শনিবার, মে ১৮, ২০২৪
প্রচ্ছদটপকণ্ঠের পরিচর্যা

কণ্ঠের পরিচর্যা

কণ্ঠস্বরকে বলা হয় ব্যক্তিত্বের প্রতীক। বিভিন্ন কারণে কণ্ঠস্বর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ বিষয়ে কথা বলেছেন অধ্যাপক ডা. মনিলাল আইচ লিটু। বর্তমানে তিনি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের নাক কান ও গলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত আছেন।

প্রশ্ন : কণ্ঠের পরিচর্যা বিষয়টি কী?

উত্তর : কণ্ঠকে আমাদের পরিমিতভাবে ব্যবহার করতে হবে। নিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যবহার করতে হবে। ভয়েস অ্যাবিউজ কী- সেটি জানলে হয়তো কণ্ঠের পরিচর্যা সম্বন্ধে বোঝা যাবে। যেমন : বেশি ধূমপান, মদ্যপান, ঠান্ডা, ধুলাবালি, মসলাযুক্ত খাবার- এগুলো কণ্ঠের ক্ষতি করে। এরপর পানিশূন্যতা, সারা দিন কথা বলছেন কিন্তু হয়তো পানি পান করছেন না-এসব কারণে কণ্ঠের ক্ষতি হয়।

প্রশ্ন : বেশি কথা বললে বা জোরে কথা বললেও কি কণ্ঠস্বরের ক্ষতি হয়? কারণ, আমরা দেখি দীর্ঘ সময় বক্তৃতা দিলে অনেকের কণ্ঠস্বর বসে যায়।

উত্তর : হ্যাঁ, এসব কারণে কণ্ঠের ক্ষতি হয়। প্রত্যেকটি ভোকাল কর্ড বা কণ্ঠস্বর অর্থাৎ যেটা দিয়ে আমরা শব্দ উৎপন্ন করি, এই জায়গাটিরও একটি ক্ষমতা আছে। কণ্ঠস্বর কিন্তু হারমোনিয়ামের রিডের মতো নড়ে। মেয়েদের ক্ষেত্রে এটি ২৫০-তে এবং ছেলেদের ক্ষেতে এটি ১২০ হার্জ পার সেকেন্ডে এটি নড়ে। এভাবে শব্দ তৈরি হয়। ওর যদি শক্তি না থাকে, তখন এটি বসে যাবে। অনেকক্ষণ ধরে যখন কণ্ঠস্বর কাজ করতে থাকে, তখন ক্লান্ত হয়ে যায়। পরে এটি বসে যায়। অনেকবার হতে হতে স্থায়ীভাবে এটি বসে যায়। অনেক গায়িকার অনেক সময় গান গাওয়ার সময় এটি বসে যায়।

প্রশ্ন : একজন মানুষের কণ্ঠ ভালো রাখতে নিয়মিতভাবে এর যত্ন কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

উত্তর : আপনি জানেন যে শিল্পীরা নিয়মিত কণ্ঠের চর্চা করেন। তাঁরা বিভিন্ন ধরনের রাগ চর্চা করে কণ্ঠের ব্যায়াম করে। সাধারণ লোকের ক্ষেত্রে যাঁরা কণ্ঠকে ব্যবহার করেন, শিক্ষক, এক্সিকিউটিভ- এই প্রসঙ্গে একটি বিষয় বলি কণ্ঠ কিন্তু মানুষের ব্যক্তিত্বের প্রতীক। মানুষের কোনো কাজের ওপর যে নিয়ন্ত্রণ এটি কিন্তু করে কণ্ঠ।

কণ্ঠের যত্ন নেওয়ার জন্য আমরা যে কাজগুলো করতে পারি, সেগুলো হলো : উপযুক্ত পরিমাণ পানি পান করা। কণ্ঠকে অ্যাবিউজ না করা। ধূমপান, মসলাযুক্ত খাবার না খাওয়া এগুলো করতে হবে।

প্রশ্ন : প্রয়োজনীয় পানি মানে কী?

উত্তর : দেড় থেকে দুই লিটার পানি পান করা উচিত। এ ছাড়া কিছু বিশেষ বিষয় রয়েছে। যেমন : ধরেন আজকে আপনি একটি বক্তৃতা দেবেন। যে বক্তৃতার স্থায়িত্ব এক ঘণ্টা। তাহলে সারা দিন আপনি কথা বললেন, এর পর গিয়ে বক্তৃতা দিলেন,  তাহলে হবে না। এর জন্য আগে থেকে আপনার কণ্ঠকে বিশ্রাম দিতে হবে।

এরপর মায়েরা বাচ্চাদের সঙ্গে উচ্চ স্বরে কথা বলেন, অনেক জোরে কথা বললে, ভোকাল কর্ডে মাইক্রোহেমোরেজ নামক সমস্যা হয়। এতে হেমাটোমা, ফ্রাইব্রোসিস হয়ে অনেক সময় কণ্ঠ পরিবর্তন হয়ে যায়। শিক্ষকরাও অনেক সময় একই রকমভাবে কথা বলেন। কণ্ঠের যে একটি বৈজ্ঞানিক বিষয় আছে এটি সম্প্রতি মানুষের নজরে এসেছে।

আপনি জানেন, লতা মুঙ্গেশকর পুনেতে একটি কণ্ঠের হাসপাতাল করেছেন। ওখানে আমিও দুবার প্রশিক্ষণ নিয়েছি। একটি স্বাভাবিক মাত্রায় আপনি কথা বলবেন। খুব জোরেও নয়, খুব আস্তেও নয়। অনেকের ধারণা হলো, আস্তে কথা বললে হয়তো কণ্ঠ ভালো থাকে। বিষয়টি মোটেও ঠিক নয়। খুব আস্তে কথা বলতে গেলেও কণ্ঠস্বরের অনেক বেশি শক্তি খরচ করতে হয়। আবার বেশি চিৎকার করে কথা বললেও কিন্তু শক্তি অনেক বেশি খরচ করতে হয় এবং অনেক সময় ভেতরে আহত হয়। সুতরাং মধ্যমই উত্তম। আরো একটি বিষয় রয়েছে। হঠাৎ যদি কণ্ঠের পরিবর্তন হয়, তাহলে অবশ্যই আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ দিতে হবে। কারণ, কণ্ঠের এই পরিবর্তন যদি এক মাস স্থায়ী থাকে, তাহলে আপনাকে বুঝতে হবে ওখানে কোনো রোগের কারণে এটি হয়েছে।

প্রশ্ন : সাধারণত কী কী পরিবর্তনের কারণে কণ্ঠস্বর পরিবর্তন হয়?

উত্তর : কণ্ঠস্বরের পলিপ, নডিউল, প্যাপিলোমা, সিঙ্গারস নডিউল, কারসিনোমা, ক্যানসার এসবের কারণে সমস্যা হয়ে থাকে। তখন আমরা পরীক্ষা করে দেখি কণ্ঠস্বরের অবস্থা কী? যদি চার সপ্তাহের বেশি কোনো ব্যক্তির কণ্ঠের পরিবর্তন থাকে, তাহলে তাকে অবশ্যই একটি এফওএল করতে হবে।

প্রশ্ন : অনেক সময় ঠান্ডা, ফ্যারিংজাইটিস, গলা ব্যথা হলে তখনো তো কণ্ঠের পরিবর্তন হয়। সে ক্ষেত্রে ওই সময়ের কণ্ঠের যত্ন কীভাবে নেবেন?

উত্তর : এ ক্ষেত্রে আপনাকে কম কথা বলতে হবে। কণ্ঠকে বিশ্রাম দিতে হবে। অ্যান্টিবায়োটিক খেতে পারেন। অ্যান্টিহিসটামিন-জাতীয় ওষুধ কাজে লাগে তখন। এ ছাড়া খাওয়ার সময় কুসুম গরম পানি খেতে হবে। গরম পানি দিয়ে ভাব নিতে পারেন। কুসুম গরম পানিতে একটু লবণ দিয়ে গার্গল করতে পারেন। তাহলে ওই জায়গাটা ভালো থাকবে। যদি ল্যারিংজাইটিস হয়ে যায়, তাহলে কিন্তু গরম পানির ভাপ নিতে হবে।

একটি পাত্রে গরম পানি করে পাত্রটি নামিয়ে তার ওপর একটি ভেজা গামছা দিতে হবে। এরপর এর ভেতর দিয়ে যে বাষ্পটা উঠবে, সেটাকে নাক দিয়ে টানতে হবে। এর সঙ্গে কোনো রাসায়নিক পদার্থ যোগ করা যাবে না। এতে ক্ষতি হবে। বাষ্পটি নাক দিয়ে টানতে হবে, পূর্ণ দম নিয়ে ভেতরে নিতে হবে, এরপরে মুখ দিয়ে ছাড়তে হবে। পরে আবার মুখ দিয়ে টান দেবেন। দম নিয়ে ফুসফুসে নেবেন নাক দিয়ে ছাড়বেন। এভাবে ১৫ মিনিট সকাল-বিকেল করলে শ্বাসনালিটা ভালো থাকবে, কণ্ঠস্বর ভালো থাকবে।

প্রশ্ন : একজন মানুষ তাঁর কণ্ঠস্বর নিয়ে সন্তুষ্ট নন, তিনি চান তাঁর গলা আরো দরাজ হোক। এটি কি কণ্ঠ যত্ন বা সার্জারি করে ভালো করা সম্ভব?

উত্তর : এটা ১৯৮২ সাল থেকে চালু হয়েছে। ইসিকি অস্ত্রোপচার। থাইরোপ্লাস্টি। বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি আছে কণ্ঠস্বরকে ভালো করার জন্য। লম্বা গলার স্বরকে যদি আপনি ছোট করে দেন, তাহলে কণ্ঠ মোটা হয়ে যাবে। যেমন ধরেন অনেকের মেয়েলি গলা, এটাকে পুরুষ কণ্ঠে পরিবর্তন করতে চান। এটি করা সম্ভব। এটি অস্ত্রোপচারের মাধ্যমেই করা সম্ভব। আমাদের দেশে কিছু কিছু সার্জন এটা করছেন। আমরাও এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। তবে প্র্যাকটিস করি না। তবে ভারতে এটি হয়, বাইরের দেশে এটি হয়। আমাদের দেশে বঙ্গব্ন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু কিছু চালু হয়েছে।

প্রশ্ন : অনেকের  বয়োসন্ধিকালের সময় এসে একটু কণ্ঠের পরিবর্তন হয়, পরে এসে ছেলেদের গলা একরকম, মেয়েদের গলা আরেক রকম। একেবারে চিহ্নিত হয়ে যাবে। কিন্তু কোনো ছেলের বেলায় দেখা যায় তার কণ্ঠস্বরটা একটু মেয়েলি থাকে। এটি কি ভালো করা সম্ভব?

উত্তর : অবশ্যই। মেয়েলি গলাও ছেলের মতো করা যাবে। ছেলেদের গলাও মেয়েদের মতো করা সম্ভব। এটি কোনো জটিল অস্ত্রোপচার নয়।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ