বৃহস্পতিবার, ডিসেম্বর ১২, ২০২৪
প্রচ্ছদচট্রগ্রাম প্রতিদিনপাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস: অবৈধ সব সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে তাঁবুতে আনা হবে :...

পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস: অবৈধ সব সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে তাঁবুতে আনা হবে : এডিসি, বিদ্যুৎ পানি ও গ্যাস সুবিধা ছেড়ে তাঁবুতে যেতে অনীহা

hill ctgলালখানবাজার এলাকার মতিঝর্ণা লেনের সড়ক জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নেয়া হয়েছে পানির পাইপলাইন। সড়কের ধারে ও উপরে একসাথে ১০-১২টি পাইপ টাঙানো হয়েছে। এসব পাইপলাইন ঢুকেছে বিভিন্ন পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের খুপড়িঘর, বাসাবাড়ি, দালান-কোঠায়। ঝুঁকিপূর্ণ খুপড়িঘর ও বাসাবাড়িতে ঝুলছে এসব পাইপলাইন। এছাড়াও রয়েছে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ। এসব অবৈধ সুযোগ-সুবিধা পাওয়ায় মৃত্যুঝুঁকিতেও পাহাড় ছাড়ছে না ঝুঁকিতে বসবাসকারীরা। গতকাল সোমবার নগরীর খুলশী থানার মতিঝর্ণা ও বাটালি হিল এলাকা ঘুরে এমন দৃশ্য দেখা যায়।
এলাকাবাসী জানায় ওয়াসার পাইপ লাইন থেকে এসব অবৈধ সংযোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়াও বসানো হয়েছে গভীর নলকূপ। অবৈধ দখলকারীরা ঘর ভাড়া দেওয়ার লক্ষ্যে গভীর নলকূপ স্থাপন করেছে।  মতিঝর্ণা এলাকার বাচ্চু মিয়া (৪২) ভিক্ষা করে জীবনযাপন করেন। থাকেন বাটালি হিল চূড়ার কাছে। তিনি জানান, এখানে কোনো পাহাড় ধসেনি। ধসের আশঙ্কাও নেই। তিনি বলেন, গত দুই বছর নিচের অংশে ভেঙেছে। তিনি একটি খুপড়িতে বসবাস করেন। এসব কথা জানার  চেষ্টার সময় এক পর্যায়ে তিনি রেগে যান। এভাবে শুধু ভিক্ষুক বাচ্চু মিয়াই নন, শত শত লোক এখনো পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে নগরীর বাটালি হিল ও মতিঝর্ণা এলাকায় বসবাস করছেন। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে গড়ে উঠেছে এসব অবৈধ স্থাপনা।গতকাল সোমবার বিকেলে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, মতিঝর্ণা ও বাটালি হিলের পাদদেশে এখনো অবৈধভাবে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন শত শত মানুষ। গড়ে উঠছে পাকা, আধা পাকা নানা স্থাপনা ও দালান-কোঠা। এসব ঘর-বাসায় রয়েছে অবৈধ বিদ্যুৎ, পানি সংযোগ। প্রভাবশালীরা পাহাড় কেটে এসব স্থাপনা তৈরি করে ভাড়া দিয়েছেন। এছাড়াও দরিদ্র ও গরিব শ্রেণীর লোকজন ওই প্রভাবশালীদের কাছ থেকে জায়গা কিনে নিয়ে খুপড়িঘর তৈরি করে বসবাস করছেন। এজন্য প্রতি মাসে ‘মাটি ভাড়া’ (জায়গার ভাড়া) গুণতে হয়। জানা গেছে, এসব ঘরের মাসিক ভাড়া ৫ শত থেকে তিন-চার হাজার টাকা। এছাড়াও খুপড়িঘর নির্মাণের জন্য মাটি ভাড়া দিতে হয় মাসে তিন শত টাকা। তবে প্রকাশ্যে কেউ বলতে রাজি হননি।
কীভাবে গেল অবৈধ সংযোগ : এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, এসব পাহাড় দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করেছেন প্রভাবশালীরা। এছাড়াও তাদের দখলেও বিশাল পাহাড়ি এলাকা। অবৈধ দখল করেই দিনের পর দিন গড়ে তুলেছে বিশাল অবৈধ রাজত্ব। যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে, সেই সরকারের নেতা ও ক্যাডাররা পাহাড় দখল ও পাহাড় কেটে এসব ঘর নির্মাণ করে চলেছেন। সংশ্লিষ্ট বিভাগ-কর্তৃপক্ষের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বশে এনে অবৈধ বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ নিয়েছেন। এ বিষয়ে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, চট্টগ্রামে বৈধ বাসা মালিকদের বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির লাইন নিতে রীতিমতো চরম দুর্ভোগ ও গলদঘর্ম হতে হয়। আর পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় রয়েছে অবৈধ সব সংযোগ।
পুনর্বাসন : নগরীতে ১৩টি পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস চিহ্নিত করেছেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক। এতে লক্ষাধিক মানুষের বসবাস রয়েছে। বর্ষা মৌসুমে পাহাড় ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। এবার জেলা প্রশাসন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে লোকজন সরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়। এ লক্ষ্যে গত ৯ মে ঝুঁকিপূর্ণদের পুনর্বাসনের জন্য ১৩ সদস্যবিশিষ্ট ‘অস্থায়ী পুনর্বাসন ও পরিদর্শন’ নামে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়েছে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ও পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব এমএএইচ হুমায়ুন কবীরকে প্রধান করে এ কমিটি গঠন করা হয়েছে।
প্রথম দফায় পুনর্বাসন : গতকাল বিকেলে রেলওয়ে কলোনি মাঠে (দিগন্ত ক্লাব মাঠ) প্রথম দফার পুনর্বাসন কেন্দ্রে দেখা গেছে নিরবতা। অন্যান্য দিনের মতো শিশু-কিশোরদের হইচই ছিল না। বৃষ্টির কারণে তাঁবুতে অবস্থান নেন বসবাসকারীরা। সেই বাচ্চু মিয়া (৫০) এক সপ্তাহ ধরে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে তাঁবুতে অবস্থান করছেন। তাঁর স্ত্রী রিনা আকতার ভিক্ষা করে সংসার চালান। দেড় বছরের নাতি রাকিব হোসেনকে নিয়ে তাদের সংসার। বাচ্চু মিয়ার অসুস্থতার কারণে স্ত্রীও ভিক্ষা করতে বাইরে যেতে পারছেন না। তাই চুলায় রান্নাবান্না হচ্ছে না। তিনি বলেন, এক সাংবাদিক একশত টাকা দিয়েছিল। তবে এখানে চিকিৎসক দল ঔষধপত্র দিয়েছে। তিনি বরাবরের মতো বলেন, তবুও এখানে ভালো আছি। ওইখানে (পাহাড় পাদদেশে) ঝড়-বাদলের দিনে ভয়ে-আতঙ্কে দিন কাটাতাম। রাতে ঘুম হত না। বাচ্চু মিয়া ও তার স্ত্রী রিনা আকতার আকুতির সুরে বললেন, সরকার যদি কোথাও থাকার জন্য এক টুকরো জায়গা ব্যবস্থা করে তাহলে শেষ জীবনে এসে শান্তিতে মরতে পারতাম। গত ২৪ মে থেকে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে বসবাসরত লোকজনদেরকে এ মাঠে অস্থায়ী পুনর্বাসন শুরু হয়। রেলওয়ে কলোনি মাঠে তাঁবু খাটিয়ে ৯০ পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। লালখান বাজার মতিঝর্ণা ও বাটালি হিলের পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসরতদের পুনর্বাসন করা হয়।
দ্বিতীয় পর্যায়ের পুনর্বাসন : গত রবিবার ওই মাঠের পাশে পূর্ব টাইগার পাস সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে খাটানো হয়েছে ৭০টি তাঁবু। এখানে তাঁবু খাটানো হয়েছে। চলছে ড্রেন ও টয়লেট নির্মাণের কাজ। বিদ্যুৎ ও পানির ব্যবস্থা করে লোকজনকে আনা হবে।
পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সচিব ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) এ এইচ এম হুমায়ুন কবীর বলেন, বৃষ্টির কারণে কাজ করতে সমস্যা হচ্ছে। তিনি বলেন, দুই-তিন দিনের মধ্যেই পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু হবে। তিনি বলেন, এবার অবৈধ বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেই পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু করা হবে। দ্বিতীয় পুনর্বাসন কেন্দ্রেও বিদ্যুৎ, পানি, স্যানিটেশন, রান্নাঘর, চৌকি, বালতি, মগ সুবিধা দেয়া হয়েছে। থাকবে নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এছাড়াও নগরীর আকবর শাহ মাজার সংলগ্ন ব্যক্তি মালিকানাধীন মাঠ ও খুলশী বেলতলী ঘোনা খালি মাঠে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে তাঁবু খাটানোর উদ্যোগ নেয় জেলা প্রশাসন।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ