শুক্রবার, মে ৩, ২০২৪
প্রচ্ছদটপঅনন্যার অনন্য বাবা

অনন্যার অনন্য বাবা

IMG_0626 “পৃথিবীতে মা বাবার নিজের সুখ আর আনন্দের চেয়ে সন্তানের সুখ আর আনন্দ আমার কাছে বেশী গুরুত্বপুর্ণ।আমার মেয়ে অনন্যা আমার জীবনের সব কিছু” এক নিশ্বাসে কথা গুলো বললেন,১২ বছরের কন্যা অনন্যার বাবা আজম খান। পরিচালকের চোখ দিয়ে নয়, একজন মায়ের চোখ দিয়ে দেখলাম, তার চোখ যেন চিকচিক করে উঠল।

সময় টা ছিল নভেম্বর মাস।একদিন এটিএন বাংলার চন্দন সিনহা ফোন দিলেন আমাকে দেখা করার জন্য।চন্দন দা আমাদের পারিবারিক বন্ধু।তার পরিবারের সাথে আমাদের পরিবারের দারুণ সম্পর্ক। তাছাড়া চন্দন দা কে আমি সম্মান করি।

আমার এডি সুব্রত মিত্র কে নিয়ে এটিএন বাংলায় গেলাম।চন্দন কফি দিলেন।খেলাম।বললেন,”ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড এর হেড অফ মার্কেটিং তোমাকে ফোন দিবেন।”” হাসতে হাসতে বললাম, “কেন? আমার তো কোন লোন লাগবেনা, প্রডিউসার ও লাগবেনা, তাছাড়া ওনাকে তো অামি চিনি না।” চন্দন দা বললেন,” ধুর বউদি, ওসব কিছু না। আজম খান দারুণ এক মানুষ। ১২ বছরের কন্যা আছে তার।তার শখ মাঝে মাঝে ভালো পরিচালকের সাথে কাজ করার।শখের কাজ।তোমার নাটকে কর্পোরেট লুক হ্যান্ডসাম বাবা লাগেনা?? তিনি আমাদের কাছে খুবই সম্মানিত।তাই তোমাকেই বললাম”

সুব্রত আর আমি হেসেই খুন।আমাকে নাম্বার টেক্সট করে দিলেন। দুইদিন পর আবার কল দিলেন। ” তোমাকে এত করে বললাম,একটা কল দিলানা আজম খান কে!!” চন্দন দার সেইদিনের কথাই ঠিক।১০ নভেম্বর তার কথা মত হ্যান্ডসাম আজম খানের সাথে আমার দেখা হল।ওই মাসে আমার সারামাস সুটিং ছিল। চিটাগং,রাংগামাটি রেসোর্ট,আর নেপালে । এর মধ্যে সময় বের করলাম,কথাও হল।

সেই নভেম্বর থেকে জুন।আজ সাত মাস ধরে তাকে আমি চিনি।খুবই ভদ্র, নম্র,মার্জিত, এবং অবশ্যই হান্ডসাম মানুষ আজম খান।না আজ পর্যন্ত কোন নাটকে তাকে আমার নেয়া হয়নি।

সেদিনের পর থেকে তার সাথে আমার ফোনে কথা হয় ।দেখা হয় । তার পরিবারের সাথেও পরিচয় হয়েছে পারিবারিক অনুষ্ঠানে । তার রুটিন ততদিনে আমার মুখস্ত হয়ে গিয়েছে।ভোর বেলা নামায পরে ছয়টায় মেয়েকে তুলে রেডি করে,নাস্তা করিয়ে নিজে রেডি হয়ে মেয়েকে নিয়ে বের হয়ে ধানমন্ডিতে স্কুলে দেয়া,নিজের অফিসে যাওয়া।অফিসে সারাটা দিন ব্যস্ত সময় কাটানো।ফাকে মেয়ের খোজ নেয়া, ফিরল কিনা ঠিকমত।লাঞ্চ করল কিনা, হোম ওয়ার্ক করল কিনা, এমন অনেক কথা।

রাত আটটা থেকেই অনন্যার কল।

বাবা তুমি কই?

এইত মা রাস্তায়।IMG_9801

রাস্তায় কি অনেক জ্যাম বাবা?

এইত একটু একটু।

তোমার সামনে কয়টা গাড়ি?

তুমি কি বাসায় আসছ?

আর কোথাও যাবে তুমি?

না মা কোথাও যাবনা।

হ্যা আজম খান পারত পক্ষে কোথাও যান না।

অফিসের পর কোন অফিসিয়াল প্রোগ্রাম না থাকলে তিনি সোজা বাসায় চলে যান।তার একটাই কথা অনন্যা অপেক্ষা করছে। ও একা। এক সকালে আজম খান এর ফোন এলো। আপনি কি ব্যস্ত? কেন বলেন তো? শুনেছি আপনার ছেলে মেয়ে তুখোর পড়াশুনায়।আমাকে একটা টিচার ঠিক করে দিবেন প্লিজ! আমি বাসায় ফিরে আমার মেয়েকে সব বললাম। ও বললো, আমি পড়াতে পারি । অনুলেখা এর আগেও পরিচালক শিহাব শাহীনের মেয়ে সফেনকে পড়িয়েছে। কিন্ত অনন্যাকে বাসায় আসতে হবে শুক্রবার আর শনিবার।পরে আজম খান নিজেই অনুলেখার সাথে ঠিক করল যে বাকি দুইদিন এনএসইউ থেকে আমার মেয়ের সুবিধা অনুযায়ী তাদের গাড়ি ওকে আনতে যাবে আবার পড়া হলে বাসায় দিয়ে আসবে। আমি তো অবাক।

শুরু হল বাবা আজম খান এর নতুন ছুটির দিন।শুক্র/ শনি আমাদের বাসায় নামিয়ে তিনি চলে যান তার বাবা মায়ের কবরস্থানে ।পরে মেয়েকে নিয়েই তার দিন রাত শেয হয়।নিজের সময় বলে তার কোন সময় নেই।জীবনের অনেক লোভনীয় আড্ডা তিনি স্যাক্রিফাইস করেছেন।মেয়ের ব্যপারে তিনি খুব আন্তরিক, ক্যায়ারিং আর বিশ্বস্ত। শপিং করা, সিনেমা দেখা, বই কেনা ডাক্তার দেখান, সব একাই তিনি বাবা হিসাবে পালন করেন।যা একজন মায়ের করার কথা।

একদিন আমাকে লাঞ্চের নিমন্ত্রন দিলেন।আমি গ্রহণ করলাম।শেষ বিকালে যখন আলো কমে আসছিল তখন আজম খান বললেন,”স্বপ্ন দেখি অনন্যা একদিন বড় হবে,দেশকে ভালবাসবে।আমি তো বৃদ্ধ মানুষ। ( এই কথাটা তিনি মজা করে বলেন।তিনি জানেন তিনি হ্যান্ডসাম) তাই অনন্যার জন্য একটা এপার্টমেন্ট কিনছি। ওই মায়াঘর এ ও থাকবে।আর আমার কথা মনে করবে।আমি তো আর সারাজীবন এই পৃথিবীতে থাকবনা।

অনন্যা যেন তার নামের মতই আলো ছড়ায় চারপাশ।ভালো মানুষ হয়।একজন বাবা হিসাবে ওর জন্য হয়ত অনেক কিছু করতে পারিনি কিন্ত আমি চেষ্টা করেছি। জানতে চাইলাম,নতুন করে জীবন সাজাতে ইচ্ছা করে না? তিনি দৃঢ় কন্ঠে বললেন,যদি বলি ইচ্ছে করেনা তবে মিত্থ্যা বলা হবে।করে।কিন্ত অনন্যার মত যার একটি দারুণ একটি রাজকন্যা আছে তার আর কিছু চাইতে নেই।”

সন্ধ্যা হয়ে গেল।রাতের সোডিয়াম লাইটের আলোতে বাসায় ফিরছিলাম।কখন যে নিজের অজান্তে দুই চোখ ভিজে জল পড়ল টের পেলাম না! আজম খান এর মত বাবা পাওয়া সত্যি ভাগ্যের। অনন্যা তুমি বড় হও।বাবার ইচ্ছা পুরণ করো। তুমি সত্যিই ভাগ্যবতী।

চয়নিকা চৌধুরী, নাট্য নির্মাতা

 

আরও পড়ুন

সর্বশেষ