শনিবার, এপ্রিল ২৭, ২০২৪
প্রচ্ছদজাতীয়ডিএনএ আবিষ্কারের ৬০ বছর ও বাংলাদেশ

ডিএনএ আবিষ্কারের ৬০ বছর ও বাংলাদেশ

আদনান মান্নান, মুশতাক ইবনে আয়ুব, এস এম মাহবুবুর রশিদ

১৯৫৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন গবেষক জেমস ডি ওয়াটসন এবং ফ্রান্সিস ক্রিক কেমব্রিজের ‘ঈগল’ পাবে ঢুকে সোজা গেলেন তাদের জন্য নির্ধারিত টেবিলে। তারপর দুপুরের খাবার টেবিলে বসে পরিচিত জনদের মনোযোগ কেড়ে নিয়ে ফ্রান্সিস ক্রিক ঘোষণা করলেন- “জেন্টলম্যান, উই হ্যাভ ডিসকভারড দ্য সিক্রেট অব লাইফ”। বিজ্ঞানের প্রায় সব শাখায় কিছু আবিষ্কার এমন যে, সেগুলো নিজ নিজ বিষয়ের সীমা ছাড়িয়ে প্রভাব ছড়িয়েছে জ্ঞানের সব শাখায়। জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এ মাত্রার আবিষ্কারগুলোর শীর্ষস্থানটি নিঃসন্দেহে দখল করে আছে ‘সিক্রেট অব লাইফ’ খ্যাত ডিএনএ। আবিষ্কারের পর থেকেই বিজ্ঞান, দর্শন এবং কলা ইত্যাদি সবগুলো ক্ষেত্রকে সমানভাবে আলোড়িত করেছে ডিএনএ। জীবনের নানান ক্ষেত্রকে এমন বহুমুখী সমৃদ্ধি দেওয়ার ক্ষেত্রে এককভাবে এত বড় ভূমিকা রাখতে পারে নি আর কোন অণু। সঙ্গতকারণেই ডিএনএ তাই পৃথিবীর সবচেয়ে পরিচিত অণু। এ বছর বিশ্বজুড়ে উদযাপিত হচ্ছে ডিএনএর গঠন আবিষ্কারের ৬০ বছর। কিন্তু এই আবিষ্কারের সুফল কতটুকু গ্রহণ করছে বাংলাদেশ?

ডিএনএর গঠন আবিষ্কারের পরপরই এর ব্যবহারিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক সম্ভাবনা তৈরি হয়। বলাবাহুল্য উন্নত বিশ্ব সে বিপ্লবের পথে যাত্রায় কোন সময়ক্ষেপণ করে নি। একের পর এক বিস্ময়কর আবিষ্কার সংঘটিত হয়েছে ডিএনএকে ঘিরে। এর পরিবর্তন, পরিমার্জনের মধ্য দিয়ে জীবনের রহস্য উদঘাটনে বিজ্ঞানের চিরন্তন অভিযাত্রায় অভিনব গতি সঞ্চার হয়েছে। তৈরি হয়েছে বিজ্ঞানের নতুন নতুন শাখা। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বিকশিত বিষয় নিঃসন্দেহে জিন প্রকৌশল এবং আধুনিক জীবপ্রযুক্তি যা বর্তমান বিশ্বে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এ্যান্ড বায়োটেকনোলজি নামে অভিহিত। ডিএনএ কথাটির পূর্ণ রূপ হচ্ছে Ñ ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিয়িক এসিড। কোষে দুটো রাসায়নিক সূত্র সিড়ির রেলিং-এর মতো পেঁচিয়ে তৈরি হয় একটি ডিএনএ অণু। সকল জীবিত কোষেই থাকে ডিএনএ যা জীবের বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণ করে। ডিএনএর কার্যিক একককে বলা হয় জিন। সুতরাং জিন আসলে ডিএনএরই অংশ। ১৯৫৩ সালে ডিএনএর এই গঠন আবিষ্কারের পর থেকে জিন সম্পর্কিত ধারণার বিকাশ ঘটতে থাকে। এর ভিত্তিতে জিনকে পরিবর্তন বা পরিমার্জন করে জীবের বৈশিষ্ট্যে পরিবর্তন আনার কাজ শুরু হয় গত শতকের সত্তরের দশকে। সে সময় থেকেই জিন প্রকৌশল এবং আধুনিক জীবপ্রযুক্তির যাত্রা শুরু। বর্তমানে কৃষি, স্বাস্থ্য, পরিবেশ সবক্ষেত্রে নতুন নতুন উদ্ভাবনে পৃথিবীকে এক নতুন স্বপ্নের মহাসড়কে হাজির করেছে জিন প্রকৌশল এবং জীবপ্রযুক্তি। মাত্র কয়েক দশক আগেও এটা ছিলো মানুষের কল্পনার অতীত।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০০১-২০১০ এই দশ বছরে বেসরকারি খাতে প্রায় ৩০ লক্ষ লোক চাকুরি হারিয়েছিল, কিন্তু তখন জীবপ্রযুক্তি ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক বিস্তার ঘটায় প্রায় ১ লক্ষ লোকের নতুন কর্মসংস্থান হয়। মার্কিন অর্থনীতির উপর ভিত্তি করে তৈরি বায়োইকোনমি আপডেট অনুসারে ২০১০ সালে শুধুমাত্র জিএম শস্য থেকে আসা রেভিনিউ এর পরিমাণ প্রায় ১১০ বিলিয়ন ডলার। জীবপ্রযুক্তিভিত্তিক চিকিৎসা পণ্য (৭৫ বিলিয়ন ডলার) ও শিল্পজাত পণ্য (১১৫ বিলিয়ন ডলার) থেকে আসা আয়সহ জীবপ্রযুক্তিভিত্তিক পণ্য থেকে আসা মোট রাজস্বের পরিমাণ প্রায় ৩০০ বিলিয়ন ডলার, যা যুক্তরাষ্ট্রের মোট জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ। এতো গেল উন্নত দেশ যুক্তরাষ্ট্রের কথা। প্রতিবেশী এশীয় দেশ মালয়েশিয়ায় ২০০৫ সালের আগে কোন প্রকার জীবপ্রযুক্তি ব্যবহারের উদাহরণ ছিল না। ২০০৫ সালে তারা সরকারিভাবে ন্যাশনাল বায়োটেকনোলজি পলিসি প্রণয়নের পর ২০১২ সালে মাত্র সাত বছরের মাথায় জীবপ্রযুক্তিভিত্তিক এই খাতে প্রায় ৫৫০০০ লোকের কর্মসংস্থান হয়। আর এ খাতে আয় হয় প্রায় সাড়ে ১৩ বিলিয়ন মালয়েশিয়ান মদ্রা। এটি দেশটির মোট জিডিপির প্রায় ২.২ শতাংশ (সূত্র: মালয়েশিয়ান বায়োটেকনোলজি কর্পোরেশন)। আর ঘরের পাশের দেশ ভারত জীবপ্রযুক্তি ব্যবহার করে পণ্য উৎপাদন করে ২০১১ সালে আয় করে ৪ বিলিয়ন ডলার (সূত্র: দৈনিক দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস)। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে যখন  এ সকল খবর আমাদের দোড়গোড়ায় তখন প্রশ্ন উঠতেই পারে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়?
এ প্রশ্নের উত্তরে খুব আশাব্যঞ্জক চিত্র আঁকা যাবে না। যদিও সময় একেবারেই চলে যায় নি। তবে খুব বেশিদিন অপেক্ষারও সুযোগ নেই।
নতুন প্রজাতির উন্নত উদ্ভিদ বা ফসল উদ্ভাবন করতে চাইলে প্রয়োজন ডিএনএ ও জিন নিয়ে গবেষণা, নানান রোগ নির্ণয়ে প্রয়োজন ডিএনএর বিশেষ পরিবর্তনকে চিহ্নিত করা। ক্রমবর্ধমান জ্বালানি সংকট মোকাবেলায় বিকল্প সমাধান হতে পারে জিন প্রকৌশল তথা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মাধ্যমে জীবকোষ থেকে জ্বালানির রসদ তৈরি। খাদ্যের গুণগত মান বৃদ্ধি ও স্বাদ পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন এনজাইম নামের বিশেষ কোষ-নিঃসৃত পদার্থ তৈরি, বস্ত্র শিল্পে রাসায়নিক রঙ ব্যবহারের জটিলতা দূর করতে কিংবা চামড়া প্রক্রিয়াজাত কারখানায় দূষণ প্রতিরোধ করতে প্রয়োজন ক্ষুদ্র অণুজীবকে জীবপ্রযুক্তির মাধ্যমে ব্যবহার করা। খুব সাধারণ একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে এখানে। বিদেশে রপ্তানিকৃত চিংড়ি ফেরত আসার দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা অহরহ ঘটে আমাদের দেশে। কিন্তু চিংড়ির সাধারণ ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএ পরীক্ষার উপযোগী ল্যাবরেটরি স্থাপন করলে মাছ রপ্তানির আগেই জানা যেত তার গুণগত মান। আমাদের দেশে জীবপ্রযুক্তি বিষয়ে পাশ করা শিক্ষার্থীদের পক্ষেই এ ধরনের টেস্ট করা সম্ভব। এমন আরো অনেক ক্ষেত্র আছে যেখানে বায়োটেকনোলজি ব্যবহার করা যায়।
প্যাটেন্ট তথা মেধাস্বত্বের আওতায় পৃথিবীর অধিকাংশ প্রাণি ও উদ্ভিদ বিভিন্ন দেশের অধিকারে চলে যাচ্ছে। শুধুমাত্র ডিএনএ-র সিকুয়েন্স উন্মোচন করে কিংবা ডিএনএ বারকোডিং পদ্ধতিতে বিভিন্ন জীবের গঠনগত প্রকৃতি দেখিয়েই অনেক দেশ এগুলো তাদের অধিকারভুক্ত করে ফেলছে। কিন্তু আমাদের দেশে এ নিয়ে কোন চিন্তাভাবনাই নেই। পাট ছাড়া অন্য কোন ক্ষেত্রে আমরা এই উদ্যোগ দেখিনি।

এ বছরের শুরুর দিকে ফোর্বস ম্যাগাজিনের এক জরিপে দেখানো হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে এই মুহূর্তে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হল জীবপ্রযুক্তি বিষয়ক চাকুরি। বিশেষত ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো কর্মক্ষেত্র বিস্তারে জীবপ্রযুক্তিকে অন্যতম প্রধান অবলম্বন হিসেবে নিয়েছে। অথচ আমাদের দেশে এ নিয়ে তেমন সচেতনতা গড়ে ওঠেনি। দেশের ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠানগুলোতে ফার্মাসিস্টের পাশাপাশি মাইক্রোবায়োলজিস্ট, কেমিস্ট, অনেক ক্ষেত্রে বায়োকেমিস্ট এর পদ থাকলেও বায়টেকনোলজিস্ট এর কোন পদ নেই। এ কথা সত্য যে বাংলাদেশের প্রায় সব প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন জীবপ্রযুক্তি বিষয়ক বিভাগ আছে। সেসব বিভাগ থেকে প্রতিবছর প্রায় পাঁচ শতাধিক স্নাতক  বের হচ্ছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে দক্ষ জীবপ্রযুক্তিবিদ হিসেবে তাদেরকে কাজে লাগানোর পরিকল্পনা এবং উদ্যোগ কোনটাই নেই  না বিশ্ববিদ্যালয়ে না সরকারি নীতি নির্ধারক পর্যায়ে। এ কারণে জীবপ্রযুক্তি বিষয়ে পড়াশুনা করে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই হয় পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশে অথবা দেশের ভেতরে অন্য পেশায় অংশ নিতে বাধ্য হচ্ছে। বলাবাহুল্য যারা বাইরে যাচ্ছে তারা দেশের অনিশ্চিত বাস্তবতায় ফিরতে খুব একটা উৎসাহ বোধ করছে না।
আমরা মনে করি জীবপ্রযুক্তি বিষয়ক গবেষণা এবং ব্যবসাকে উৎসাহিত করার এটাই সময়। এ বিষয়ে সরকারি বেসরকারি উভয় ধরনের উদ্যোগ দরকার।

(লেখকবৃন্দ চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের তরুণ শিক্ষক)

আরও পড়ুন

সর্বশেষ