বুধবার, ডিসেম্বর ১১, ২০২৪
প্রচ্ছদফিচারএস আলমের সমর্থনে চট্টগ্রামের মানুষ রাস্তায় নামতে পারে

এস আলমের সমর্থনে চট্টগ্রামের মানুষ রাস্তায় নামতে পারে

সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হয়েছে, চট্টগ্রামের এস আলম শিল্পগোষ্ঠী। এস আলমের স্বত্ত¡াধিকারী সাইফুল আলম মাসুদ, তাঁর স্ত্রী এবং শিল্পগোষ্ঠীর পরিচালক পদে অধিষ্ঠিত তাঁর ভাইদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। তাঁদের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, এস আলমের ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার বিক্রি করে দেওয়ার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এস আলম প্রায় ৪৩টি শিল্প-কারখানার মালিক।

দেশের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে এস আলমের নিয়োগকৃত অফিসার ও কর্মচারীদের যেভাবে গণহারে ছাঁটাই করা হচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে ইউনূস সরকার যেন এস আলমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। যেন আওয়ামী লীগের চেয়েও সরকারের বড় শত্রæ এস আলম। এস আলমের নামগন্ধ যেখানে পাওয়া যাচ্ছে সেখানেই সরকার তড়িঘড়ি করে এ্যাকশনে যাচ্ছে।
চলতি বছরের মার্চ ও এপ্রিল মাসে নিয়োগপ্রাপ্ত অফিসারদের ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গেøাবাল ইসলামী ব্যাংক এবং ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে চাকরিচ্যুত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। পটিয়া, কর্ণফুলী, আনোয়ারা, বাঁশখালী, বোয়ালখালী, চন্দনাইশ, হাটহাজারী, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া ও চট্টগ্রাম শহর এলাকা থেকে তাঁদেরকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিলো। ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রায় ৫০০ জনের নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। গত ৮ সেপ্টেম্বর তাদের চাকরিতে যোগদানের কথা ছিলো। ৩১ অক্টোবর সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক থেকে ৬৭২ জনকে টার্মিনেট করা হয়েছে। ১৮ নভেম্বর ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে ২৬২ জনকে টার্মিনেট করা হয়েছে। গেøাবাল ইসলামী ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকে ২০২৪ সালে নিয়োগপ্রাপ্তদের টার্মিনেট করা হতে পারে চলতি মাসের শেষে; এই ব্যাংকগুলি এস আলমের মালিকানাধীন। এস আলমের শেয়ার আছে এ রকম একটি ব্যাংক হলো কমার্স ব্যাংক। এ ব্যাংক থেকেও অনেক কর্মকর্তাকে ছাঁটাই করা হবে বলে শোনা যাচ্ছে।
অফিসার ছাড়াও উপর্যুক্ত ব্যাংকগুলিতে এস আলম চলতি সালের মার্চ ও এপ্রিল মাসে অফিসার এটেন্ডেন্ট (পিয়ন) হিসেবে সহ¯্রাধিক লোককে চাকরি দিয়েছিলো। তাদের উপরে যদিও এখনও হাত দেওয়া হয়নি, তবে তাদের চাকরিও কতদিন থাকে ঠিক নাই।
এস আলম রাজনীতি করেন না, কোন দলের সাধারণ সদস্যও নন, একটু একটু করে ব্যবসা করে নিজের শ্রম, মেধা খাটিয়ে একেবারে শূন্য অবস্থা থেকে যে মানুষটি দেশের বৃহৎ শিল্পপতিদের কাতারে নিজেকে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছেন, তাঁকে শেষ করে ফেলাই যেন বর্তমান সরকারের একমাত্র কাজ। এস আলম কী এত বড় হয়ে গেছে যে, শুধু একটি শিল্পগোষ্ঠীকে খতম করার জন্য গোটা রাষ্ট্র, সরকার তার পেছনে লেগে গেছে। আওয়ামী লীগের ওপর সরকারের আক্রোশের কারণ বুঝতে আমাদের কষ্ট হয় না। আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়েই বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় বসানো হয়েছে। সেজন্য আওয়ামী লীগের ওপর সরকারের আক্রোশ বেশি হবে স্বাভাবিক। কিন্তু এস আলম তো আওয়ামী লীগ দূর, কোন রাজনীতিই তো তিনি কখনো করেননি। আওয়ামী লীগ মধ্যপন্থী দল, সাইফুল আলম মাসুদ চিন্তা চেতনায় দক্ষিণপন্থার অনুসারী। সুতরাং আওয়ামী লীগ ব্রান্ডেড করে এস আলমকে যদি শাস্তি দেওয়া হয়ে থাকে, সেটা হবে মারাত্মক ভুল।
এস আলমের সমর্থনে চট্টগ্রামের মানুষ রাস্তায় নামতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ চট্টগ্রামের প্রায় ২০ হাজার মানুষকে এস আলমের মাসুদ সাহেব তার মালিকানাধীন ব্যাংককে চাকরি দিয়েছিলেন। তাদেরকে ইউনূস সরকার চাকরিচ্যুত করে পথে বসিয়ে দিচ্ছে। এস আলম দয়া করে তাদের যে চাকরিটা দিয়েছিলো, সে চাকরির টাকায় তারা ইতিমধ্যে ঘর সংসার গুছিয়ে নিয়েছিলেন। মাতাপিতার মুখে হাসি ফুটেছিলো। অনেকে বিয়ে করে নতুন সংসারও পেতেছে। উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন সেই চাকরিটা চলে যাওয়ায় তাদের মাথায় বাজ পড়েছে।
তারা কারো ভাই, কারো বোন, কারো ছেলে, কারো মেয়ে। এখন বেকার হয়ে হওয়ার পর তারা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বনটি হারিয়ে পথে বসার পর তারা এস আলমের ব্যাংক, ব্যবসা-বাণিজ্য রক্ষার জন্য রাস্তায় নামার চিন্তা করছে। কারণ এস আলম তাদের চাকরিদাতা, অন্নদাতা, এস আলম বাঁচলে তাঁদেরও বেচে থাকার উপায় হবে। চাকরিচ্যুত অফিসার এবং তাঁদের আত্মীয়-স্বজনরা এক অপরের সাথে যোগাযোগ এবং মতবিনিময় করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছেন। ‘এস আলম সমর্থক গোষ্ঠী’ বা ‘এস আলম সুহৃদ সংঘ’ এ ধরণের নামের কোন সংগঠন প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় তারা অনেকদূর এগিয়ে গেছেন। কাঠামোগত প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে তারা রাজপথে নামবেন; সমাবেশ, মিছিল, মানববন্ধন করবেন, স্মারকলিপি দেবেন।
এস আলমের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন জেলায় যাদের পোস্টিং হয়েছিলো, চট্টগ্রামের মানুষ বলে তারা সেখানে চাকরি করতে পারেনি। তাদের বক্তব্য চট্টগ্রামেও অন্যান্য জেলার মানুষ চাকরি করে। বন্দর, কাস্টম, রেলওয়ে সহ আরো নানা প্রতিষ্ঠানে তারা চাকরি করছে। চট্টগ্রামের মানুষ নয় বলে চট্টগ্রামে তাদের চাকরি করা নিয়ে কেউ কখনো প্রশ্ন তোলেনি। তাহলে অন্য জেলায় চট্টগ্রামের মানুষ চাকরি করতে গেলে সেখানকার মানুষ তাদেরকে বাঁকা চোখে দেখবে কেন ?
এস আলমের মিলে উৎপাদিত চিনি ও তেল বিক্রি করে ২৬ হাজার কোটি টাকা জমা হয়েছে। সেগুলি ব্যাংকে জমা করলেও ব্যাংকের নগদ তহবিল সংকট অনেকটা কেটে যেত।
অন্যান্য শিল্পগোষ্ঠী যাঁরা হয়রানির শিকার হয়েছে, তারা হচ্ছেÑবেক্সিমকো গ্রæপ, বসুন্ধরা গ্রæপ, সিটি গ্রæপ, সামিট গ্রæপ, মেঘনা গ্রæপ প্রভৃতি।
বেক্সিমকো গ্রæপের অধীনে ২৫ শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস ছাড়া বেক্সিমকোর অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠানে রিসিভার নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বেক্সিমকো সোহেল এফ রহমান ও সালমান এফ রহমান দু’ভাইয়ের যৌথ মালিকানাধীন শিল্পগোষ্ঠী। সালমান রহমান শেখ হাসিনার উপদেষ্টা ছিলেন, এ কারণে তিনি সরকারের রোষানলের শিকার হয়েছেন। সেজন্য সরকার দু’ভাইয়ের যৌথ মালিকানাধীন শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলি জব্দ করে নিজের এখতিয়ারে নিতে পারে না। সালমান রহমানরা ঢাকার দোহারের একটি প্রাচীন অভিজাত বংশের গর্বিত উত্তর পুরুষ। তাঁদের পিতা ফজলুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম মন্ত্রিসভার শিক্ষা মন্ত্রী ছিলেন। তিনি একজন বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান এবং রাজনীতিবিদ। বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা সালমান রহমানের ভ্রাতুষ্পুত্র।
দেশের অন্যতম শীর্ষ ধনী ও শীর্ষস্থানীয় শিল্পপতি আহমদ আকবর সোবহান ওরফে শাহ আলম সাহেবের প্রতিষ্ঠিত বসুন্ধরা শিল্পগোষ্ঠীর অধীনে ৩০টির অধিক শিল্প-কারখানা রয়েছে। ওয়ান ইলেভেনের সময়ও শাহ আলম সাহেবের উপর কোপ পড়েছিলো। সে সময় তিনি আত্মগোপন করে তাঁর মান-সম্মান রক্ষা করেছিলেন। ওয়ান ইলেভেনের পর তিনি দেশে ফিরে এসে অনেকগুলি শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠা করে দেশকে নানাদিক থেকে উৎপাদনে আত্মনির্ভরশীল করে তোলেন। তিনি দেশের অন্যতম পথিকৃৎ আবাসন ব্যবসায়ী। সিমেন্ট, নিউজপ্রিন্ট, টিস্যু, ফুড এন্ড বেভারেজ, শিপিং লজিস্টিক্স, টেকনোলজিস, এলপি গ্যাস, স্টিল, শপিং মল, ক্রীড়া, মিডিয়া ইত্যাদি বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করে বসুন্ধরা দেশের শীর্ষস্থানীয় বিজনেস কংলোমারেট হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। কর্পোরেট সামাজিক দায়িত্ব পালনের জন্য বসুন্ধরা সামাজিক ফাউন্ডেশন, বসুন্ধরা টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট (বিটিআই), বসুন্ধরা আদ দিন হাসপাতাল ও বসুন্ধরা চক্ষু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছে। দেশের খেলাধুলার উন্নয়নের জন্য বসুন্ধরার অবদান সর্বাধিক। বসুন্ধরার মালিকানাধীন ফুটবল ক্লাব বসুন্ধরা কিংস দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করে দেশের জন্য সুনাম বয়ে আনছে। এছাড়া বসুন্ধরা বিপিএলএ রংপুর রাইডার্স, শেখ জামাল ধানমÐি ক্লাব, শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র পরিচালনা করে। টি স্পোর্টস নামে দেশি-বিদেশি খেলাধুলার লাইভ টেলিকাস্টের জন্য একটি টিভি চ্যানেলও প্রতিষ্ঠা করেছে। মিডিয়ায় বসুন্ধরার মালিকানাধীন দুটি বাংলা পত্রিকা, একটি ইংরেজি, ১টি টিভি চ্যানেল- নিউজ টুয়েন্টি ফোর এবং ১টি অনলাইন পত্রিকা-বাংলানিউজ২৪.কম ও রেডিও ক্যাপিটাল নামে একটি কমিউনিটি রেডিও চালায়।

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী, সম্পাদক ও প্রকাশক, মুক্তি ৭১ ও প্রবীণ সাংবাদিক

আরও পড়ুন

সর্বশেষ