শনিবার, মে ১৮, ২০২৪
প্রচ্ছদজাতীয়আপাতত ‘নমনীয়’ থাকবে জামায়াত !

আপাতত ‘নমনীয়’ থাকবে জামায়াত !

ষ্টাফ  রিপোর্টার  (বিডিসময়২৪ডটকম)

রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে অন্তত পাঁচটি বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর নীতিনির্ধারকদের ধারণা ভুল ছিল বলে সম্প্রতি দলটির নিজস্ব মূল্যায়নে উঠে এসেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দলটি আন্দোলনের ধরনে পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে। আপাতত দলটির নিজস্ব কর্মসূচি থাকছে না। কর্মীদেরও ‘নমনীয়’ রাখার কৌশল নেওয়া হয়েছে বলে দলটির দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে।

এর কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে দলীয় সূত্রগুলো জানায়, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সংঘটিত সব সহিংসতার দায় এককভাবে জামায়াতের ওপর পড়ছে। এমনকি সরকারের পাশাপাশি এখন বিএনপিও আকারে-ইঙ্গিতে সহিংসতার দায় জামায়াতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এর বাইরে আন্তর্জাতিক মহলেও অনেকের মধ্যে জামায়াত সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়েছে, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৬ জানুয়ারি ইউরোপীয় পার্লামেন্টে গৃহীত প্রস্তাবে। তাতে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সুস্পষ্ট দূরত্ব বজায় রাখার জন্য বিএনপির প্রতি আহ্বান জানানো হয়। সব মিলিয়ে জামায়াত একটি কঠিন সংকটে পড়েছে।

জামায়াতের বিভিন্ন পর্যায়ের একাধিক নেতা জানান, বল প্রয়োগ করে রাজপথে কর্মসূচি পালন করার ফলও শেষ পর্যন্ত নিজেদের পক্ষে যায়নি; বরং ক্ষতির কারণ হয়েছে। এতে সরকার জামায়াতকে ‘জঙ্গি বা সন্ত্রাসবাদী’ দল হিসেবে দেশে-বিদেশে প্রচার করার সুযোগ পেয়েছে। কৌশল পরিবর্তন করার ক্ষেত্রে এ বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হয়েছে।
এ ছাড়া বিএনপিও ইদানীং জামায়াতের সঙ্গে কিছু দূরত্ব বজায় রেখে চলছে। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নির্বাচনোত্তর প্রথম গণসমাবেশ করেন গত সোমবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। এটি ছিল ১৮-দলীয় জোটের কর্মসূচি। কিন্তু পরে সে কর্মসূচিতে জামায়াতকে আসতে বারণ করা হয়। এটা নিয়েও জামায়াতের মধ্যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া রয়েছে। অবশ্য জোটের শরিক ধর্মভিত্তিক অন্য দলগুলোকে এ সমাবেশে দেখা যায়নি।

দলের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানায়, দেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে সম্প্রতি জামায়াতের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে একটি মূল্যায়ন হয়। তাতে উঠে আসে যে পাঁচটি বিষয়ে জামায়াতের ধারণা ভুল ছিল। প্রথমটি হচ্ছে, দলের নেতা-কর্মীদের দেখামাত্র গুলি-গ্রেপ্তারসহ তাঁদের ওপর সরকারের ‘দমননীতির’ মাত্রা যে এতটা ব্যাপক হতে পারে, তা ভাবতে পারেননি দলটির নীতিনির্ধারকেরা। দ্বিতীয়ত, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি আওয়ামী লীগ যে এত জোরালোভাবে দেশে জাগিয়ে তুলতে পারবে, সেটাও ছিল ধারণার বাইরে। তৃতীয়ত, জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির জোট বাঁধাকে আওয়ামী লীগ যেভাবে ‘ইস্যু’ করে তুলেছে, সেটাও চিন্তার বাইরে ছিল। দলটির নেতারা মনে করেছিলেন, আওয়ামী লীগ যে অতীতে জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন করেছিল, সেটা তারা এতটা ভুলে যাবে না। চতুর্থত, গত কয়েক বছরের সব রাজনৈতিক সহিংসতা এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ও নির্যাতনের দায় এককভাবে জামায়াতের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে, সেটাও তাঁরা ভাবতে পারেননি। পঞ্চমত, প্রতিবেশী দেশ ভারত আওয়ামী লীগকে দিয়ে জামায়াতকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করছে বলে মনে করছেন দলটির নীতিনির্ধারকেরা। তাঁদের কাছে ভারতের এতটা কঠোর অবস্থান প্রত্যাশিত ছিল না। সব মিলিয়ে দলটি এখন বড় ধরনের অস্তিত্বের ঝুঁকিতে পড়েছে বলে তাঁদের মূল্যায়নে উঠে এসেছে।

জামায়াতের মধ্যম সারির একজন নেতা বলেন, তাঁদের ধারণা ছিল, গত এক বছরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে জামায়াতেরও যে বেশ কিছু নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন, তা আন্তর্জাতিক মহল বিবেচনায় নেবে। কিন্তু জামায়াত সম্পর্কে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সাম্প্রতিক অবস্থান দেখে দলটির নেতারা হতাশ হয়েছেন।
অবশ্য, দলের ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদ এক বিবৃতিতে দাবি করেছেন, ইউরোপীয় পার্লামেন্টে গৃহীত প্রস্তাবটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রকৃত মতামতকে প্রতিফলিত করেনি। তিনি ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রস্তাবের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলেন, একটি রাজনৈতিক দলের অন্য যেকোনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জোট বা কোয়ালিশন করার অধিকার রয়েছে।

উদ্ভূত পরিস্থিতি জামায়াতের জন্য অত্যন্ত বিপৎসংকুল বলে মনে করছেন দলটির রাজনীতির অন্যতম চিন্তাশীল ব্যক্তি ও সাবেক সচিব শাহ আবদুল হান্নান। জামায়াতের সহিংস রাজনীতি নিয়ে বিভিন্ন মহলের প্রশ্ন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ‘জামায়াত যদি কোনো সন্ত্রাস করে থাকে, তবে তা সরকারি দল ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যা করেছে, তার তুলনায় অনেক কম। এর পরও আমি বলব, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। তবে কোনোভাবেই সহিংসতা করা যাবে না।’

দলীয় সূত্রগুলো জানায়, ১৮-দলীয় জোটের বাইরে আগামী কিছুদিন নিজস্ব কর্মসূচি রাখতে চাইছে না জামায়াত। তবে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বা উচ্চ আদালত থেকে দলের কোনো নেতার বিরুদ্ধে রায় হলে, তার প্রতিবাদে এক বা দুই দিনের হরতাল কর্মসূচি দেওয়া হতে পারে।

অবশ্য গত ১১ জানুয়ারি জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের আলাপকালে এ প্রতিবেদককে বলেছিলেন, তাঁরা কর্মসূচির ভেতরেই আছেন। ‘অবৈধ’ সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। তবে সামনে আন্দোলনের ধরন ও কৌশল পরিবর্তন হবে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ