বুধবার, ডিসেম্বর ১১, ২০২৪
প্রচ্ছদফিচারইউরোপের পরিবেশ রক্ষায় আমাদের আত্মাহুতি : ফারুক মঈনউদ্দীন

ইউরোপের পরিবেশ রক্ষায় আমাদের আত্মাহুতি : ফারুক মঈনউদ্দীন

অতি সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে একটা ‘সুখবর’ অত্যন্ত গুরুত্ব ও গর্বের সঙ্গে প্রচারিত হচ্ছে যে বাগেরহাটে তৈরি কাঠের ঘর যাচ্ছে ইউরোপের বেলজিয়ামে। ‘পরিবেশবান্ধব’ ও দৃষ্টিনন্দন এসব কাঠের ঘরের চাহিদা বাড়ছে ইউরোপে। সেই চাহিদা মেটানোর সুযোগ পেয়েছে বাংলাদেশের একটি প্রতিষ্ঠান।

জানা গেছে, ব্রিটেন, ভিয়েতনামসহ আরও কিছু দেশের সঙ্গে দরপত্রে অংশ নিয়ে এই কাজ পেয়েছে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানটি। বাংলাদেশের নিজস্ব সামগ্রী ব্যবহার করে দেশীয় কারিগরদের হাতে তৈরি কাঠের ঘর রপ্তানি হবে ইউরোপে, সেই ঘর ইউরোপের একটি দেশের নির্দিষ্ট জায়গায় বসিয়ে দিয়ে আসবেন আমাদের কারিগরেরাই—এটা আত্মতৃপ্তি লাভ করার মতো একটা অর্জন বটে।
খবরের এই পর্যন্ত পড়ে যেকোনো সরলমনা পাঠক দেশের রপ্তানি বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে ভেবে আত্মতৃপ্ত হবেন। এসব খবরে বলা হচ্ছে, ‘পরিবেশবান্ধব’ ঘরগুলো রপ্তানির মাধ্যমে নতুন বাজার সৃষ্টি ও কর্মসংস্থান তৈরি হবে এবং উন্মোচিত হবে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের নতুন পথ। খবরের বয়ানে মনে হচ্ছে, এই উদ্যোগটা আমাদের দেশের জন্যই ‘পরিবেশবান্ধব’ হবে। তাই এ কাজে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ার প্রত্যাশাও করছেন এই উদ্যোক্তা।
উদ্যোক্তারা যে কয়েকটি বিষয় তুলে ধরে ‘খুশি’ হচ্ছেন, সেটি হচ্ছে তাঁদের ভাষায় ‘জলবায়ু পরিবর্তন রোধে ভিন্নভাবে কাজ করা,’ বাংলাদেশের অজপাড়াগাঁয়ের কারিগরদের ইউরোপে যাওয়ার সুযোগ পাওয়া, উপকরণগুলো বায়োডিগ্রেডেবল বলে ‘পরিবেশবান্ধব’, নারী-পুরুষ মিলিয়ে গ্রামীণ মানুষের কর্মসংস্থান এবং সর্বোপরি দেশের জন্য বিদেশি মুদ্রা আয়—ইত্যাদি। ঠিক এখানে এসেই ‘খুশি’ না হয়ে দ্বিতীয়বার চিন্তা করতে হয় একজন পরিবেশসচেতন মানুষকে। ইউরোপে তাদের পরিবেশবান্ধব ঘর পাঠিয়ে সেসব দেশের পরিবেশ রক্ষায় আমাদের ক্রমহ্রাসমান বৃক্ষ সম্পদ কেন ব্যবহার করতে হবে?
বিশ্বের অষ্টম ঘন জনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে বিরূপ পরিবেশের লক্ষণ যেখানে ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে, সেখানে দেশের বৃক্ষনিধন করে ইউরোপকে পরিবেশবান্ধব করার এই দায়িত্ব গ্রহণ করা কতখানি যৌক্তিক? আরও কয়েকটি দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে এই আত্মবিধ্বংসী কাজটি আমরা পেয়েছি বলে কারোরই আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোনো কারণ নেই। আমাদের সস্তা শ্রম এবং বিকল্প কর্মসংস্থানের অভাবের কারণেই অন্য দেশের চেয়ে কম মূল্য দেখিয়ে প্রতিযোগিতায় টিকে গেছি আমরা।
জানা যায়, একসময় ক্রোয়েশিয়া, বুলগেরিয়াসহ আরও কিছু দেশ কাঠের ঘর রপ্তানি করত। কিন্তু এখন তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হয়ে গেছে বলে নিজেদের বনজ সম্পদ উজাড় করার কাজটি বন্ধ করে দিয়েছে তারা। তাই ইউরোপকে পরিবেশবান্ধব করার দায়িত্ব পড়েছে বাংলাদেশের ওপর। অবশ্য লিথুয়ানিয়া, এস্তোনিয়ার মতো দেশগুলো এখনো কাঠের ঘর রপ্তানি করে যাচ্ছে ইউরোপের অন্যান্য দেশে।
আমরা যদি কাঠের ঘর রপ্তানিকারক দেশগুলোর বনজ সম্পদের সঙ্গে আমাদের তুলনা করি, তাহলে দেখতে পাই ক্রোয়েশিয়ার বনভূমি দেশটির আয়তনের ৩৪ শতাংশ আর বুলগেরিয়ার ৩৬ শতাংশ। লিথুয়ানিয়ায় এই হার ৩৪ এবং এস্তোনিয়ায় ৫২ শতাংশ। অথচ বাংলাদেশের আয়তনের মাত্র ১৬ শতাংশ বনভূমি (বাস্তবে আরও কম হতে পারে)।
আমাদের এই নগণ্য পরিমাণ বনভূমিও ক্রমে কমে যাচ্ছে অবৈধ গাছ কাটা, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও বসতি স্থাপন, শিল্পায়ন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং বাণিজ্যিক বনায়নের কারণে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে বনজ সম্পদের অতিরিক্ত বাণিজ্যিক ব্যবহারের ফলে দেশে কাঠ, জ্বালানি কাঠ, বাঁশ, বেত, এমনকি পশুখাদ্যেরও ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
বৈশ্বিক বনভূমি নিয়ে গবেষণা করা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে বাংলাদেশে ২০ লাখ হেক্টরের বেশি প্রাকৃতিক বনভূমি ছিল, তার মধ্য থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে আমরা হারিয়েছি প্রায় ১৮ হাজার হেক্টর। অন্য এক হিসাবে দেখা যায়, প্রতিবছর দেশের ৮ হাজার হেক্টর বনভূমি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এভাবে বনভূমির বিনাশই কেবল ঘটেনি, প্রাকৃতিক অরণ্যকে সংকুচিত করে লাগানো হচ্ছে ইউক্যালিপটাস, একাশিয়া জাতের পরিবেশবান্ধব নয় এমন ভিনদেশি গাছ।
বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠানের (স্পারসো) তথ্যমতে, ১৯৭৩ সালে মধুপুর জঙ্গলে শালবন ছিল প্রায় ৯ হাজার ৭০০ হেক্টর ভূমিতে। ২০১৫ সালে শালবন সংকুচিত হয়ে গেছে ২ হাজার ৭০০ হেক্টরে, অর্থাৎ মাত্র ২৭ শতাংশ জায়গায়। বাকি ৭ হাজার হেক্টরে লাগানো হয়েছে একাশিয়া, রাবার, আনারস, কলা, পেঁপে, লেবু, হলুদ ও অন্যান্য মসলার গাছ। বনভূমি উজাড় করে এমন কৃত্রিম বনায়ন ইকোসিস্টেমের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে। কয়েক দশক ধরে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করে পরিবেশ রক্ষা এবং দারিদ্র্য দূরীকরণের বিভিন্ন প্রকল্পে কিছু বৃক্ষরোপণ হয়েছে বটে, তবে তা প্রাকৃতিক বন ধ্বংসের তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল।
বৃক্ষনিধন ও বন উজাড়ের এই মহোৎসবে যুক্ত হয়েছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে বেড়ে চলা শিমুল আলু নামে পরিচিত কাসাভার চাষ। পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলোতে কাসাভা চাষের জন্য শত শত একর বনভূমি উজাড় করে বাড়ানো হচ্ছে চাষের জমি। বিশেষজ্ঞদের মতে, বন কেটে কন্দজাতীয় এই ফসল চাষের ফলে মাটি ক্ষয় হতে থাকে, যার অনিবার্য পরিণাম ভূমিধস, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেড়ে চলেছে।
তার সঙ্গে কমে যাচ্ছে বিভিন্ন বন্য প্রাণী, পাখি, পোকামাকড় ও সরীসৃপের আবাসস্থল। ফলে পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য এবং পার্বত্য অঞ্চলের বনাঞ্চল মারাত্মক হুমকির মধ্যে পড়বে। ইতিমধ্যে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করতে প্রায় ৬৭ কিলোমিটার পাহাড়ি এলাকার সংরক্ষিত বনভূমির ১০২ প্রজাতির পাঁচ লাখের বেশি গাছ কাটা হয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে ৩ লাখ সাধারণ গাছ ছাড়াও ঔষধি বৃক্ষ, ফলদ ও বনজ গাছ। বন ধ্বংসের এই মহোৎসব অজস্র দৃষ্টান্তের একটি মাত্র।
এ রকম যখন আমাদের বাস্তব পরিস্থিতি, তখন ইউরোপে ‘পরিবেশবান্ধব’ কাঠের ঘর রপ্তানির মাধ্যমে আমাদের দেশের পরিবেশের যে ক্ষতি হবে সে, বিবেচনা এখনো কারও মধ্যে দেখা যায়নি। এ রকম অবিমৃশ্যকারী কাজকে উৎসাহ দেওয়ার ঘটা দেখে বিশ্বাস করার সংগত কারণ রয়েছে যে আমাদের দেশে পরিবেশসচেতন মানুষের সংখ্যা খুব বেশি নয়।

লেখক : ফারুক মঈনউদ্দীন, লেখক ও ব্যাংকার

আরও পড়ুন

সর্বশেষ