শুক্রবার, মে ৩, ২০২৪
প্রচ্ছদটপআমাদের সকলের ভালোবাসার হাসু আপা

আমাদের সকলের ভালোবাসার হাসু আপা

শেখ রেহানা:

শেখ হাসিনা আমাদের পরিবারের জ্যেষ্ঠা কন্যা। উনি আমাদের তিন ভাই ও দুই বোনের সবার বড়। আমাদের সকলের ভালোবাসার হাসু আপা। তিনি আমার দশ বছরের বড়। আমি তার কোলেই বড় হয়েছি। আমাদের পারিবারিক বন্ধন ছিল খুবই আনন্দময়। বিশেষ করে আমি আমার মায়ের শাসন, ¯েœহ এবং ভালোবাসার কোনো তুলনা পাই না। বাবা ব্যস্ত থাকতেন রাজনীতি নিয়ে, তার মিটিং আর সাংগঠনিক কাজকর্ম নিয়ে। বেশির ভাগ সময়েই আমি তাকে পেয়েছি রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে। যখন আমরা তাকে জেলখানায় দেখতে যেতাম, তিনি আমাদেরকে ভালোবাসা ও ¯েœহে আলিঙ্গন করতেন। যখন আমি খুব ছোট ছিলাম, তিনি আমাকে তার কোলে বসাতেন। যখন আমি স্কুলের ছাত্র ছিলাম তখন অনেক খবর জানতে পেতাম, আমরা তার সাথে সেগুলো নিয়ে কথা বলতাম। তিনি আমার মাথায় হাত ঘষতে ঘষতে কথা বলতেন। যদি কোনোদিন তাকে দেখতে না যেতাম, তিনি আমাকে চিঠি লিখতেন। বাবার অনুপস্থিতিতে আমার মা আর হাসু আপা ছিলেন আhasina_rehana_মাদের মাথার ওপর ঠিক বিশাল বটবৃক্ষের মতোই সহায়। তারা আমাদের সকল প্রয়োজন আর চাহিদা মেটাতেন। আমার মা আমাদের গল্প শোনাতেন। তিনি আমাদের বড় হবার সঠিক পথগুলো জানাতেন। তিনি যেন ক্ষমা ও ধৈর্যের এক প্রতিমা ছিলেন। আমার বোন হাসু মনে হয় মায়ের সেই গুণগুলো উত্তরাধিকার হিসেবে পেয়েছে।
আমাদের পরিবারে একটি সাংস্কৃতিক পরিবেশ বিরাজ করত। হাসু আপা ছায়ানট থেকে ভায়োলিন বাজানো শিখেছিলেন, কামাল ভাই শিখেছিলেন সেতার, জামাল ভাই গিটার আর আমি গান এবং নাচ। আমরা বাড়িতে সবাই নানান খেলাধুলা করতাম। আমরা সাইকেল চালানোর প্রতিযোগিতা চালাতাম। সবাই বাড়ির বাইরে গিয়ে সাইকেল চালাতাম। তবে হাসু আপাকে ছাদে সাইকেল চালাতে হতো। যখন বাবা-মা দুজনেই বাড়ির বাইরে যেতেন, বোন হাসু আমাদের সকলের অভিভাবক হতেন। আমরা বাড়িতে ঘর সাজাতাম, ডাইস, ছোঁয়াছুঁয়ি, ক্যারাম খেলতাম। তার শাসন মেনে চলতেই হতো। তার শাসন মাঝে মাঝে খুবই কড়া হতো। ঈদ উৎসবে, মা এবং হাসু আপা আমাদের জামা সেলাই করে দিতেন। কখনও কখনও আত্মীয়-স্বজনের জামা-কাপড়ও সেলাই করে দিতেন। কখনও আমি হাসু আপার কাছে নতুন ডিজাইনের ফ্রকের জন্য আবদার করতাম। তার জন্য, আমি তাকে চা আর কফি অফার করতাম। যতক্ষণ সেলাই শেষ না হতো, আমার তাকে সেটা চালিয়ে যেতে হতো। সেলাইও শেষ, আমার সেবাও শেষ। আত্মীয়-স্বজনের পাশাপাশি, দলের নেতাকর্মী আর জনগণের ভিড় আমাদের বাসায় লেগেই থাকত। তবে যখনই কঠিন সময় আসত, চারদিকে শূন্যতা বিরাজ করত। যখন আমাদের বাবা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় কারাগারে নিক্ষিপ্ত হলেন আর তার কোনো খবর কোনো পত্রিকায় আসা বন্ধ ছিল, তখন মা আর হাসু আপাই আমাদের দেখাশোনা করতেন। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের কালরাতে বাবা আমাকে হাসু আপার সাথে বাসায় পাঠালেন। পরবর্তীতে আমি মায়ের সাথে মগবাজারে এক আত্মীয়ের বাসায় থাকি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে আমরা বাবার চিন্তায় দিন কাটাতাম। আমাদেরকে গ্রেফতার করে ধানমন্ডির ১৮ নম্বর রোডের একটি বাড়িতে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। পাকিস্তানি সৈন্যদের ব্যবহার খুবই খারাপ ছিল। আমাদের খাবারের জন্যও কষ্ট করতে হয়েছে। হাসু আপা তার ছেলে জয়ের জন্ম দিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। মাকে একবারের জন্যও তাকে দেখতে যেতে দেওয়া হয়নি। তিনি সারাক্ষণ কাঁদছিলেন। আর্মি অফিসার জিজ্ঞেস করছিল, আপনি কি ডাক্তার? ওখানে আপনারা কী করবেন? মা উত্তর দিয়েছিলেন, আমি মা। কামাল ভাই এবং জামাল ভাই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেন। রাসেল আর আমিই মায়ের সাথে বাড়িতে রইলাম। যখন হাসু আপা তার শিশুপুত্র জয়কে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন, আমাদের খুশি আর বাধ মানে না। আমার স্মৃতিতে আজও ভাস্বর সেই মনোমুগ্ধকর মুহূর্তটি যখন মা জয়কে কোলে নিয়েছিলেন।
১৯৭৫ সালের জুলাইতে যখন কামাল ভাই আর জামাল ভাইয়ের বিয়ে হয়, আমরা প্রচুর আনন্দ করেছিলাম। তখন আমি উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্রী। আগস্টের প্রথম দিকে হাসু আপা তার ছেলেকে নিয়ে আমাদের দুলাভাইয়ের সাথে জার্মানি যাবে। বাবা আর মা আমাকেও তাদের সাথে পাঠালেন। আমি মোটেও যেতে আগ্রহী ছিলাম না। দুটো সন্তান নিয়ে বোন হাসুর অনেক কষ্ট হবে তাই মা আমাকে তাদের সাথে যেতে বললেন। যখন বিদায় নিতে যাব, মা কাঁদছিলেন। আমি প্লেনে চড়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত রাসেল আমার হাতটা ধরেছিল। সেদিন সকলেই এসেছিল। আমি অনেক বিমর্ষ ছিলাম কারণ আমাকে এখানে বাবা আর মা’কে রেখে যেতে হচ্ছে। যা হোক, তারপর আমরা জার্মানি চলে গেলাম সেখানে থাকতে লাগলাম। আমরা পার্শ্ববর্তী দেশের শহরগুলোতেও ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। আমরা ১৩ আগস্টে বাবা-মায়ের সাথে টেলিফোনে কথা বলেছিলাম। আমি বাড়িতে ফিরে আসার জন্য কান্নাকাটি করছিলাম। বাবা বললেন, আমি ওদের বলব যাতে তুমি তাড়াতাড়ি ফিরতে পার।
যখন আমরা ১৫ আগস্টের হৃদয় বিদারক ঘটনার কথা জানতে পাই, আমরা সম্পূর্ণ হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। কীভাবে এমন নিষ্ঠুরতা ঘটল? যদিও আমার বাবা রাজনীতি করতেন, কিন্তু আমার মা, ছোট্ট রাসেল, ভাই-ভাবীরা তো রাজনীতি করতেন না। তা হলে কেনো তাদেরকে হত্যা করা হলো? আমি হাসু আপাকে ধরেছিলাম আর আমরা দুই বোন অনেক সময় ধরে কাঁদছিলাম। একজন আরেকজনকে প্রবোধ দেবার চেষ্টা করেছি। একজন আরেকজনের চোখ মুছে দিয়েছি। আমি হাসু আপাকে ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে পারছিলাম না। তিনি আমার চোখ মুছে দিতেন আর খাইয়ে দিতেন। এমনটা চলছিল অনেকদিন ধরেই! বাবা-মা আর ভাইদের হারাবার পর হাসু আপাই আমার অভিভাবক হয়ে গেলেন, হলেন আমার আশ্রয়। পড়াশোনা শেষ হলো; আমি এক অসহায় এতিমের জীবনে প্রবেশ করলাম। হাসু আপা না থাকলে আমাকে টিকে থাকতে অনেক সংগ্রাম করতে হতো। প্রিয় হাসু আপা আমাকে ভালোবাসা দিয়ে, ¯েœহ দিয়ে একজন বাবার মতো, একজন মায়ের মতো আমাকে এখনও পর্যন্ত দেখে রাখেন।
ছেলেবেলা থেকেই আমি হাসু আপাকে দেখে আসছি আমাদের মাঝে এক অগ্রপথিক হিসেবে। আমাদের পরিবারের ঐক্যবন্ধনটি ছিল গভীর অনুভূতির। মা আর হাসু আপা ছিল আমাদের ঘরের সেরা আকর্ষণ। বাবার রাজনীতি ঝোঁক এবং আদর্শের প্রতি আমাদের ছিল অগাধ বিশ্বাস ও আস্থা। ছাত্রজীবনের স্কুল, কলেজ ও ইউনিভার্সিটিতে হাসু আপা ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন।
১৫ আগস্টের পর তার শক্ত হয়ে দাঁড়াতে বেশ অনেকটাই সময় লাগে। আমি ১৯৭৬ সালে লন্ডনে গেলাম। লন্ডনে ১৯৭৭ সালের জুলাইতে আমার বিয়ের সময় হাসু আপা কেবলই একটি টিকিটের জন্য আসতে পারেন নি। এটা আমার জীবনের একটি বড় দুঃখ। নিজেকে শান্ত করেছিলাম এই ভেবে, হাসু আপাও তার বিয়েতে বাবাকে পাননি। তাই মা অনেক ইচ্ছা করেছিলেন যে আমার বিয়েটা অনেক জাঁকজমকপূর্ণ হবে এবং অনেক আনন্দময় একটা অনুষ্ঠান হবে। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, তাদের দুজনের কেউই উপস্থিত থাকতে পারেন নি। আমার তিন সন্তানের জন্মের সময়, হাসু আপা আমার সাথে থেকে মায়ের শূন্যতা পূরণ করেছিলেন। যখন আমার স্বামী প্রবল অসুস্থ হয়ে সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে ভর্তি হন সেই ১৯৯১ সালে, আমার হাসু আপা দলের সব কাজ ফেলে আমার কাছে ছুটে গিয়েছিলেন। তিনি (আপা), তার (আমার স্বামী) সব দেখভাল করেন এবং দ্রুত সুস্থ করে তোলেন। তিনি আমার এবং আমার সন্তানদের পাশে একজন মায়ের মতো পাশে দাঁড়ান এবং আমাদের উৎসাহ দেন।
১৯৮০ সালে হাসু আপা লন্ডনে এলেন। সেখানে তিনি পঁচাত্তরের নৃশংস হত্যাকা-ের বিচারের দাবি তোলেন এবং স্টেজে বক্তৃতা দেন। ১৯৮১ সালে দিল্লিতে, সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় হাসু আপা রাজনীতিতে প্রবেশ করবেন, তখন আমি তাকে উৎসাহ দেই এবং জয় আর পুতুলের দায়িত্ব নেই আর তাকে বলি, ‘দেশ ও জাতির ভালোর জন্য আপনার (তোমার) রাজনীতিতে অবশ্যই যাওয়া উচিত, আমি তাদের দেখাশোনা করব।’ আমি জয় আর পুতুলকে আমার তিন সন্তান ববি, টিউলিপ আর রুপন্তীর সাথে একসাথে আমার ৫টি সন্তানের মতোই দেখতাম। হাসু আপা দেশে ফিরলেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হয়ে এবং জোরালোভাবেই রাজনীতি শুরু করলেন। তারপর প্রলম্বিত ধারাবাহিক আন্দোলন, মিছিল চলে একের পর এক, তিনি দু’বার প্রধানমন্ত্রীও হন, আবার ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলায় এক বছর কারাবন্দি জীবন কাটান। আমি কখনোই বিশ্রাম বা শান্তি পাইনি। যখন উনাকে জেলে নেওয়া হয়, নানান লোক নানান কথা বলে চলছিল। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস আছে, আল্লাহর ওপর বিশ্বাস ছিল আর আছে দেশবাসীর প্রতি আস্থা, আমরা জ্ঞানত এমন কোনো অন্যায় করিনি। বিচার আমরা নিশ্চয়ই পাব। আমি সবাইকে আশ্বস্ত করতে বলেছিলামÑ হাসু আপাকে অবশ্যই তার যথাযোগ্য মর্যাদা এবং সম্মানের সাথে মুক্তি দিতে হবে।
হাসু আপা পঁচাত্তরের সেই নারকীয় হত্যাকা-ের দুঃসহ স্মৃতি এক মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারেন না। অনেক উদ্বেগ, আশঙ্কা ছিল। তবে আমরা সব সময়ই তাকে সমর্থন জানাই তার সকল বলিষ্ঠ ও জনহিতকর কাজে। যদিও আমি তার অনেক ছোট, আমি তার ভুল বা দোষগুলো অনেক সময়ই ধরিয়ে দেই। হাসু আপা দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন কেবলই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তথা জাতির জন্মদাতা ও হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন করতে। সেই স্বপ্নটি হচ্ছেÑ বাংলার প্রতিটি মানুষের জন্য আধুনিকতম জীবনযাপন নিশ্চিত করা। জাতি হিসেবে বাঙালি সর্বোচ্চ মর্যাদা ও সম্মানে বিশ্বে এক আদর্শ জাতি হিসেবে অধিষ্ঠিত হবে। আমরা সকলেই বিশ্বাস করি সেই স্বপ্ন একদিন পূরণ হবেই।
আমি সব সময়ই আল্লাহর কাছে দোয়া করি হাসু আপা যেন তার ওপরে অর্পিত দায়িত্ব পালন করে যেতে পারেন, যদি এমনকি তাতে তার জীবন সংশয়ও ঘটে, তবুও। আমাদের মনে তো আর কোনো বড় অভিলাষ নেই কেবলই দেশ ও দশের জন্য কাজ করে যাওয়া ছাড়া।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ