বৃহস্পতিবার, মে ২, ২০২৪
প্রচ্ছদজাতীয়হঠাৎ করেই রাজধানীর সড়কগুলো থেকে উধাও ব্যাটারিচালিত অবৈধ রিকশা

হঠাৎ করেই রাজধানীর সড়কগুলো থেকে উধাও ব্যাটারিচালিত অবৈধ রিকশা

হঠাৎ করেই রাজধানীর সড়কগুলো থেকে উধাও হয়ে গেছে ব্যাটারিচালিত অবৈধ রিকশা। আইনগত সীমাবদ্ধতার কারণে দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীর রাজপথ দাপিয়ে বেড়ালেও এ মাসের মাঝামাঝি সময়ে আড়ালে চলে গেছে এসব রিকশা। পুলিশি অভিযানে বেশ কিছু রিকশা আটক হলেও অনেকটাই ‘আত্মগোপনে’ চলে গেছে অধিকাংশ রিকশা। ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ট্রাফিক) মীর রেজাউল আলম  জানান, আইনি জটিলতার কারণে গত জানুয়ারি থেকে ব্যাটারিচালিত অবৈধ রিকশা উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ ছিল। জটিলতার সমাধান হওয়ায় কোনো ধরনের বাধা ছাড়াই তাঁরা আইন প্রয়োগে সফল হয়েছেন।

জানা গেছে, ব্যাটারিচালিত অবৈধ রিকশা চলাচল নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ছিল বিভিন্ন মহলে। ঝুঁকিপূর্ণ এ যানটি বিদ্যুতের অপচয়ের একটি বড় মাধ্যম। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচ্চপর্যায়ে এটি বন্ধ করার জন্য বিশেষ তোড়জোড় থাকলেও নিচের পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এ যানটিকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ ছিল। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতারও অভিযোগ ছিল। পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত রিকশা-ভ্যান মালিক সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে লাইসেন্সের দাবিতে আন্দোলনের পাশাপাশি উচ্চ আদালতের আদেশ নিয়ে বেশ দাপটের সঙ্গে রাস্তায় দাপিয়ে বেড়িয়েছে এসব রিকশা।

ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ট্রাফিক) মীর রেজাউল ইসলাম জানালেন, আইনি জটিলতা শেষ হওয়ার পর ৯ মে থেকে তাঁরা অভিযান শুরু করেন। ইতিমধ্যে রাজধানীর প্রধান সড়কসহ অলিগলি ব্যাটারিচালিত রিকশা মুক্ত হয়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, স্বাধীনভাবেই তাঁরা বেআইনি যানটি অপসারণে কাজ করেছেন। এ কাজে কোনো বাধা আসেনি বলেও জানান। ডিএমপির সব ইউনিট এ অভিযানে অংশ নিয়েছে। রাজধানীর বেশ কিছু গ্যারেজ ঘুরে জানা গেছে, বেশির ভাগ রিকশাই ঢাকার বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিছু কিছু রিকশার ব্যাটারি ও মোটর খুলে চালানো হচ্ছে।

অবৈধ হলেও চলেছে দীর্ঘদিন: রাজধানী ঢাকায় প্রায় ৩১ বছর আগে ১৯৮২ সালে শেষবারের মতো পায়ে চালানো রিকশা ও ভ্যানের লাইসেন্স দিয়েছিল সেই সময়ের অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন। সে হিসাবে ৮৬ হাজার বৈধ রিকশা ও ভ্যান রয়েছে এই নগরে। রিকশা চলাচল নিরুত্সাহিত করতে দীর্ঘ তিন দশক ধরে এসব রিকশার লাইসেন্স শুধু নবায়ন করে চলছে সিটি করপোরেশন। তবে বিভিন্ন সংগঠনের পরিসংখ্যান মতে, নগরে চলাচল করে কয়েক লাখ রিকশা।

ব্যাটারিচালিত রিকশা প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মমতাজ উদ্দিন বলেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ যান হিসেবে চিহ্নিত করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআরটিএ ব্যাটারিচালিত রিকশার বৈধতা দেয়নি। মোটরচালিত হওয়ার কারণে এ ধরনের যানের লাইসেন্স দেওয়ার এখতিয়ারও আমাদের নেই।’

বিআরটিএর উপপরিচালক (প্রকৌশল) সীতাংশু শেখর বিশ্বাস বলেন, ইঞ্জিন থাকলেও নিরাপত্তা এবং অন্যান্য দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশা যান্ত্রিক যানবাহন নয়। অন্যান্য যান্ত্রিক যানের চেয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশা ধীরগতির। দুর্ঘটনাও ঘটার আশঙ্কা থাকে। সে জন্য এর বৈধতা দেওয়া হয়নি এবং দেওয়ার সম্ভাবনাও নেই বললে চলে।

তিন বছরে ৪০ হাজার ব্যাটারিচালিত রিকশা: ঢাকার রাজপথে ব্যাটারিচালিত রিকশার চলাচল শুরু হয় বছর তিনেক আগে থেকে। পঙ্গু ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের সুবিধার্থে সীমিতভাবে ব্যাটারিচালিত রিকশার অনুমোদন দেওয়া হলেও সেই অনুমোদনের অপব্যবহার করে প্রতিদিনই বেড়েছে এই রিকশা। ১২ ভোল্টের দুই থেকে চারটি ব্যাটারির সঙ্গে একটি ছোট মোটর যুক্ত করে চলে তিন চাকার এই রিকশা। বাংলাদেশ রিকশা-ভ্যান মালিক শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদের তথ্যমতে, রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যা ৪০ হাজারেরও বেশি।

ব্যাটারিচালিত রিকশা এ হারে বাড়ার কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, চালকদের পরিশ্রম কম এবং আয় বেশি হওয়ায় তাঁরা এ ধরনের রিকশা চালাতে আগ্রহী। মালিকদের দৃষ্টিকোণ থেকে বিনিয়োগের তুলনায় আয় বেশি। সাধারণ একটি রিকশায় মালিকের বিনিয়োগ ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। আর তাতে দৈনিক আয় ১০০ থেকে ১৬০ টাকা। অন্যদিকে ব্যাটারিচালিত একটি রিকশায় বিনিয়োগ ৩৫ থেকে ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এ থেকে দৈনিক আয় ৩০০ থেকে ৫৫০ টাকা।

ঝুঁকিতে যাত্রীরা: মালিকেরা লাভবান হলেও ব্যাটারিচালিত রিকশায় চড়তে গিয়ে ঝুঁকিতে পড়েছেন যাত্রীরাই। নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের চলাচলের প্রধান বাহন রিকশায় চড়ে প্রতিনিয়তই দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন অনেকে। হরহামেশাই এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলেও এর কোনো তথ্য পাওয়া যায় না রাজধানীর থানাগুলোতে।

কয়েকজন রিকশাচালক জানান, সাধারণ রিকশার চেয়ে গতি বেশি, অথচ চাকা একই ধরনের হওয়ার কারণে প্রয়োজনে গতি কমানোর সময় রিকশাগুলো ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। ফলে দুর্ঘটনা ঘটে। কারিগরিভাবে বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা না থাকা এবং এর ব্রেক সাধারণ রিকশার মতো হওয়ায় গতি বেশি হলে সামলাতে পারেন না চালকেরা। প্রাইভেট কার, বাস, মোটরসাইকেলের মতো ব্রেক কষে চটজলদি থামানো যায় না। মফস্বল শহর ও গ্রামে চলা নছিমন-করিমনের মতো করে এক পা উঠিয়ে চালক এর গতি নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। তাই রাস্তার খানাখন্দে চাকা পড়ে গেলে উল্টে যায়, থমকে যায় যখন-তখন। রিকশার গতি নিয়ন্ত্রণের কোনো বিশেষ ব্যবস্থা না থাকায় দুর্ঘটনা ঘটে হরহামেশাই।
মোহাম্মদপুরের রিকশাচালক তারেক আহমেদ বলেন, ‘এইড্যা এমনই। আয় বেশি, কষ্ট কম হয়, তাই চালাই।’

বিদ্যুৎ চুরি ও অপচয়: এই রিকশার ব্যাটারি প্রতিদিনই চার্জ দিতে হয়। প্রতিটি রিকশায় ব্যবহার করা ব্যাটারি চার্জ দিতে প্রতিদিনই বিদ্যুত্ লাগে কমপক্ষে পাঁচ ইউনিট (কোনো কোনো রিকশায় ব্যবহার করা হয় দুটি ব্যাটারি, কোনোটিতে চারটি)। সেই হিসাবে ৪০ হাজার রিকশার পেছনে প্রতিদিন প্রায় দুই লাখ ইউনিট বিদ্যুত্ খরচ হয়। প্রতি রাতেই রাজধানীর গ্যারেজগুলোতে এসব ব্যাটারির চার্জ দেওয়া হতো। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গৃহস্থালি সংযোগের পাশাপাশি চোরাই সংযোগ থেকে বিদ্যুত্ ব্যবহার করা হয়। বিদ্যুত্ চুরির কারণে বড় ধরনের অপচয় হয় সরকারের। ৪০ হাজার রিকশার ব্যাটারি চার্জ দিতে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচ হতো তাতে ২০ হাজারেরও বেশি ছোট পরিবারের বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো যায়। ক্ষুদ্র ব্যবহারকারী হলে এ সংখ্যা হতে পারে ৫০ হাজার।

এবার আন্দোলনের হুমকি: ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে আন্দোলন শুরু করেছেন সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক তদবিরও শুরু হয়ে গেছে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ রিকশা-ভ্যান মালিক শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে মাঠে নেমেছেন মালিক-শ্রমিকেরা। পরিবেশবান্ধব এবং চালকদের কায়িক শ্রম কম—এ যুক্তি তুলে ব্যাটারিচালিত রিকশা অনুমোদনের দাবি জানানো হচ্ছে আবারও।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ