রবিবার, মে ৫, ২০২৪
প্রচ্ছদইন্টারভিউপ্রজাতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত ৪৮ প্রার্থীর আয় গড়ে বেড়েছে ৫৮২%

প্রজাতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত ৪৮ প্রার্থীর আয় গড়ে বেড়েছে ৫৮২%

বিশেষ প্রতিনিধিঃ (বিডি সময় ২৪ ডটকম)

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রজাতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত ৪৮ প্রার্থীর আয় গড়ে ৫৮২ শতাংশ বেড়েছে। তাঁদের মধ্যে ডেপুটি স্পিকারের ৪৪৩৫ শতাংশ; সংসদ উপনেতা, চিফ হুইপ ও হুইপদের আয় বেড়েছে গড়ে ৩০৭১ শতাংশ। মন্ত্রীদের ২৪৩ শতাংশ ও প্রতিমন্ত্রীদের ৪৬৪ শতাংশ আয় বেড়েছে। প্রধানমন্ত্রীর আয় বেড়েছে ১৩৬ শতাংশ। এই ৪৮ জন প্রার্থীর হলফনামা বিশ্লেষণ করে এই তথ্য দিয়েছে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)। গতকাল শুক্রবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সুজন এসব তথ্য তুলে ধরে।

সংবাদ সম্মেলনে বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, প্রজাতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা এসব ব্যক্তির অনেকেই সংবিধান লঙ্ঘন করে ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন। সংবিধান লঙ্ঘন করার অপরাধে তাঁদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের অভিযোগ আনা যেতে পারে।
সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, মহাজোট সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, ডেপুটি স্পিকার, সংসদ উপনেতা, চিফ হুইপ, হুইপের দায়িত্ব পালনকারীদের যাঁরা দশম সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, তাঁদের ২০০৮ ও ২০১৩ সালে দেওয়া হলফনামার তথ্যের ভিত্তিতে আয়, সম্পদ, দায়দেনা, আয়কর-সংক্রান্ত তথ্য এবং পারিবারিক ব্যয়ের তথ্য সুজন বিশ্লেষণ করেছে। রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় এবং নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের তথ্য ও নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য তাঁরা বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা এ কথা হলফ করে বলতে পারি, নিশ্চয়ই অনেকের অনেক তথ্য আমাদের বিস্মিত করেছে।’
সুজনের বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০৮ সালের তুলনায় ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আয় বেড়েছে ১৩৬ শতাংশ। একে সুজন অস্বাভাবিক মনে করে কি না, এ প্রশ্নে বদিউল আলম মজুমদার বলেন,—‘এ আয় স্বাভাবিক না অস্বাভাবিক, এ নিয়ে আমরা কোনো মন্তব্য করতে চাই না। আমরা শুধু তথ্য তুলে ধরেছি।’
আয় হ্রাস-বৃদ্ধি: সুজনের বিশ্লেষণে দেখা যায়, আয় সবচেয়ে বেড়েছে হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরীর। ২০০৮ সালে তাঁর আয় ছিল চার লাখ ৪৮ হাজার টাকা। তাঁর ওপর নির্ভরশীলদের কোনো আয় ছিল না। ২০১৩ সালে তাঁর নিজের ও নির্ভরশীলদের মোট আয় ১৪ কোটি ৮২ লাখ ২০ হাজার ৮৮৭ টাকা। অর্থাৎ, আয় বেড়েছে ৩২ হাজার ৯৮৫ শতাংশ। এ সময়ে গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান খানের আয় বেড়েছে ৮৪২২ শতাংশ, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুবুর রহমানের ৮০০৭ শতাংশ, পরিবেশ ও বনমন্ত্রী হাছান মাহমুদের ২০৩৬ শতাংশ এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী আফছারুল আমিনের ২৪৮০ শতাংশ।
তবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী মুজিবুর রহমান ফকির, প্রতিমন্ত্রী ওমর ফারুক চৌধুরী ও হুইপ আ স ম ফিরোজের আয় কমেছে। বাণিজ্যমন্ত্রী গোলাম মোহাম্মদ কাদেরের ২০১৩ সালের আয় দেখানো হয়নি। সুজন বলেছে, বিষয়টি বোধগম্য নয়।
সম্পদের হ্রাস-বৃদ্ধি: বিশ্লেষণ অনুযায়ী, পাঁচ বছরে এই ৪৮ জনের সম্পদ বেড়েছে গড়ে ৩৬৩ শতাংশ। মন্ত্রীদের ২৪৭ শতাংশ, প্রতিমন্ত্রীদের ৪৫৯ শতাংশ এবং সংসদ উপনেতা, চিপ হুইপ ও হুইপদের সম্পদ বেড়েছে ১৬৮৯ শতাংশ। এ সময়ে প্রধানমন্ত্রীর সম্পদ বেড়েছে ৪৬ শতাংশ। ডেপুটি স্পিকার শওকত আলীর সম্পদ বেড়েছে ২৩৮ শতাংশ।
সুজন বলেছে, পাঁচ বছরে গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান খানের ১০ হাজার ৯৯৭ শতাংশ সম্পদ বেড়েছে। এর পরের অবস্থানে আছেন নূর-ই-আলম চৌধুরী, ৬৪২৪ শতাংশ। হাছান মাহমুদের ৩৮৯২, পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর ১৯৬৯, হুইপ মির্জা আজমের ১৪১৪, মোহম্মদ মাহবুবুর রহমানের ১২৬৩ এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরের ১১৩৫ শতাংশ সম্পদ বেড়েছে।
পাঁচ বছরে কোটি টাকার ওপর সম্পদ বেড়েছে এমন ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, শ্রমমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ, সংস্কৃতিমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ, শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ, নৌমন্ত্রী শাজাহান খান, রেলমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক, নারী ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শামসুল হক টুকু, আইন প্রতিমন্ত্রী মো. কামরুল ইসলাম, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিন, ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী, চিফ হুইপ আবদুস শহীদ ও হুইপ সেগুফতা ইয়াসমিন।
তবে ভূমি প্রতিমন্ত্রী মো. মোস্তাফিজুর রহমান ২০০৮ সালের হলফনামায় চারটি ফ্ল্যাটের মূল্য উল্লেখ করলেও এবার করেননি।
প্রার্থীদের দায়দেনা: সুজন বলেছে, এই প্রার্থীদের অর্ধেকই ঋণগ্রহীতা। তাঁদের মধ্যে আ স ম ফিরোজ ২১ কোটি ৯৩ লাখ ৮৫ হাজার ২১৩ টাকা, মির্জা আজম ১১ কোটি টাকা, খাদ্যমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক নয় কোটি ১০ লাখ ৫৫ হাজার টাকা, মহীউদ্দীন খান আলমগীর আট কোটি ৯৫ লাখ, স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক আড়াই কোটি টাকা, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এ বি তাজুল ইসলাম দুই কোটি ১১ লাখ ৭৫ হাজার ৫৫২ টাকা, স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হকের এক কোটি টাকার দেনা আছে। এই ৪৮ জনের মধ্যে ১০ জন ঋণগ্রহীতা নন।
সম্পদের পরিমাণ: সুজন বলেছে, এই ৪৮ জনের মধ্যে বেশি সম্পদের মালিক নূর-ই-আলম চৌধুরী। তাঁর সম্পদের পরিমাণ ৪১ কোটি ৬৪ লাখ ৩১ হাজার ৪৩৭ টাকার। ১০ কোটি টাকার অধিক সম্পদ আছে তাঁদের তালিকায় আছেন আ ফ ম রুহুল হক (১৫ কোটি ৫৪ লাখ ৭৪ হাজার ১৪৬ টাকা), হাছান মাহমুদ (১৫ কোটি ২৩ লাখ ৯১ হাজার ৮৭০ টাকা), দপ্তরবিহীনমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত (১১ কোটি ৩৪ লাখ ৬৮ হাজার ৩৫৮ টাকা), প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন (১০ কোটি ৫০ লাখ ২৯ হাজার ৫০৮ টাকা), মহীউদ্দীন খান আলমগীর (১০ কোটি ৮ লাখ ৮৬ হাজার ৭৭৬ টাকা)।
সুজন বলেছে, আব্দুর রাজ্জাক, এ বি তাজুল ইসলাম ও আ স ম ফিরোজের সম্পদের চেয়ে দায়দেনা বেশি।
এ সময়ে প্রধানমন্ত্রীর নিট সম্পদ ৯০ শতাংশ কমেছে।
আয়কর: প্রার্থীদের প্রায় সবাই আয়করের আওতামুক্ত হলেও ১২ প্রার্থীর আয়করের কাগজপত্র সুজন পায়নি। এই ৪৮ জনের মধ্যে বেশি আয়কর দিয়েছেন খন্দকার মোশাররফ হোসেন (৩০ লাখ ৮১ হাজার ১৬৭ টাকা), রুহুল হক (১২ লাখ ১৯ হাজার ৫২১ টাকা), মহীউদ্দীন খান আলমগীর (৯ লাখ ৪৯ হাজার ৭২৭ টাকা) ও মো. আবদুল হাই (৯ লাখ ১৩ হাজার ৫৫১ টাকা)।
সংবাদ সম্মেলনে শাহদীন মালিক বলেন, এসব ব্যক্তিকে রাষ্ট্র বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেয়। সংবিধানে আছে, তাঁরা ব্যবসা করতে পারবেন না বা কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে লাভ নিতে পারবেন না। তাঁদের কেউ কেউ সেই ধরনের আয় করে সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন।
সংবাদ সম্মেলনের শেষ পর্যায়ে পরিবেশ আইনবিদ সমিতির নির্বাহী প্রধান সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আইন লঙ্ঘন যাঁরা করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মতো প্রতিষ্ঠান আছে। দুদক ব্যবস্থা না নিলে ‘জনস্বার্থ’ মামলা করার সুযোগ আছে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ