃষ্টির কারণে রাস্তা কর্দমাক্ত হয়ে যাচ্ছে। ওয়াসার দায়িত্বহীনতা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। এসব বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. ফজলুল্লাহর মোবাইলে বেশ কয়েকবার ফোন করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি।

তবে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী মহিউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘বর্ষায় অলিগলিতে খোঁড়াখুঁড়ির কারণে আমাদেরও সমস্যা হয়। কারণ বৃষ্টির মধ্যে রাস্তা মেরামত করা সম্ভব হয় না। দীর্ঘদিন সড়ক সংস্কারবিহীন অবস্থায় পড়ে থাকলে মানুষ সিটি করপোরেশনকে দোষারোপ করে।’ ওয়াসা নির্ধারিত সময়ে তাদের কাজ শেষ করে সড়ক সংস্কারের জন্য সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করে না বলেও অভিযোগ এই কর্মকর্তার।

চট্টগ্রাম নগরীর মুরাদপুর থেকে লালখানবাজার, ষোলশহর এলাকায় ফ্লাইওভারের কাজ করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। এজন্য আশপাশের প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকায় সড়ক যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এসব এলাকায়ও শুরু হয়েছে জনদুর্ভোগ।

নগরীর বাকলিয়া থেকে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত ছয় লেইনের সংযোগ সড়কের কাজ করছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। সেখানকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, সড়কটি গত দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে যানবাহন চলাচলের প্রায় অনুপযোগী হয়ে পড়ে আছে। গর্ত, খানাখন্দকে ভরা সড়কটিতে ঝুঁকি নিয়ে চলছে গাড়ি।

অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) কুসুম দেওয়ান বলেন, আগ্রাবাদ এক্সেস রোড, পোর্ট কানেকটিং রোড, আরকান সড়ক, শাহ আমানত সেতু সংযোগ সড়ক, বিমানবন্দর সড়ক-এই সড়কগুলো স্বাভাবিকভাবে গাড়ি চালানো যাচ্ছে না। এর প্রভাব পড়ছে শহরের অন্যান্য অংশেও। উন্নয়নের জন্য এই দুর্ভোগের পর জলাবদ্ধতাও আছে। এখন সামান্য বৃষ্টি হলেই নগরীর শুলকবহর, বাকলিয়া, বাদুরতলা, বহদ্দারহাট, আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, মুরাদপুর, ষোলশহর, চকবাজারসহ বিভিন্ন নিচু এলাকায় পানি জমে যায়। আর বৃষ্টি এবং জোয়ারের পানি একসঙ্গে থাকলে রীতিমতো বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় চট্টগ্রাম নগরীতে। নগরীর বকশিরহাট ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর জামাল হোসেন বলেন, বৃষ্টি-জোয়ারের পানির কারণে এখন আমাদের চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে ভোগ্যপণ্যের আড়তেও পানি ঢুকে যাচ্ছে। কোটি কোটি টাকার ভোগ্যপণ্য নষ্ট হচ্ছে। সিডিএ জলাবদ্ধতা নিরসনে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্পের কাজ শুরু করেছে। কিন্তু পরিকল্পিতভাবে না করলে, খাল উদ্ধার করতে না পারলে এর কোন সুফল পাওয়া যাবে না।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ