বিরূপ আবহাওয়া কারণে চট্টগ্রামের শতবর্ষী জব্বারের বলি খেলা ঘিরে শুরু হওয়া বৈশাখী মেলায় কেনাবেচা নিয়ে ব্যবসায়ীরা শঙ্কায় রয়েছেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মেলায় পণ্যসম্ভার নিয়ে আসা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা প্রত্যাশা অনুযায়ী ক্রেতা না পাওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন। বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী, প্রতি বছর বৈশাখের ১২ তারিখ (২৫ এপ্রিল) ঐতিহ্যবাহী ‘বলি খেলা’ ঘিরে আগে-পরেসহ তিন দিন চট্টগ্রামে বৈশাখী মেলা চলে।
এবার ১০৮তম জব্বারের বলি খেলার আয়োজনের আগের দিন বৃষ্টির কারণে মেলা শুরুই হতে পারেনি। মঙ্গলবার সকালে রোদ উঠার পর বিক্রেতারা পণ্য নিয়ে বসতে শুরু করেছেন।মেলা পুরোদমে শুরু হলেও থেকে থেকে দমকা হাওয়ার সঙ্গে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে স্বাভাবিক কেনাবেচাও হচ্ছে না বলে এসব ব্যবসায়ীরা জানান। বিরূপ আবহাওয়ার কারণে প্রতিবছরের তুলনায় মেলায় মানুষের সমাগমও হয়েছে কম, যার প্রভাব পড়েছে পণ্য বিক্রিতেও। লালদিঘী মাঠের চারপাশ ঘিরে প্রায় দুই বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বসেছে এবারের মেলা। বিভিন্ন জেলার মানুষ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ‘স্বকীয়’ পণ্য নিয়ে হয়েছেন। ষ্টিয়ার কুমারখালীর ছেঁউড়িয়া থেকে একতারা, ডুগডুগি ও প্রেমকুড়িসহ নানা বাদ্যযন্ত্র নিয়ে মেলায় এসেছেন শেখ স্বপন। তার স্টলের সামনে বেশ ভিড় দেখা গেলেও বেশি দাম চাওয়ার অভিযোগ করে ফিরে যাচ্ছিলেন ক্রেতারা।
প্রায় ১২ বছর ধরে এ মেলায় আসা শেখ স্বপন বলেন, “মেলার প্রথম দিন বৃষ্টির কারণে বসতে পারিনি। আজ সকাল থেকে বসলেও কখন যে আবার বৃষ্টি শুরু হয় সেই ভয়ে আছি। গতবারের তুলনায় মেলায় বেচাকেনা কম বলে অনুযোগ করে তিনি বলেন, “আবহাওয়ার কারণে বিক্রি কম হলেও মেলা আরও একদিন চলবে। ঝড়বৃষ্টি না হলে আশা করি ভালোই বিক্রি করতে পারব। ছোটদের খেলনা থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় গৃহস্থালি পণ্যের পসরা নিয়ে মেলায় এসেছেন ব্যবসায়ীরা। সকাল থেকে মেলায় আসা ক্রেতা-দর্শনার্থীর মধ্যে নারীর সংখ্যাই ছিল বেশি। মাছ ধরার চাঁই, বেতের তৈরি চালুনি, তৈজসপত্র, মাটির তৈরি পুতুল, মাটির তৈরি খেলনা, ফুলদানি, তালপাখা, টব, হাঁড়ি-পাতিল, কাঠ-বাঁশ-বেতের তৈরি আসবাবপত্র, হাতপাখা, ঝাড়ু, কুলা, শীতলপাটি, মুড়ি-মুড়কি, নাড়ু, গাছের চারা, দা-বটি এবং বৈশাখি ফলসহ নানান পণ্য মিলছে এ মেলায়।
নগরীর চাঁন্দগাও থেকে মেলায় আসা গৃহিণী নাহিদা খানম জানান, বাড়ির নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিস কিনতে প্রতিবছরই এই মেলায় আসেন। এবার মেলায় চমৎকার কারুকাজ আছে এমন ফুলদানি খুঁজছি। কিন্তু যেগুলো পাচ্ছি সেগুলোর দাম বেশি। আশা করছি নাগালের মধ্যে পেয়ে যাবো। দামদর শেষে দা ও বটি কেনার পর নগরীর পূর্ব নাসিরাবাদের ‘সমাবেশ কমিউনিটি সেন্টারের’ মালিক শফিকুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ঐতিহ্যবাহী জব্বারের বলি খেলায় প্রতিবছর আসাটা যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। আর এখানে আসলে কিছু না কিছু কেনা হয়। প্রতিকূল আবহাওয়ায় কাঙ্খিত পরিমাণে বিক্রি হবে না বলে শঙ্কায় আছেন শরিয়তপুর থেকে ঢোলসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র নিয়ে প্রথমবারের মতো মেলায় আসা কাজী সজল। তিনি বলেন, “বাপ-চাচারা আসত এতদিন। এইবার আমি আসছি। আমাদের ঢোল বানানোর কারখানা আছে। আমার কপাল খারাপ। গতকাল ছিল বৃষ্টি। আজকে সকাল থেকে মাত্র চারটা ঢোল বিক্রি করছি। আকাশে এখনো মেঘ, কপালে কি আছে আল্লাহ জানে। প্রায় দশ বছর ধরে মেলায় আসা কুমিল্লার আবদুল মালেক বলেন, “বিক্রি হবে সে আশায় আছি। আজকের দিনটা ভালো যাবে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যে যদি আবার বৃষ্টি শুরু হয় তাহলে আসা-যাওয়ার খরচও তুলতে পারব না। জব্বারের বলি খেলার ইতিহাস বেশ প্রাচীন। ১৩১৬ বঙ্গাব্দের ১২ বৈশাখ চট্টগ্রামের বদরপতি এলাকার ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর এক কুস্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ আর বাঙালি যুবকদের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলা এবং শক্তিমত্তা প্রদর্শনের মাধ্যমে তাদের মনোবল বাড়ানোর উদ্দেশ্যে আবদুল জব্বার এ বলিখেলার প্রবর্তন করেন। তার মৃত্যুর পরে এ খেলা পরিচিতি পায় জব্বারের বলি খেলা নামে। সেই থেকে প্রতি বছর একই তারিখে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে ঐতিহ্যবাহী এ বলি খেলা।