দিন যতই যাচ্ছে বেরিয়ে আসছে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। বিভিন্ন সময়ে নানা প্রলোভন দেখিয়ে মোট অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়ার প্রমাণও পেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ। রেজওয়ানা খালেদ ইমার প্রতারণার শিকার এমন ২২ জন প্রভাবশালীর নামের তালিকা আছে গোয়েন্দাদের হাতে। তবে আর্থিক লেনদেনের বাইরে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের কোনো ঘটনা জানাজানি হয়ে যেতে পারে এমন শঙ্কায় ভুক্তভুগিরাও চুপ আছেন। তবে ভেতরে ভেতরে পুড়ছেন প্রতিশোধের আগুনে।
ইমাকে জিজ্ঞাসাবাদ ও তদন্তে এ ২২ জনের তথ্য জানতে পেরেছে তদন্তকারী গোয়েন্দা পুলিশ। যাদের মধ্যে চার জন প্রভাবশালী চিত্র পরিচালক, ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও ব্যবসায়ীর ছেলে ৬ জন, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা ৩ জন, দুজন চাকরিজীবী, দুজন সাংবাদিক, ৩ জন রাজনীতিবিদ ও দুজন পুলিশ কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এডিসি মোহাম্মদ সানোয়ার হোসেন বলেন, ইমা ও তার পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে অনেকেই প্রতারিত হয়েছে। যাদের বেশির ভাগ সরাসরি অভিযোগ না দিয়ে পরোক্ষভাবে অভিযোগ জানানোর চেষ্টা করছেন। এতে ওইসব অভিযোগকারীর অভিযোগ তদন্তে আইনগতভাবে সমস্যা রয়েছে। এদিকে বৃহস্পতিবার আরও একটি মামলায় ইমাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করলে আদালত না মঞ্জুর করে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছেন। ওয়ারী থানায় দায়ের করা ১০ লাখ টাকা প্রতারণার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ইমা ও তার সহযোগীদের পরস্পর যোগসাজশে একজন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ওই টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল। তার অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আরও অনেকেই জড়িত। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে প্রতারণার বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
তদন্ত সূত্রমতে, এতোদিন যারা ইমা’র ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে ছিলেন। যারা তার কাছ থেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন তারাই এখন ইমাকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। প্রতারিত ব্যক্তি ও তার পরিবারের সদস্যদের নানাভাবে হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। এতে মান-সম্মানের ভয়ে অনেকেই নীরব রয়েছেন। আবার গোপন সম্পর্ক ফাঁস হওয়ার ভয়ে অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। যাদের মধ্যে রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, নাট্য ও সিনেমা পরিচালক রয়েছেন। এছাড়া, একাধিক পুলিশ কর্মকর্তাও ইমা’র ছলনার শিকার হয়েছেন।
সূত্র জানায়, ঢাকা মহানগর পুলিশের গুলশান জোনের একটি থানার প্রভাবশালী একজন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইমা’র কাছে ধরাশায়ী হয়েছেন। ইমা ও তার সুন্দরী নারী বহরের কাছে তিনি দিশাহীন হয়ে পড়েছিলেন। দফায় দফায় টাকা দিয়েছেন কোন চুক্তি ছাড়াই। ইমা গ্রেপ্তারের পর এখন তিনি বিব্রত। না পারছেন টাকা তুলতে, না পারছেন কাউকে বলতে। ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, তার মতো আরও একাধিক কর্মকর্তা রয়েছেন। যারা ইমার প্রতারণার শিকার হয়েছেন। তবে স্বনামধন্য চিত্র পরিচালক সোহানুর রহমান সোহান গোয়েন্দা কার্যালয়ে হাজির হয়ে ইমা ও তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। অভিযোগ দিয়েছেন বাড্ডা শাখা অগ্রণী ব্যাংকের ম্যানেজার। বিদেশে লোক পাঠানোর কথা বলে তার কাছ থেকে ২২ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ডাচ্ বাংলা, ইস্টার্ন ব্যাংক লি. সহ আরও একাধিক ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের টাকা লোন নিয়েছে। অ্যামেরিকা প্রবাসী এক যুবককে বিয়ের ফাঁদে ফেলে ১২ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ইমা। একইভাবে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মামুন ও সাগরের কাছ থেকে ৬ লাখ, স্বপ্নার কাছ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার, নাহারের কাছ থেকে ৯ লাখ টাকা, সায়েমের কাছ থেকে ২ লাখ, রহমত উল্লাহ ও ওয়াকিলের কাছ থেকে ৯ লাখ, মনির কাছ থেকে ২ লাখ ও আনোয়ারের কাছ থেকে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ইমা ও তার পরিবার।
সূত্র জানায়, গুলশানের একজন রাজনীতিবিদ ইমার ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ইমা গ্রেপ্তারের পরপরই তিনি ছোট বোন দাবি করে ছেড়ে দেয়ার তদবির করেছিলেন। পরে অবশ্য শ’ শ’ প্রতারণার কথা জানতে পেরে তিনি পিছু হটেন। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা তাকে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিলে তিনি ইমার সঙ্গে পরিচয়ের কথা অস্বীকার করেন। উদীয়মান নাট্যকার দীপঙ্কর সেনগুপ্তের একটি প্রতারণার মামলায় গত শুক্রবার রাজধানীর হাতিরঝিল থেকে ইমাকে গ্রেপ্তার করে। এরপরই ইমার বিরুদ্ধে শ’ শ’ প্রতারণার অভিযোগ গোয়েন্দা কার্যালয়ে জমা হতে থাকে।
ইমার বাবা-ভাইকে খুঁজছে পুলিশ: ইমার ভাই তানভীর খালেদ ও পিতা আলমগীর খালেদকে ধরতে বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পরিচালনা করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। ইমা গ্রেপ্তারের পরপরই তারা গাঢাকা দিয়েছে। গোয়েন্দা তথ্যমতে প্রতারক পিতা ও পুত্র এখন ঢাকার বাইরে অবস্থান করছে। তাদের অবস্থান শনাক্ত করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। গোয়েন্দারা জানান, বিভিন্ন কৌশলে নানাজনের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে খালেদ তানভীর। পাওনাদাররা ওই টাকা পরিশোধের জন্য চাপ দিলে জিরো ব্যালান্সের অ্যাকাউন্ট নম্বরের চেক দিয়েছে। চেক ডিজওনার হওয়ার পর ওই পাওনাদারের পেছনে নিজের বোন ইমাকে লেলিয়ে দিতো। ইমা ছল-চাতুরি করে পাওনাদারকে তার ফ্ল্যাটে নিয়ে যেতো। অন্তরঙ্গ হওয়ার প্রস্তাব করতো। এতে কাজ না হলে পিতা আলমগীর খালেদের কাছে নিয়ে যেতো। আলমগীর খালেদ পাওনাদারকে ইমোশনালী ব্ল্যাকমেইল করতো। ‘বাবা’ সম্বোধন করে পাওনাদারের পরিবারের খোঁজ নিতো। পাশাপাশি তার অসুস্থ স্ত্রীর কথা বলে পাওনাদারকে নানা প্রলোভনে আশ্বস্ত করতো। গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, ভাই ধার নিতো, পরিশোধের দায়িত্ব দিতো বোন ইমাকে। ইমা ব্যর্থ হলে তাদের বাবা আলমগীর নানা কৌশলে বাগে রাখার চেষ্টা করতো। এভাবেই দিনের পর দিন শ’ শ’ মানুষের সঙ্গে তারা প্রতারণা করেছে।
আমি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে কারাবাসী: এদিকে আদালতে সাংবাদিকদের কাছে ইমা দাবি করেছে, তার সাবেক প্রেমিক আবদুল করিম মজুমদার শুভ্রর কারণেই সে কারাবাসী হয়েছে। কিছুদিন আগে তার সঙ্গে প্রেমের বিচ্ছেদ ঘটে। এরপর থেকেই সে ফাঁসানোর ষড়যন্ত্র করে। তার দাবি- বেসরকারি একটি টেলিফোন কোম্পানির কর্মকর্তা মাইন আহমেদের সঙ্গে ২০০৫ সালে তার বিয়ে হয়েছিল। এ অবস্থায় একই প্রতিষ্ঠানের আরেক নারী কর্মকর্তা হিবু চৌধুরীর সঙ্গে তার স্বামী পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় ২০০৭ সালে মাইনকে ডিভোর্স দেয় সে। হিবু বর্তমানে মাইনের স্ত্রী। মাইনের অবৈধ সম্পর্কের কথা জানিয়েছিল শুভ্র। তখন সে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায়। বর্তমানে সে জিগাতলায় থাকে। প্রতারণা মামলা বিষয়ে মডেল ইমা বলে, মনিরুজ্জামানকে ভিওআইপি লাইসেন্স দিবে বলে আমার ভাই খালেদ এগারো লাখ টাকা নিয়েছিল। তবে লাইসেন্স দিতে না পারায় মনিরুজ্জামানকে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা দিলেও বাকি টাকা দেয়নি। আমাকে ষড়যন্ত্র করে এ মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে মডেল ইমা বলে, আমি ‘স্টার ডোম’ নামের একটি বিনোদন পত্রিকা সম্পাদনা করি। ‘স্টার ডোম’ নামে একটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আমি কোন অন্যায় করিনি। কাউকে ঠকাইনি।