শুক্রবার, মে ৩, ২০২৪
প্রচ্ছদটপরাজনীতিতে ভদ্র ও শালীন রাজনীতিবিদ ফখরুলরা অচল!

রাজনীতিতে ভদ্র ও শালীন রাজনীতিবিদ ফখরুলরা অচল!

করতেন শিক্ষকতা। সেটা ছেড়ে আসলেন রাজনীতিতে। শুরুতে মাঠের বক্তৃতা করতেও অতি ভদ্র ও শালীন ভাষা ব্যাবহার করতেন বলে নিজ দলের অনেকেই তাকে নিয়ে আড়ালে হাসাহাসি করত। এখনো রাজনীতিতে প্রচলিত অনেক উগ্র ভাষা আয়ত্ত করতে পারেননি। ধীরে ধীরে কলেজের সেই শিক্ষক মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর হয়ে উঠলেন পুলিশের রেকর্ডে এক ‘ভয়ংকর’ রাজনীতিবিদ; রাজপথের মাস্তান।

বিশ্বাস করুন বা না করুন পুলিশের রেকর্ড অনুযায়ী ফখরুল রাস্তায় লাঠি হাতে মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছেন, পুলিশের কর্তব্য পালনে বাধা দিয়েছেন। লোহার রড, লাথি, ইট, পাথর, হকি স্টিক নিয়ে দলবলে সজ্জিত হয়ে হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণ চালিয়েছেন পুলিশের উপর। কখনো রাস্তায় ভাংচুর করেছেন জনসাধারণের যানবাহন। ভাঙচুর থেকে রেহাই পায়নি সিটি করপোরেশনের আবর্জনাবাহী ট্রাকও। ময়লার গাড়ির ড্রাইভারকেও মারধর করেছেন, হত্যার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছেন।শুধু তাই নয়, দলের অন্য সিনিয়র নেতাদের সাথে ষড়যন্ত্র করে তাদের সাথে গিয়ে রাতের অন্ধকারে বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়ার অপরাধে অভিযুক্ত হয়েছেন মীর্জা ফখরুল। পুলিশের খাতায় এমন আরও কত যে অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন গত কয়েক বছরে সেসবের বিস্তারিত তিনি হয়ত নিজেই জানেন না। কমপক্ষে ৮৩ টি মামলার আসামি হয়েছেন। হুলিয়া মাথায় ঘুরেছেন। কয়েক দফা জেলে যেতে হয়েছে। অনেক ধকল সয়ে জামিন মিলেছে। এখনো যাপন করছেন জামিনে থাকা জীবন, মুক্ত জীবন নয়।

ফখরুলের সৌভাগ্য নাকি দুর্ভাগ্য সেটা সময়ই বলবে। তবে মামলার রেকর্ড খতিয়ে দেখা যায় অন্য অনেকের চেয়ে তিনি আলাদা। রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ মামুলি ব্যাপার। সত্য মিথ্যা যাই হোক না কেন দুর্নীতির মামলা হয়নি এমন সিনিয়র রাজনীতিবিদ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তার দলের নেত্রী অথবা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী–তাদের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির মামলা হয়েছে। তবে ফখরুল তাদের কাতারে নাম লেখাতে পারেননি। তার বিরুদ্ধে একটাও দুর্নীতির মামলা হয়নি। সবগুলো মামলাই হয়েছে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করাকে কেন্দ্র করে রাজপথের অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলায় জড়িত থাকার অভিযোগে। তার মামলার রেকর্ড পড়লে যে কারো মনে হতে পারে, ফখরুল রাজপথে অরাজকতা সৃষ্টিতে দক্ষ; মারামারি হানাহানিতে ভীত নন মোটেও।

কিন্তু রাঙ্গুনিয়াতে গাড়িবহরে হামলার শিকার যে ফখরুলের চেহারা পত্রিকার পাতায় আর টেলিভিশনের পর্দায় দেখা গেছে তার সাথে পুলিশের মামলার রেকর্ডের ফখরুলকে মেলানো যায় না। হামলার পরপর এক অসহায় ফখরুলকে দেখা গেছে। তার গাড়িতে আক্রমণের সময়েও তিনি হামলাকারীদেরকে জিজ্ঞেস করেছেন, কেন তারা এমন করছে? যখন হামলাকারীরা প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আক্রমণের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় ফখরুল তখন গাড়ির গ্লাস লাগিয়ে ভিতরে ভয়ে জবুথুবু হয়ে থেকেছেন। হামলার পর মুহূর্তে ফোনে যারা কথা বলেছেন তারা ফখরুলের আতঙ্ক ভরা কণ্ঠ শুনেছেন। ৬৫ বছর বয়স্ক ফখরুল কখনো এমন দিন দেখেননি বলে নিজেই বলেছেন। দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করা ফখরুল হামলাকারী যুবকদেরকে কি তার ছাত্রের মত ভেবে ভুল করেছিলেন? ওরা কোনওদিন কি কারো ছাত্র হয়ে শিক্ষা নিয়েছে?
১৯৯১ সালে গণতন্ত্রের পুনর্যাত্রা শুরু হওয়ার পর গত প্রায় তিন দশকের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে অন্য কোনও দলের মহাসচিবকে ফখরুলের মত এতোটা নিগৃহীত হতে হয়নি। বিএনপির রাজনীতির সমর্থক নন এমন অনেকে আছেন যারা ফখরুলের ভদ্রতা ও শালীনতা বোধের প্রশংসা করেন। যারা সংঘাত-সহিংসতা মুক্ত রাজনীতি চান ফখরুল তাদের একজন। তার উপর এমন হামলা যে কাউকে রাজনীতির আগামী দিনগুলো নিয়ে উদ্বিগ্ন করবে। খোদ সরকারি দলের অনেক নেতাও এই হামলার নিন্দা জানিয়েছেন; দুঃখ প্রকাশ করেছেন।

কেউ কেউ ফখরুলের উপর হামলাকে সুস্থ রাজনীতির প্রত্যাশার উপর হামলা বলেও অভিহিত করেছেন। কেননা যখন তার উপর হামলা হয় তিনি কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিতে যাচ্ছিলেন না। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে কেউ কেউ এই হামলাকে সুস্থ রাজনীতির অভিশাপ, এবং রাজনীতিতে অশনি সংকেত হিসাবে অভিহিত করেছেন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই এই হামলার নিন্দা না করে বরং বিগত বিএনপি সরকার আমলে রাজপথে আওয়ামী লীগের নেতাদের উপর পুলিশের হামলার প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন; সে সবের কিছু আলোকচিত্রও প্রকাশ করেছেন। আবার কেউ কেউ ২০০৪ সালে শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলার প্রসঙ্গ টেনেছেন। এ সব তুলনা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। বিএনপি সরকার আমলে আওয়ামী লীগ নেতাদের উপর হামলা করেছে পুলিশ বাহিনী। আবার আগস্টের গ্রেনেড হামলা ছিল সরকারি দলের কয়েক জন সিনিয়র নেতা এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সুদূর পরিকল্পনা এবং যোগসাজশে চালানো হামলা; যে হামলার লক্ষ্য ছিলেন শেখ হাসিনা নিজে।
অন্যদিকে, ফখরুলের ওপর হামলায় আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের কোনও সায় ছিল বলে এখনো তেমন কিছু প্রকাশ পায়নি। এ হামলা প্রমাণ করে সরকারি দলের মাঠ পর্যায়ের নেতা কর্মীদের উশৃঙ্খলতা, আইনের প্রতি আনুগত্বহীনতা এবং ক্ষমতার অপব্যবহার। হামলাকারীরা জানত ফখরুলের গাড়িবহরে আক্রমণ করে তারা পার পেয়ে যাবে, পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নিবে না। তাদের ধারণাই ঠিক প্রমাণিত হয়েছে। যেমনটা আরও অনেক ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে।

ক্ষমতার অপব্যবহার করতে করতে মাঠ পর্যায়ে সরকারি দলের অনেক নেতা কর্মীর বেপরোয়া আচরণ বেড়ে গেছে। নিজেদের মধ্যে অন্তঃকোন্দল বাড়ছে। গত আড়াই বছরে আওয়ামী লীগের নিজেদের ভেতর কোন্দলে নিহত হয়েছে ৬০ জন নেতা কর্মী। এমন বেপরোয়া আচরণ সাধারণ মানুষ পছন্দ করে না; যা সরকারি দলের জন্য মঙ্গলজনক নয়।

বিএনপি তার ভুল রাজনীতির খেসারত দিয়েছে এবং দিচ্ছে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে ক্ষমতায় থাকার সময় দলের নেতা কর্মীদের উশৃঙ্খল আচরণ, অনিয়ম দুর্নীতির জবাব পেয়েছে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে। ২০০১ সালের নির্বাচনে দলটি একাই প্রায় ২০০টি আসন লাভ করলেও ২০০৮ সালে এসে দলটির আসন ৩০ এর নিচে নেমে যায়। তাই বিএনপির আমলের কোনও ঘটনাকে টেনে ফখরুলের উপর হামলাকে খাটো করে না দেখাই ভালো।

ফখরুলের উপর হামলার ঘটনায় মামলা হয়েছে। সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্দে ব্যবস্থা নেওয়া হলে একটা বার্তা স্পষ্ট হবে যে, রাজনীতিতে এখনো ভদ্র লোকের জায়গা আছে। আর তা না হলে মনে করতে হবে, ফখরুলদের মতো ভদ্র ও শালীন রাজনীতিবিদ যে দলেই থাকুন না কেন বর্তমান রাজনীতিতে তারা অচল এবং অযোগ্য।

শাখাওয়াত লিটন, ডেইলী স্টার

আরও পড়ুন

সর্বশেষ