মঙ্গলবার, এপ্রিল ৩০, ২০২৪
প্রচ্ছদফিচারদুর্যোগ মোকাবেলায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে

দুর্যোগ মোকাবেলায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে

আমাদের দেশ ঝুঁকিপ্রবণ। ঝুঁকির দিক থেকে বাংলাদেশের স্থান বিশ্বে পঞ্চম। দেশের সব অঞ্চল কোনো না কোনো ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। দুর্যোগে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বলতে কেবল ত্রাণ তৎপরতাকে বোঝানো হতো। আশির দশকের পর থেকে এ ধারণার পরিবর্তন হয়েছে। বেশি জনসংখ্যার ঘনত্বের জন্য ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। ছোট একটি ভূখণ্ডে ১৬ কোটি মানুষের বাস। বাধ্য হয়ে মানুষ উপকূল, শহরের বস্তিসহ বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বাস করে। যথেষ্ট অর্থনৈতিক সক্ষমতা থাকলে দ্রুত ঝুঁকি মোকাবিলা করতে সহজ হতো। বঙ্গোপসাগর ও হিমালয়ের মাঝখানে আমরা আছি। সাগরের পানি কিছুটা বৃদ্ধি পেলে দক্ষিণাঞ্চলের নদীগুলোর লবণাক্ততা বৃদ্ধি পায়। উন্নয়ন নীতিতে দীর্ঘমেয়াদি সুবিধার কথা ভাবতে হবে। কেবল স্বল্পমেয়াদি সুবিধার কথা ভাবা হয়। ফলে অনেক সময় সুবিধার লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না। ১৯৯৮ সালে বন্যার স্থায়িত্ব ছিল ৬৮ দিন।

বাংলাদেশের রাস্তাগুলো পানি চলাচলের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ হচ্ছে। গ্রাম থেকে বেশি পরিমাণে মানুষ শহরে আসছে। দুটোই জীবনের ঝুঁকি তৈরি করছে। এখন ৩০ শতাংশ মানুষ শহরে বাস করে। ২০৫০ সালের আগেই ৫০ শতাংশ মানুষ শহরে বাস করবে। এ ক্ষেত্রে আগুন, ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড় যেকোনো ধরনের দুর্যোগে ব্যাপক প্রাণহানি হবে। সাইক্লোন মোকাবিলায় কিছুটা অগ্রগতি হলেও বন্যা মোকাবিলায় যথেষ্ট অগ্রগতি হয়নি। দুর্যোগের একটি বড় কারণ হচ্ছে আবহাওয়ার পরিবর্তন। আমাদের খাদ্যের প্রধান উৎস কৃষি। আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে কৃষি, পশুপালন, মৎস্যচাষ সবকিছুর ব্যাপক ক্ষতি হবে। ফলে বেকার সমস্যা তীব্রতর হবে। তীব্র লবণাক্ততার জন্য এক হাজার কিলোমিটার উপকূলীয় অঞ্চলে ভয়াবহ পানিসংকট তৈরি হয়েছে। এ অঞ্চলের কৃষি, পশুপালন, মাছ চাষ সবকিছু বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। শহরে ভবনধস ও অগ্নিকাণ্ডের পরিমাণ বাড়ছে। অবস্থানগত কারণে পানি আমাদের সমস্যায় ফেলছে।

বেশি পানি, কম পানি, অসময়ে পানি সবই সমস্যা তৈরি করছে। ১৯৭১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের মোট ৪৪০টি দুর্যোগ হয়। এতে দেশের ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি হয়। মোট আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৫৪০ কোটি ৩৮ লাখ ২ হাজার মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ। প্রাণহানি হয় দুই লাখ ৪৩ হাজার ৮৪ জনের। দুর্যোগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আতঙ্কের বিষয় হলো ভূমিকম্প। ৭ মাত্রার বেশি তীব্র ভূমিকম্প হলে বড় শহরগুলোতে ব্যাপক মানুষের মৃত্যু ও ভবনধস হবে। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে না ভাবলে বিপর্যয়ে পড়ব, যা থেকে উদ্ধার পাওয়া কষ্টকর হবে।

উপকূলীয় অঞ্চলে এখন ছয়টি কমিউনিটি রেডিও কাজ করছে। ২০১৩ সালে মহাসেন হয়েছিল। মহাসেনে কমিউনিটি রেডিওর কার্যকারিতা লক্ষ করেছি। দুর্যোগে উপকূলীয় অঞ্চল বিদ্যুৎবিহীন ছিল। আধুনিক প্রযুক্তি কাজ করছিল না। একনাগাড়ে ৫১৪ ঘণ্টা কমিউনিটি রেডিও কাজ করেছে। তাই নীতিনির্ধারকদের বলব নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে পুরোনো প্রযুক্তিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। ক্যাটরিনায় আমেরিকাও একই ভুল করেছিল। ক্যাটরিনার ভয়াবহতায় আধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগাতে পারেনি। তখন তারা পুরোনো প্রযুক্তি ফিরিয়ে আনে। এ বিষয়ে বেশি করে আলোচনা হওয়া দরকার। তাহলে অনেক বিষয় বেরিয়ে আসবে। উপকূলীয় অঞ্চলে সিপিপি (সাইক্লোন প্রিপিয়ার্ডনেস প্রোগ্রাম) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এখান থেকে গণমাধ্যম অনেক তথ্য পেয়ে থাকে। সিপিপি আরও বেশি কার্যকর রাখার ব্যাপারে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।

দুভাবে দুর্যোগ আসছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ। মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। দেশের জলাশয় ভরাট হচ্ছে। ফলে শহর ও গ্রামের মানুষ দীর্ঘ সময় পানিতে আবদ্ধ থাকছে। যেখানে সেখানে ভবন তৈরি হচ্ছে। ভবন তৈরিতে জাতীয় ভবন বিধিমালা মানা হচ্ছে না। ভবনধসে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে।

বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের অসতর্কতাসহ বিভিন্ন কারণে প্রতিবছর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম আগে থেকেই মানুষকে সচেতন করতে পারে। সরকার ও নীতিনির্ধারণী মহলকে জানাতে পারে। তাদের কোথায় ঘাটতি রয়েছে, কী করণীয় আছে। সারা বছর গণমাধ্যম এসব নিয়ে কাজ করতে পারে। গুজব–আতঙ্কের ক্ষেত্রেও মিডিয়া ভূমিকা রাখতে পারে। চূড়ান্তভাবে বলতে চাই, যাঁরা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় কাজ করবেন, তাঁদের যেন এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ থাকে। তাহলে নিজের নিরাপত্তা হবে। কাজটিও ভালো হবে। তাদের কাজ নিয়ে পরবর্তী সময়ে ফলপ্রসূ ডকুমেন্টেশন করা যাবে।

ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা হলো দুর্যোগের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সবকিছু প্রস্তুত রাখা দ্রুত সতর্ককরণ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, যদি নির্মাণবিধি না মেনে ভবন তৈরি করা হয়, তাহলে জেনেবুঝেই নিজের বাসস্থানকে ঝুঁকিপূর্ণ করা হলো। ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় দেশ অনেক এগিয়েছে। ৫০ হাজার সিপিপি সদস্য আছে। তিন হাজার সাইক্লোন শেল্টার আছে। তবে এ অঞ্চলে পাঁচ হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ প্রস্তুত অবস্থায় নেই। দুর্যোগের সময় গণমাধ্যম ব্যাপক কাজ করে। কিন্তু দুর্যোগের আগে ও পরে সেটি আর থাকে না। বিশেষ করে মৌসুমি দুর্যোগগুলোর আগে গণমাধ্যম মানুষকে সচেতন করতে পারে। কীভাবে সাইক্লোন শেল্টারে যেতে হবে। কী কী নিতে হবে। আরও কী প্রস্তুতি দরকার ইত্যাদি।

বড় দুর্যোগে অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজব্যবস্থা সবকিছুকে দুর্বল করে দেয়। তাই দুর্যোগ মোকাবিলায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ