রবিবার, মে ৫, ২০২৪
প্রচ্ছদইন্টারভিউউইকিলিকসের তথ্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে বাধা ছিল তারেকের

উইকিলিকসের তথ্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে বাধা ছিল তারেকের

ষ্টাফ  রিপোর্টার  (বিডিসময়২৪ডটকম)

র্নীতির অভিযোগে খালেদা জিয়ার বড় ছেলে ও বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে না দিতে দেশটির ঢাকা দূতাবাস থেকে ওয়াশিংটনে একটি গোপন বার্তা গিয়েছিল। আলোচিত ওয়েবসাইট উইকিলিকসের ফাঁস করা ওই বার্তাটি ২০০৮ সালের ৩ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস থেকে দেশটির পররাষ্ট্র দফতরে পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, ‘রাজনৈতিকভাবে সংঘটিত ব্যাপক মাত্রায় দুর্নীতির জন্য তারেক রহমান দায়ী বলে দূতাবাস মনে করে। তার দুর্নীতির কারণে মার্কিন ঘোষণাপত্রের ৪ নম্বর ধারায় বর্ণিত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের স্থিতিশীলতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সহায়তার লক্ষ্য বিনষ্ট হওয়ার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়েছে।’

তবে তারেকের স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমান, মেয়ে জাইমা ও মা খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো নিষেধাজ্ঞা চাওয়া হয়নি দূতাবাস থেকে। তারেকের যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকায় নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাবের পক্ষে বিস্তারিত তুলে ধরা হয় ওই বার্তায়। বার্তায় বলা হয়, ‘বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ যেখানে জনজীবনের সব ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত দুর্নীতি স্বীকৃত। ২০০৬ সালে টানা চতুর্থবারের মতো ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশ শীর্ষ অবস্থানে থাকে। ‘কয়েক মাসের রাজনৈতিক অস্থিরতার পর ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসা তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুর্নীতির মূল উৎপাটন এবং দারিদ্র্যপীড়িত এ জাতিকে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা চৌর্যবৃত্তি থেকে মুক্তি দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। প্রকৃতপক্ষে দুর্নীতির কারণে প্রতিবছর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার দুই শতাংশ কম হয় বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।’ সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের বিষয়ে তার বার্তায় বলা হয়, ‘দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে সরকারের ইচ্ছা বা সামর্থ্য নিয়েও অনেক সংশয় রয়েছে।’ এভাবে দুর্নীতি চলতে থাকলে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতে আস্থার সংকট তৈরি হওয়ার পাশাপাশি একটি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় জনআকাঙ্ক্ষায় ফাটল ধরবে বলেও উদ্বেগ জানানো হয় বার্তায়।

বার্তায় তারেক রহমানকে ‘কুখ্যাত এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে, যাকে সবাই ভয় পায়’ বলে বর্ণনা করা হয়। জামিনে মুক্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য ২০০৮-এর ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্যের উদ্দেশে তার যাত্রা করার কথাও তুলে ধরে মার্কিন দূতাবাস।

এরপর বার্তায় তাতে তারেক জিয়া সম্পর্কে বলা হয়, ‘সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত বিষয় এবং রাজনৈতিক পদ দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে যত্রতত্র ঘুষ চাওয়ার জন্য তারেক জিয়া কুখ্যাত। দুর্নীতিপ্রবণ সরকার এবং বাংলাদেশের সহিংস রাজনীতির এক দৃষ্টান্ত সে।’

ঘুষ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, অর্থআত্দসাৎ ও কর ফাঁকিসহ বিভিন্ন অভিযোগে মামলা চললেও তাকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয় বলে বার্তায় উল্লেখ করা হয়।

গভীর রাজনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে, যা দেশের সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত পেঁৗছেছে তার মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বাধা কাটিয়ে বিচারিক ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে তারেক জামিন পেয়েছেন, বলে বলা হয় বার্তায়। এতে বলা হয়, ‘আমরা মনে করি তারেক জিয়ার বেশ কয়েকটি পাসপোর্ট আছে। তার একটিতে যুক্তরাজ্য ভিসা দিয়েছে। ২০০৫ সালের ১১ মে ইস্যু করা অন্য একটি পাসপোর্টে পাঁচ বছর মেয়াদি (বি১/বি২) ভিসা লাগানো আছে। সরকার সেটি জব্দ করেছে বলে আমাদের ধারণা।

‘তারেক কয়েকশ’ মিলিয়ন ডলারের অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছে বলে খবর রয়েছে। তার বিরুদ্ধে একাধিক চাঁদাবাজির মামলা রয়েছে। তার বিরুদ্ধে একজন প্রখ্যাত ব্যবসায়ী জবানবন্দি দিয়েছেন, যিনি তার ক্ষমতার অপব্যবহারের শিকার হয়েছেন।’

বার্তায় বলা হয়, একটি মামলায় তারেক আল আমিন কনস্ট্রাকশনের মালিক আমিন আহমেদকে হুমকি দিয়েছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে। দেড় লাখ ডলার না দিলে তার প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে। রেজা কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের মোহাম্মদ আফতাব উদ্দীন খান, মীর আখতার হোসেন লিমিটেডের মীর জহির হোসেন ও হারুণ ফেরদৌসিসহ অন্য অনেক স্থানীয় ব্যবসায়ী তার বিরুদ্ধে কয়েক মিলিয়ন ডলারের চাঁদাবাজির অভিযোগ করেছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনও তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ এনেছে এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর ফাঁকির মামলা দিয়েছে। মার্কিন দূতাবাস বলেছে, তারেকের দুর্নীতির কর্মকাণ্ড শুধু স্থানীয় কোম্পানির কাছে চাঁদাবাজির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধানে তার বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঘুষ নেওয়ার অনেকগুলো ঘটনায় জড়িত থাকার তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

ক. সিমেন্স : সিমেন্সের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে তারেক ও তার ভাই আরাফাত রহমান কোকোকে দেওয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত একজনের সাক্ষ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে সিমেন্সের সব চুক্তির ক্ষেত্রে তারেক প্রায় দুই শতাংশ ঘুষ নিয়েছেন। এ মামলাটি যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগের সম্পদ বাজেয়াপ্তকরণ শাখা ও এফবিআই খতিয়ে দেখছে।

খ. হার্বিন কোম্পানি : দুর্নীতি দমন কমিশন সূত্র জানিয়েছে, একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য চীনের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান তারেক রহমানকে সাড়ে সাত লাখ ডলার দেয়। তারেকের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু এ ঘুষের অর্থ নিয়ে তা সিঙ্গাপুরে সিটিব্যাংকে রাখে।

গ. মোনেম কনস্ট্রাকশন : দুর্নীতি দমন কমিশনের এক কর্মকর্তা দূতাবাসকে জানিয়েছেন, মোনেম কনস্ট্রাকশন একটি কার্যাদেশ পেতে তারেক রহমানকে সাড়ে চার লাখ ডলার দেয়।

‘ঘুষ ও চাঁদাবাজি ছাড়াও তারেক বড় অঙ্কের অর্থ আত্দসাতের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে এসিসি জানিয়েছে। কয়েক সহযোগীর সহায়তা নিয়ে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের দুই কোটি টাকা লুট করেন তারেক। এসিসির এক কর্মকর্তা জানান, ওই ট্রাস্ট ফান্ডের ব্যাংক হিসাবের সহস্বাক্ষরকারী হিসেবে ফান্ড থেকে টাকা তুলে নিজের শহরে তিনি জমি কেনেন। ২০০৬ সালে নির্বাচনী প্রচারণার সময় ওই ফান্ডের চেক তিনি কর্মীদের দেন। মার্কিন দূতাবাস বলেছে, তারেকের দুর্নীতি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে ক্ষুণ্ন করেছে।

তার ব্যক্তিক্রমী কর্মকাণ্ডে সরকার এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের স্থিতিশীলতার প্রতি জনগণের ভরসা কমে গেছে। আইন লঙ্ঘনে তারেক যে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে তা আইন সংশোধন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক সহায়তা লক্ষ্য অর্জন ঝুঁকির মুখে পড়েছে। ‘বাংলাদেশে ঘুষ, অর্থ আত্দসাৎ ও দুর্নীতির সংস্কৃতি গড়ে তোলা ও বজায় রাখার ক্ষেত্রে তারেক যা করেছেন তাতে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অনেক সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে। তিনি মিলিয়ন ডলার জনগণের অর্থ চুরি করায় মুসলিম প্রধান এ উদারপন্থি দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিঘি্নত হয়েছে এবং একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগ ব্যাহত হয়েছে, যা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলে একটি অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।’

‘তারেকের বেপরোয়া দুর্নীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্র মিশনের লক্ষ্যগুলোও ব্যাপকভাবে হুমকিতে পড়েছে। ঢাকা দূতাবাসের বাংলাদেশের জন্য তিনটি বিষয়ে অগ্রাধিকার রয়েছে। গণতন্ত্রায়ন, উন্নয়ন ও সন্ত্রাসীদের জায়গা না দেওয়া। তারেকের দুর্নীতিতে তিনটি লক্ষ্য অর্জনই বিঘি্নত হয়েছে। তার অর্থআত্দসাৎ, চাঁদাবাজি ও বিচার ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপের কারণে আইনের শাসন ব্যাহত হয়েছে এবং স্থিতিশীল ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্যকে হুমকিতে ফেলেছে।’ ‘ব্যবসায় দুর্নীতি ও ঘুষের যে চর্চা তারেক গড়ে তুলেছেন তাতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টা ব্যাহত হয়েছে। উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় বিদেশি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হওয়ার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর আন্তর্জাতিক কার্যক্রম জটিল হয়ে পড়েছে।’

‘চূড়ান্তভাবে, আইনের শাসনের প্রতি তার চরম অবাধ্যতা বাংলাদেশে সন্ত্রাসীদের আস্তানা গাড়ার অনুকূল পরিবেশ তৈরির সুযোগ দেওয়ার পাশাপাশি দারিদ্র্য বৃদ্ধি ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করেছে। সংক্ষেপে বলা হয়, বাংলাদেশে যা কিছু খারাপ তার বেশিরভাগের জন্যই তারেক ও তার সহযোগীদের দায়ী করা যায়।’

আরও পড়ুন

সর্বশেষ